ঢাকা, শুক্রবার, ২৪ শ্রাবণ ১৪৩২, ০৮ আগস্ট ২০২৫, ১৩ সফর ১৪৪৭

সারাদেশ

তৃতীয় পর্ব

তারিক সিদ্দিকের অপকর্ম জানে গোটা বিশ্ব

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০:৪১, আগস্ট ৮, ২০২৫
তারিক সিদ্দিকের অপকর্ম জানে গোটা বিশ্ব তারিক সিদ্দিক, প্রতীকী ছবি

পাপ নাকি কখনো চাপা দেওয়া যায় না। তারিক সিদ্দিকের ক্ষেত্রে ঘটনাটা পুরোপুরি সত্য।

তারিক সিদ্দিক যে দুর্নীতিবাজ, তিনি যে সশস্ত্র বাহিনীর কেনাকাটা করে কমিশন করেছেন, তিনি অর্থ ছাড়া কোনো কাজই করেন না এবং কমিশন ছাড়া কারও জন্য কোনো কিছু করেন না- সেটি দেশের মানুষ সবাই জানত। সবাই তারিক সিদ্দিকের দুর্নীতির অপকর্ম এবং ঘৃণ্য তৎপরতার কথা জানত। এমনকি তৎকালীন সরকারের মধ্যেও তার দুর্নীতি নিয়ে কানাঘুষা হতো। কিন্তু কেউ প্রকাশ্যে তার বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস পেত না।

তিনি শুধু দুর্নীতিবাজই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন পৈশাচিক নরপশু। এটাই সবাই জানত। কিন্তু তারিক সিদ্দিক যেহেতু গুম এবং হত্যার একজন নির্দেশদাতা, সেজন্য তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলার সাহস পেত না। তারিক সিদ্দিক কারও ওপর রুষ্ট হলে হয় তাকে গুম হতে হতো অথবা যেতে হতো ‘আয়না ঘরে’। শুধু দেশে নয়, বিদেশেও তারিক সিদ্দিকের অপকর্মের কথা সবাই জানত। আর তারিক সিদ্দিক নিজেও জানতেন যে, আওয়ামী লীগ পতন হওয়ার পর তার এসব অপকর্মের কাহিনি দেশের জনগণ জানবে। তার এই দেশে থাকা সম্ভব হবে না। এ কারণেই বিদেশের নাগরিকত্বের জন্য বিভিন্ন সময়ে তিনি চেষ্টা করেছিলেন।

২০১৩ সালে যখন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে উত্তাল গণ আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল, সেই সময় তারিক সিদ্দিক সপরিবারে বিদেশ পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। কারণ সেই সময় দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল উত্তপ্ত। সব বিরোধী দল নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছিল। এ সময় তারিক সিদ্দিক সপরিবারে মাল্টার নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেন। তিনি এ আবেদন করার পর মাল্টা তাদের দেশের নিয়ম অনুযায়ী তার আয়ের উৎস এবং অন্য বিষয়গুলো তদন্ত করে। মাল্টাতে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমা দিয়ে নাগরিকত্ব পাওয়ার বিধান রয়েছে।

বহু মানুষ এটি গ্রহণ করে থাকে। কিন্তু সেই অর্থের সুনির্দিষ্ট উৎস বলতে হয়। কিন্তু তারিক সিদ্দিক যখন ২০১৩ সালের ১৮ অক্টোবর এ আবেদন করেন তখন মাল্টা সরকারের অভিবাসন বিভাগ তারিক সিদ্দিক, স্ত্রী শাহীন সিদ্দিক এবং মেয়ে বুশরা সিদ্দিকের আয়ের উৎস কী তা সম্পর্কে জানতে চায়। তারিক সিদ্দিক কিছু ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে তার আয়ের উৎস জানানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ওই বছরের ডিসেম্বর মাসে মাল্টার নাগরিকত্ব নাকচ করে দেওয়া হয়। শুধু তিনি নয়, তার স্ত্রীকেও নাগরিকত্ব দিতে অস্বীকৃতি জানায় মাল্টা।

