ঢাকা, রবিবার, ২৬ শ্রাবণ ১৪৩২, ১০ আগস্ট ২০২৫, ১৫ সফর ১৪৪৭

সারাদেশ

পাল্টেছে যশোরের নির্বাচনী মহারণের সমীকরণ

সরোয়ার হোসেন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪:২৬, আগস্ট ১০, ২০২৫
পাল্টেছে যশোরের নির্বাচনী মহারণের সমীকরণ

যশোর: জোরালোভাবে নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করেছে যশোরের রাজনীতিতে। সম্ভাব্য মনোনয়ন প্রত্যাশীরা মাঠে নেমে পড়েছেন আগে থেকেই।

তারা নিজেদের সাংগঠনিক শক্তি-সামর্থ প্রকাশের পাশাপাশি জনসমর্থন আদায়ের জন্য চালাচ্ছেন নানা কার্যক্রম। সেক্ষেত্রে স্থানীয় সমস্যা ও সম্ভাবনাগুলো সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে। নেতাদের পক্ষ থেকে দেওয়া হচ্ছে নানা প্রতিশ্রুতি।

ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের কার্যক্রম মানবতাবিরোধী অপরাধের কারণে স্থগিত ঘোষণার পর যশোরের নির্বাচনী মহারণেরও সমিকরণ পাল্টাতে শুরু করেছে। ধারণা করা হচ্ছে, এত দিনের চির প্রতিদ্বন্দ্বিতার বাইরে এবার মূল লড়াই হবে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে।  

তবে, বসে নেই নবগঠিত এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিসসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও। সব দলের নেতাদের নির্বাচনী প্রস্তুতিতে সরগরম হয়ে উঠেছে বৃটিশ-ভারতের প্রথম এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের প্রথম শত্রুমুক্ত জেলা যশোরের রাজনীতি।

সীমান্তবর্তী শার্শা উপজেলা নিয়ে গঠিত হয়েছে যশোর-১ সংসদীয় আসন। দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোল এই আসনের অন্তর্গত। দেশের বৈদেশিক আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের প্রায় ৬০ শতাংশ আসে এই স্থলবন্দর দিয়ে। বন্দরকে কেন্দ্র করে বেনাপোলে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ব্যবসা-বাণিজ্য। যার মাধ্যমে হাজার হাজার পরিবারের জীবিকা নির্বাহ হচ্ছে।  

এছাড়া, এই এলাকায় গড়ে উঠেছে চোরাচালানের একাধিক সিন্ডিকেট। চলে মাদক, অস্ত্র, সোনা ও মানব চোরাচালান। সীমান্ত বাণিজ্যের একটি বড় অংশই পণ্য চোরাচালানের মাধ্যমে সংঘটিত হয়। তা, ফ্যাসিস্ট উত্তর বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কের ক্রমাবনতির মধ্যেও চলমান। বিগত আওয়ামী লীগের আমলে তাদের নেতাকর্মীরা এসব চোরাচালানের সিন্ডিকেটগুলো নিয়ন্ত্রণ করতেন। এখনো অনেক স্থানে তাদের পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। ফলে আওয়ামী লীগ না থাকলেও যশোর-১ আসনটি হয়ে উঠবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।  

ঝিকরগাছা এবং সীমান্তবর্তী আর এক উপজেলা চৌগাছা নিয়ে গঠিত যশোর-২ আসন। চৌগাছাও চোরাচালানের জন্য দেশব্যাপী পরিচিত। বিশেষ করে অস্ত্র, মাদক ও সোনা চোরাচালানের রুট হিসেবে এই সীমান্ত একাধিকবার জাতীয় শিরোণাম হয়েছে। আছে বিল, বাওড়ের মতো জলাশয়, যেখান থেকে প্রচুর রোজগারের সুযোগ রয়েছে। অন্যদিকে, ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালি দেশের ফুল উৎপাদনে অনন্য নজির স্থাপনকারী এলাকা। এর নিয়ন্ত্রণ নিয়েও রয়েছে নানা আলোচনা। ফলে যশোর-২ আসনটিও এবার জাতীয় নির্বাচনের আগে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

জেলার ভিআইপি আসন ধরা হয় যশোর-৩ কে। সদর উপজেলা নিয়ে গঠিত এই আসনটিতে সাধারণত দলের কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বা জেলার শীর্ষ নেতারা প্রার্থী হন। অতীতেও যেসব নেতা এই আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছেন বা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন তারা মন্ত্রীসহ রাষ্ট্রের নানা গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। যেহেতু আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ সেহেতু এবার এই আসন থেকে একক নেতা হিসেবে বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিতের নামই বেশি উচ্চারিত হচ্ছে। তার প্রতিদ্বন্দ্বিরা রাজনৈতিকভাবে নিজ নিজ দলে গুরুত্বপূর্ণ হলেও সাধারণের মধ্যে তেমন কোনো প্রভাব এখনো পরিলক্ষিত হয়নি।  

