ঢাকা, বুধবার, ২২ শ্রাবণ ১৪৩২, ০৬ আগস্ট ২০২৫, ১১ সফর ১৪৪৭

সারাদেশ

‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি’ লিখে ফিরলেন প্রবাসী বাহার, হারালেন মা-স্ত্রী-কন্যাসহ ৭ জনকে

মো. নিজাম উদ্দিন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭:২৭, আগস্ট ৬, ২০২৫
‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি’ লিখে ফিরলেন প্রবাসী বাহার, হারালেন মা-স্ত্রী-কন্যাসহ ৭ জনকে প্রবাসী মো. বাহার উদ্দিন যে আনন্দ নিয়ে দেশে ফিরেছেন তা পরিণত হয়েছে বিষাদে। ছবি: বাংলানিউজ

আড়াই বছর পর ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি', ফেসবুকে এমন স্ট্যাটাস দিয়ে ওমান থেকে বাড়ি ফিরছিলেন মো. বাহার। তাকে স্বাগত জানাতে বাড়ি থেকে পরিবারের শিশুসহ ১১ জন সদস্য যান ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে।

গ্রামের বাড়ি থেকে একটি মাইক্রোবাসে করে রওনা হন বাহারের বাবা-মা, স্ত্রী, শিশুকন্যা, দুই ভাইয়ের স্ত্রী ও তাদের দুই শিশু, নানী, শ্বশুর, শ্যালক।  

বাড়ি ফেরার আনন্দ মুহূর্তেই পরিণত হয় বিষাদে। বাহার বাড়ি ফিরেছে ঠিকই তবে সঙ্গে নিয়ে এসেছে পরিবারের সাতজনের লাশ।  

বাহারের বাড়ি লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার উত্তর জয়পুর ইউনিয়নের পশ্চিম চৌপল্লী গ্রামে। ঢাকার বিমানবন্দর থেকে আসার পথে তাদের বহনকৃত মাইক্রোবাসটি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার চন্দ্রগঞ্জ পূর্ব বাজারে রহমতখালী খালে পড়ে যায়। এতে গাড়িসহ পানিতে ডুবে তিন শিশুসহ সাতজন নিহত হয়। নিহতরা সবাই নারী। দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে ফিরেছেন চালকসহ ছয়জন।  

এ ঘটনায় নিহতের স্বজনসহ পুরো এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে। বাড়িতে আনন্দের বদলে বইছে শোকের বন্যা। বুধবার ভোরে দুর্ঘটনার পর লাশগুলো উদ্ধার করে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। সৃষ্টি হয় এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের। সকাল থেকে পারিবারিক কবরস্থানে খোঁড়া হয় একে একে ৬টি কবর। একই সারিত শায়িত করা হবে তাদের। বাকি একজনকে অন্যত্র কবরস্ত করা হবে।

ওমান প্রবাসী বাহার বলেন, কীভাবে নিজেকে সান্ত্বনা দিব? আনন্দ নিয়ে বাড়ি আসছি। কিন্তু পথেই সাতজনের প্রাণ দিতে হয়েছে। কীভাবে এ শোক সইবো?

বলেন, দুই ভাইয়ের দুই শিশু মেয়ে মারা গেছে, এক ভাইয়ের স্ত্রী মারা গেছে। ভাইয়েরা বিদেশে, তাদের কি জবাব দেব? নিজের স্ত্রী-সন্তানেরও প্রাণ গেল। মা মারা গেল। কি নিয়ে বাঁচব আমি?

দুর্ঘটনার জন্য গাড়িচালককে দায়ী করে ওমান প্রবাসী বাহার বলেন, অল্প বয়সী গাড়িচালক। তাকে দেখেই আমার কেমন যেন সন্দেহ হয়েছে। অনভিজ্ঞ মনে হয়েছে। এ জন্য বাবাকে বকাবকি করেছি। গাড়ি চালককে বার বার সতর্ক করে গাড়ি চালাতে বলেছি। কিন্তু শোনেনি। বলছে- কিছু হবে না। পথে কয়েকবার তাকে নামিয়ে রেস্ট নিতে বলি।  

