ঢাকা, শুক্রবার, ১ কার্তিক ১৪৩২, ১৭ অক্টোবর ২০২৫, ২৪ রবিউস সানি ১৪৪৭

সারাদেশ

লিবিয়ায় নিখোঁজ ৩৮ বাংলাদেশির পরিবারে অজানা আতঙ্ক

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫:৪৬, অক্টোবর ১৬, ২০২৫
লিবিয়ায় নিখোঁজ ৩৮ বাংলাদেশির পরিবারে অজানা আতঙ্ক ইতালি যাওয়ার পথে নৌকা ডুবে নিখোঁজদের কয়েকজন।

হবিগঞ্জ: লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার পথে নিখোঁজ হবিগঞ্জের ৩৮ তরুণের কোনো সন্ধান মেলেনি দুই সপ্তাহেও। এতে তাদের পরিবার ও স্বজনদের উৎকণ্ঠা দিন দিন বাড়ছে।


 
নিখোঁজদের লিবিয়ায় নেওয়া ‘আদম বেপারি’ হাসান মোল্লা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন সময় পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। সম্প্রতি তিনি এক ঘোষণার মাধ্যমে নিখোঁজদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগও বন্ধ করে দিয়েছেন।
 
হবিগঞ্জ জেলার ৩৮ তরুণ ভূমধ্যসাগরে নিখোঁজের সংবাদ প্রকাশ হলে, গত মঙ্গলবার রাতে হাসান মোল্লা বাংলানিউজের সঙ্গে যোগাযোগ করে দাবি করেন, জেলার বিভিন্ন স্থানের ৩৫ জন তরুণ ভূমধ্যসাগরে কিছু সময় নেটওয়ার্কের বাইরে ছিলেন, পরে তাদের নিরাপদ আশ্রয়ে নেওয়া হয়েছে।
 
অন্যদিকে, হাসান আশরাফ সানমুন নামে তার ফেসবুক আইডি থেকে করা এক মন্তব্যে বলা হয়েছে, ইতালিগামী চারটি নৌকার একটি মাঝপথে ডুবে যায়। অন্য তিনটি নৌকা সঠিকভাবে ইতালি পৌঁছেছে। ডুবে যাওয়া নৌকার কেউ কেউ হাসপাতালে, অনেকে জেলে রয়েছেন। তবে কে কে জেলে, তা তিনি নিশ্চিত নন।
 

এদিকে, গত ছয় মাসে ৭৫০ জনকে লিবিয়া থেকে ইতালি পাঠিয়েছেন জানিয়ে মোল্লার ফেসবুক আইডিতে আপডেট দেওয়া আছে। সঙ্গে সমুদ্রপথে জীবনঝুঁকি নিয়ে রওনা দেওয়া তরুণদের ছয়টি ভিডিও প্রকাশ করা হয়। তবে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রতিবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে হাসান দাবি করেছেন তিনি লোক পাঠিয়েছেন ৩০০। আবার বোট দুর্ঘটনার দুইদিন পর ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন তার যোগাযোগের সব নম্বর হ্যাক হয়েছে, কেউ যেন যোগাযোগ অথবা লেনদেনের চেষ্টা না করেন।
 
৩৮ জন লোককে ইতালি পাঠানোর জন্য সাগরে ভাসিয়ে নিখোঁজ হওয়ার পর তার দেওয়া এসব অসামঞ্জস্য তথ্য এলাকায় বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। লোকজন ঘটনাকে যে যার মতো ব্যাখ্যা করে প্রচারণা চালাচ্ছেন। তথ্যের এমন ভিন্নতা নিখোঁজ যুবকদের পরিবারেও উৎকণ্ঠা আরও বাড়াচ্ছে। কিন্তু মোল্লার ভয়ে তারা গণমাধ্যম অথবা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলছেন না।
 
বানিয়াচংয়ের কালিকাপাড়ার এক ইতালি প্রবাসী বাংলানিউজকে বলেন, “নিখোঁজ থাকা তরুণদের মধ্যে আমার আত্মীয় দুইজন রয়েছেন। পরিবারের সদস্যরা উৎকণ্ঠায় আছেন। যদি তারা নিরাপদেই থাকেন, তাহলে হাসান মোল্লা তাদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ করে দিচ্ছেন না কেন? উৎকণ্ঠা দিন দিন বাড়ছে। ” ওই প্রবাসী তার পরিচয় গোপন রাখতে অনুরোধ জানান। একইভাবে ফেসবুকে নিখোঁজ স্বজনদের ছবি দিয়ে আরও অসংখ্য লোক শঙ্কা প্রকাশ করে দোয়া চান।
 
নিখোঁজদের পরিবারের সাতজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৩০ সেপ্টেম্বর ইতালীর উদ্দেশ্যে ত্রিপোলি উপকূলে নৌকায় ওঠার পর থেকে তাদের সঙ্গে আর যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। মোবাইলে পাওয়া যাচ্ছে না হাসানকেও। তাদের উদ্বেগ যত সময় যাচ্ছে তত বাড়ছে।