এরপর ২০১৫ সালে আইনজীবীর মাধ্যমে কাগজপত্র ঠিক করে তিনি আবেদন করেন। কিন্তু সেই আবেদনও নাকচ হয়ে যায়। অর্থ পাচার, দুর্নীতি, প্রতারণা ঘুষের অভিযোগ থাকায় তার নাগরিকত্বের আবেদন দুই বারই প্রত্যাখ্যাত হয়েছে বলে মাল্টা অভিবাসন সংস্থা জানিয়েছে। এ বিষয়টি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফিনান্সিয়াল টাইমসের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।

শাহীন সিদ্দিক যুক্তরাজ্যের ক্ষমতাসীন লেবার পার্টি থেকে নির্বাচিত এমপি এবং সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যক্রমের দায়িত্বে থাকা ট্রেজারি মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিকের চাচি এবং তারেক সিদ্দিকের স্ত্রী। ফিনান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৩ সালে মাল্টার নাগরিকত্ব বিনিয়োগ প্রকল্প পরিচালনা থাকা ‘হেনলি অ্যান্ড পার্টনারস’ নামে একটি সংস্থা শাহীন সিদ্দিকের আবেদন ফিরিয়ে দেয়। এ সংস্থাটি সে সময় বিদেশি নাগরিকদের মাল্টার নাগরিকত্ব দেওয়ার বিষয়ে কাজ করত। ফিনান্সিয়াল টাইমসের কাছে আসা এ সংক্রান্ত নথিপত্র তথ্য অনুযায়ী শাহীন সিদ্দিক ঢাকায় প্রচ্ছায় নামে একটি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারপারসন ছিলেন। এ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অবৈধ জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে। ২০১২ সালে প্রচ্ছায় সংস্থার নামে শাহীন সিদ্দিকের বিরুদ্ধে ঢাকায় মূল্যবান জমি দখলের অভিযোগ ওঠে। ২০১৬ সালে তিনি এসব জমি বিক্রি করে দেন। অভিযোগ আছে, তিনি তার স্বামী তারিক সিদ্দিকের ক্ষমতার অপব্যবহার করে এসব জমি দখল করেন এবং সুযোগ বুঝে বিক্রি করেন। এ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর একাধিক গণমাধ্যম রোষানোলে পড়েছিল। এসব প্রতিবেদন মাল্টার কর্তৃপক্ষের নজরে এসেছিল। এ অভিবাসন সংস্থা শাহীন সিদ্দিকের আবেদন প্রত্যাখ্যান করে দেয়। এরপরও তারিক সিদ্দিক তার চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। ২০১৫ সালের মার্চে প্রচ্ছায় কথা উল্লেখ না করে নিজেকে আর্ট অব প্রেস লিমিটেডের মালিক হিসেবে আবেদন করেন। শাহীন সিদ্দিক এবং তার মেয়ে বুশরা সিদ্দিকের জন্যও মাল্টায় আবেদন করেন। মাল্টার দ্বিতীয় আবেদনে বুশরাকে ইংল্যান্ডের নাগরিক হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

তিনি লন্ডনে শিক্ষার্থী হিসেবে পড়াশোনা করছিলেন। ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্স একজন কর্মচারী এক ইমেলে জানান, মাল্টা কর্তৃপক্ষ এ প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে আরও বিস্তারিত তথ্য জানতে চায়। যাচাই-বাছাই শেষে ওই বছরের শেষ দিকে শাহীন সিদ্দিক ও বুশরা সিদ্দিকের দ্বিতীয় আবেদনও বাতিল করা হয়। মাল্টা সরকারের একটি গেজেটে নিশ্চিত করা হয় শাহীন সিদ্দিক এবং বুশরা সিদ্দিক কেউই দেশটির নাগরিকত্ব পাননি। এই প্রত্যাখ্যানের নথিতে বলা হয়, আবেদন ফর্মে শাহীন সিদ্দিক মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরের একটি ব্যাংকের তথ্য জমা দেন। তার ওই অ্যাকাউন্টে ২৭ লাখ ৬০ হাজার ডলার ছিল, যে আবেদনের মাত্র দুই মাস আগে তার অ্যাকাউন্টে জমা হয়। এ বিপুল পরিমাণ অর্থের উৎস সম্পর্কে নথিতে কোনো কিছু উল্লেখ ছিল না।