এক সময়কার চরমপন্থী অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে পরিচিত যশোরের বাঘারপাড়া এবং অভয়নগর নিয়ে গঠিত যশোর-৪ নির্বাচনী এলাকা। এই দুই উপজেলার একটা বড় অংশ যশোরের দুঃখ হিসেবে পরিচিতি জলাবদ্ধতার শিকার ভবদহ এলাকার অন্তর্গত। যে এলাকায় যুগের পর যুগ কোনো ফসল হয় না। কষ্ট এই এলাকার মানুষের নিত্য সঙ্গী। এর ওপর রয়েছে ঘের নিয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাত। আসনটিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোট তুলনামূলক বেশি। অভয়নগরের নওয়াপাড়া দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পাঞ্চল হিসেবে পরিচিত। নৌবন্দর হিসেবেও নওয়াপাড়ার নামডাক রয়েছে।  

বিভিন্ন সময় এই আসনটি নানা নেতিবাচক শিরোনাম হয়। যা কখনো কখনো দেশের গন্ডি পেরিয়ে বর্হিবিশ্বেও ছড়িয়ে পড়ে। ফলে প্রতিটি নির্বাচনে এই আসনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। যদিও শেষ বিচারে দলীয় বিবেচনার কাছে হার মানে ভোটারের সচেতনতাবোধ। তবে, আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলো জলাবদ্ধতা নিরসনে কার্যকরী উদ্যোগ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা এবং শিল্পাঞ্চলে বন্ধ থাকা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো চালুর ব্যাপারে প্রথম থেকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলেছে।  
 
যশোর-৫ আসনটি গঠিত হয়েছে মণিরামপুর উপজেলা নিয়ে। এই উপজেলার একটা অংশও ভবদহের অন্তর্ভুক্ত। যা বছরের অধিকাংশ সময় জলাবদ্ধ থাকে। এই আসনেও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস অনেক বেশি। ফলে আসন্ন নির্বাচনে যশোর-৫ আসনের গুরুত্ব কোনো অংশে কম নয়।

যশোর-৬ সংসদীয় আসন গঠিত কেশবপুর উপজেলা নিয়ে। এখানে জন্ম নিয়েছেন বাংলা সাহিত্যের অমর কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তাঁর স্মৃতিবিজড়িত সাগরদাঁড়ি ঐতিহাসিক নিদর্শন। রয়েছে ভরত রাজার দেউল, মির্জানগর হাম্মামখানা, সাহিত্যিক ধীরাজ ভট্টাচার্যের বাড়িসহ নানা ঐতিহাসিক স্থাপনা। বিরল প্রজাতির কালোমুখো হনুমানের জন্যও এই উপজেলা বিখ্যাত। ভবদহের প্রভাবে এই উপজেলার একটা অংশও বছরের দীর্ঘ একটা সময় জলাবদ্ধ থাকে। ফলে আসন্ন নির্বাচনে যশোর-৬ আসনে যারা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হবেন তাদেরকে ভোটারদের সাথে পরিবেশ ও প্রতিবেশের সংরক্ষণ ও উন্নয়ন নিয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে বলেই মনে করছেন স্থানীয়রা।  

এদিকে, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রায় প্রতিদিন ঘরোয়া আলোচনা, উঠান বৈঠক, কর্মী সভা, মতবিনিময় সভা আর গণসমাবেশে সরগরম থাকছে জেলার রাজনৈতিক অঙ্গণ। জাতীয় ইস্যু নিয়ে অনুষ্ঠিত সভাগুলোতেও প্রধান আলোচ্য হচ্ছে নির্বাচন। সম্ভাব্য প্রার্থীরা নানা উছিলায় হাজির হচ্ছেন জনগণের সামনে।  

জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে রাষ্ট্রপরিচালনায় অধিষ্ঠিত হওয়ার দৌড়ে এই মুহুর্তে জেলায় প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। এই দুই দলের মধ্যে জামায়াতের পক্ষ থেকে আসনভিত্তিক দলীয় প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হয়েছে প্রায় আট মাস আগে। বিএনপির পক্ষ থেকে কোনো প্রার্থির নাম ঘোষণা করা না হলেও প্রতিটি আসনেই একাধিক নেতা দলীয় প্রার্থী হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যে জেলার ছয়টি আসনেই দলীয় প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেছে খেলাফত মজলিস।

অন্যদিকে, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশও প্রতিটি আসনে দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালিত করছে নির্বাচনকে সামনে রেখে। মূলত প্রাথমিক পর্যায়ে দল গোছানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেছে তারা।

যশোরে এনসিপির সাংগঠনিক কাঠামো তৈরি হলেও জেলা-উপজেলাগুলোতে দলটির তেমন কোনো প্রভাব এখনো পরিলক্ষিত হয়নি। দলের কয়েকজন নেতা উঠানবৈঠক, গণসংযোগের মাধ্যমে নিজের পরিচিতি চালিয়ে যাচ্ছেন।  

যশোরে আরও যেসব রাজনৈতিক দলের নেতারা কার্যক্রম পরিচালনা করছেন তাদের মধ্যে গণঅধিকার পরিষদ অন্যতম। এই দলের একজন নেতাকে এখনো মাঠে সক্রিয় দেখা যাচ্ছে। এর বাইরে দলটির পক্ষ থেকে আর কোনো কার্যক্রম পরিচালনা হতে দেখা যায় না।  

তবে, এবার যশোরের কমিউনিস্ট ও বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নির্বাচন নিয়ে কোনো আলোচনা শোনা যাচ্ছে না।

এসএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।