তিনি বলেন, গাড়িটি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের চন্দ্রগঞ্জ পূর্ব বাজারের কাছাকাছি আসার পরে খালে নামিয়ে দেয়। দরজা-জানালা বন্ধ ছিল। তাই প্রথমে গাড়ি নৌকার মতো ভাসছিল। আমি চালককে চিৎকার দিয়ে বলছি, সবগুলো দরজা খুলে দিতে। তাহলে সবাই বের হয়ে যেতে পারতো। কিন্তু সে দরজা না খুলে শুধু সামনের জানালা খুলে দেয়। সে নিজেও জানালা দিয়ে বের হয়ে যায়। জানালা খোলার কারণে গাড়িতে পানি ঢুকে প্রথমে সামনের অংশ ডুবে যায়, আস্তে আস্তে পুরো গাড়ি ডুবে খালের তলদেশে তলিয়ে যায়। ছোট্ট একটা জানালা খুলে আমি বের হই। আমার মাকে বের করার চেষ্টা করি, কিন্তু তিনি আবার আমার নানিকে ধরে রাখেন। আমার স্ত্রীকে বের করতে গেলে, সে শিশু বাচ্চাদের ধরে রাখে। এভাবে গাড়িটি তলিয়ে যায়। খালের পানিতে অনেক স্রোত ছিল। তাদের আর বাঁচাতে পারিনি। চালকের অবহেলাতেই আমার পুরো পরিবার শেষ হয়ে গেল।

বাহারের শ্বশুর ইসকান্দর মির্জা বলেন, আমরা চালকসহ ১৩ জন ছিলাম। আমি চালকের পাশের আসনে বসি। তার চোখ ঘুম ঘুম ছিল। তাকে বলেছি, আমরা পরে যাব, তুমি একটু ঘুমিয়ে নাও। তার যেন খুব তাড়া ছিল। আমাদের কথা শোনেনি। পথে তিন জায়গায় গাড়ি থামিয়ে তাকে রেস্ট নিতে বলি। সর্বশেষ ফেনীতে এসে তাকে বলেছি ১-২ ঘণ্টা ঘুমিয়ে নিতে। কিছুক্ষণ গাড়ি থামিয়ে সে বসেছিল। তার তাড়া থাকায় আমাদের কথা না শুনে গাড়ি চালানো শুরু করে। পথে আমি তার সঙ্গে কথা বলে তাকে সতেজ রাখার চেষ্টা করি। গাড়িটি যখন খালে পড়ে যাওয়ার উপক্রম, তাকে বার বার ব্রেক করতে বলি। কিন্তু সে ঘুম ঘুম চোখে থাকায় গাড়ির নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেনি।

চালকের ত্রুটি রয়েছে কিনা সে বিষয়টি খতিয়ে দেখছে বিআরটিএ। দুপুরে দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে লক্ষ্মীপুর এবং নোয়াখালী বিআরটিএ কার্যালয়ের কর্মকর্তারা।

অন্যদিকে দুর্ঘটনাকবলিত মাইক্রোবাসটি চন্দ্রগঞ্জ হাইওয়ে পুলিশ জব্দ করলেও চালককে আটক করতে পারেনি। তবে তাকে আটকে তৎপর রয়েছে বলে জানিয়েছে চন্দ্রগঞ্জ হাইওয়ে থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোবারক হোসেন।

বাংলানিউজকে তিনি বলেন, গাড়িটি জব্দ করা হয়েছে। চালক পালিয়ে গেছে। তাকে আটকের চেষ্টা চলছে। বিভিন্ন স্থানে চালকের বিষয়ে তথ্য দেওয়া হয়েছে।

উল্লেখ্য, ঢাকার বিমানবন্দর থেকে আসার সময় নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার চন্দ্রগঞ্জ পূর্ব বাজারের যাত্রীবাহী একটি মাইক্রোবাস খালে পড়ে যায়। এতে একই পরিবারের তিন মেয়ে শিশুসহ সাতজন নিহত হয়। এ দুর্ঘটনায় বেঁচে ফিরেছেন গাড়িচালকসহ ছয়জন।  

নিহতদের বাড়ি লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার উত্তর জয়পুর ইউনিয়নের পশ্চিম চৌপল্লী গ্রামের কাসালী বাড়ি। ওই বাড়ির ওমান প্রবাসী বাহারকে ঢাকার বিমানবন্দর থেকে নিয়ে আসার সময় পথে বাড়ি থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে এ দুর্ঘটনা ঘটে।  

নিহতরা হলেন- প্রবাসী বাহারের মা মুরশিদা (৫০), স্ত্রী কবিতা (২৩), মেয়ে মীম (২), নানি ফয়জুননেছা (৮০), ভাইয়ের স্ত্রী লাবনী (২৫), ভাতিজি লামিয়া (৮) ও রেশমী (৯)।
 
বেঁচে ফেরা যাত্রীরা হলেন- প্রবাসী বাহার ও তার বাবা আবদুর রহিম, শ্বশুর ইসকান্দর মির্জা, তার শ্যালক রিয়াজ ও ভাইয়ের স্ত্রী সুইটি এবং গাড়ি চালক রাজু।  

আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।