উল্লেখ্য, মাল্টার নাগরিকত্ব না পেলেও তারিক সিদ্দিক, তার স্ত্রী শাহীন সিদ্দিক এবং মেয়ে বুশরা সিদ্দিক তিনজনই মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম স্কিমের মাধ্যমে সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি পেয়েছেন। একই সঙ্গে তারিক সিদ্দিক দুবাইতে পারমানেন্ট রেসিডেন্সি গ্রহণ করেছেন। দুবাইয়ে তার বিপুল পরিমাণ সম্পদ রয়েছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে যে, তারিক সিদ্দিক দুবাইতে একটি সিকিউরিটি সার্ভিস প্রতিষ্ঠানের অন্যতম কর্ণধার এক এগারোর অন্যতম নাটের গুরু মেজর জেনারেল আমিন ওরফে বিহারী আমিন। তিনি এ কোম্পানিতে উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন ২০১০ সাল থেকে। দুবাইতে তারিক সিদ্দিক বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করেছেন। দুবাইতে তার একাধিক ফ্ল্যাট এবং দোকান রয়েছে বলে নিশ্চিত তথ্য রয়েছে।  

দুবাই ছাড়াও সিঙ্গাপুরে তারিক সিদ্দিকের বিনিয়োগের খবর পাওয়া গেছে। ২০১৭ সালে আজিজ খানের মাধ্যমে তারিক সিদ্দিক সিঙ্গাপুরে ৬ হাজার স্কয়ার ফিটের একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট তৈরি করেন। এ ফ্ল্যাটটি তারিক সিদ্দিককে আজিজ খান উপহার দিয়েছেন বলে জানা গেছে। প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় সিঙ্গাপুরে এলে এ বাড়িতে থাকেন। এ বাড়িতে সবকিছু গোছানো আছে। তারিক সিদ্দিকও সেখানে যান এবং অবস্থান করেন বলে জানা গেছে। এ ছাড়াও তারিক সিদ্দিকের মেয়ে বুশরা সিদ্দিক ব্রিটিশ নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন ২০১৯ সালে। তারিক সিদ্দিক এবং তার স্ত্রীও ব্রিটেনে অবস্থান করছেন। যেখানে তারিক সিদ্দিকের স্ত্রীর নামে একটি ফ্ল্যাট আছে। এ তিনটি দেশ ছাড়াও তুরস্কে তারিক সিদ্দিকের বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের খবর পাওয়া গেছে। সেই দেশটির বিদেশিদের বিনিয়োগ সংক্রান্ত নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, সেখানে তারিক সিদ্দিক শত কোটি ডলারের বেশি বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করেছেন। এসব বিনিয়োগের মধ্যে রয়েছে হোটেল ব্যবস্থাপনা, খাদ্য এবং পরিবহন খাত। তারিক সিদ্দিক বিভিন্ন সময় তুরস্কে গেছেন বলেও একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।

এ ছাড়াও তারিক সিদ্দিকের স্ত্রীর নামে কানাডার ভ্যাঙ্কুয়েভারে বাড়ি রয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা যখন কানাডাতে অবস্থান করতেন, সেই সময় এ বাড়িটি ক্রয় করা হয়। এটি প্রথমে সায়মার প্রাক্তন স্বামীর নামে থাকলেও পরবর্তীতে তা ২০২০ সালে তারিক সিদ্দিকের স্ত্রীর নামে হস্তান্তর করা হয়। এ ছাড়াও টরন্টোতে সায়মার সাবেক স্বামীর নামে একটি রেস্টুরেন্ট, পরবর্তীতে তারিক সিদ্দিকের স্ত্রীর নামে হস্তান্তর করা হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তারিক সিদ্দিক এভাবে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। এসব সম্পত্তি হলো লুটের সম্পত্তি। আর এ কারণেই বিশ্বে তারিক সিদ্দিক বাংলাদেশের দুর্নীতির একজন বরপুত্র হিসেবে পরিচিত। সারা বিশ্ব জানে যে তারিক সিদ্দিক একজন দুর্নীতিবাজ, দুর্নীতির টাকায় তিনি বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন।
এসআই
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।