যাত্রাপাশা তালাবপাড়ের দুই যুবক নিখোঁজদের মধ্যে রয়েছেন। পরিচয় গোপন রেখে তাদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পরিবারের সদস্যরা একেকজন একেক কক্ষে নীরবতার সঙ্গে বসে আছেন। আত্মীয়-স্বজনরা এসে তাদের সান্ত্বনা দিচ্ছেন। ঘরে নিয়মিত রান্না করাও হচ্ছে না।
 

নিখোঁজদের একজনের পরিবারের এক সদস্য মোবাইল ফোনে বলেন, “আপনারা সংবাদ প্রকাশ করবেন না, তাহলে লিবিয়ায় বেঁচে থাকলেও আমাদের ছেলেদের ক্ষতি হতে পারে। ”
 
অনুসন্ধানে জানা যায়, পশ্চিমভাগের (‘আদম বেপারী’ হাসান মোল্লার গ্রাম) সৈকত নামে এক যুবক তার নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ইতালিতে গেছেন। তাকে ১৮ লাখ টাকার চুক্তিতে পাঠিয়েছিলেন হাসান। পরে সৈকত মাফিয়া চক্রের হাতে ধরা পড়ে এবং ইতালি পৌঁছাতে মোট ৩০ লাখ টাকা দিতে হয়েছে। নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা আলোচনায় আসার পর সৈকত এতথ্য ফেসবুকে শেয়ার করেছিলেন। তবে পরে হাসান চাপ দিয়ে তাকে পোস্টটি মুছে ফেলতে বাধ্য করেন।
 
মোদাচ্ছির মিয়া নামে এক যুবক ইতালি প্রবাসী যুবক খোয়াইকে বলেন, হাসান মোল্লার অভিবাসন নেটওয়ার্ক যুবকদের নিরাপত্তা দেওয়ার ক্ষমতা রাখে না। তিনি শুধু ছেলেদের বিভ্রান্ত করে তাদের কাছ থেকে ১৮-২০ লাখ টাকা নেন এবং লিবিয়ার মানবপাচারকারীদের নৌকায় তুলে দেন। এরপর তার আর কিছু করার ক্ষমতা থাকে না।  

অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী যুবকদের মাফিয়া চক্রের হাতে তুলে দিয়ে বড় অঙ্কের টাকা আদায় করা হয়। অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে তাদের নানাভাবে কষ্ট দেওয়া হয়। মোদাচ্ছির মিয়া যুবকদের পরামর্শ দেন, এই পথে না গিয়ে ভিসা নিয়ে বৈধভাবে ইউরোপে যাওয়া উচিত।
 
এদিকে, দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে সাগরে নিখোঁজ থাকা হবিগঞ্জের ৩৮ জনের পরিবারের পাশে দাঁড়ায়নি প্রশাসন। পরিবারের সদস্যরাও ভয়ে আইনগত পদক্ষেপ নিতে সাহস পাচ্ছেন না।
 
এ ব্যাপারে হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক (ডিসি) ড. মো. ফরিদুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) এএনএম সাজেদুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, “আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে এমন ঘটনার খবর পাই। এই ঘটনাটিও জানতে পেরেছি। তবে কেউ অভিযোগ না করলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব নয়। তারপরও পুলিশের সংশ্লিষ্ট ইউনিটকে জানিয়েছি। আপনারা যদি যথাযথ তথ্য-প্রমাণ দেন, আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেব। এ ধরনের অপরাধ প্রতিরোধে সচেতনতার বিকল্প নেই। ”
 
নিখোঁজদের মধ্যে ১৪ জনের নাম পাওয়া গেছে। তারা হলেন- হবিগঞ্জ শহরে উমেদনগর এলাকার লকুছ মিয়া, আরমান আহমেদ ও বাবলু মিয়া, আজমিরীগঞ্জ উপজেলার পশ্চিমভাগের মানু শাহ, পারভেজ মিয়া, পবলু মিয়া, বানিয়াচং উপজেলার যাত্রাপাশা মহল্লার আলফাজ মিয়া রনি, মোজাক্কির আহমেদ, সিয়াম জমাদার, মিজান হাসান, মজলিসপুরের সায়েম খান, আদমখানীর রবিন মিয়া, এড়ালিয়াপাড়ার জসিম মিয়া, আলফাজ আহমেদ রনি। বাকিরা আজমিরীগঞ্জের পশ্চিমভাগ, জলসুখা ও বানিয়াচং উপজেলার তারাসই গ্রামসহ বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দা।
 
প্রসঙ্গত, গত ৩০ সেপ্টেম্বর লিবিয়ার ত্রিপলি থেকে ইতালির উদ্দেশে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে চারটি নৌকা ছেড়ে যায়। এর মধ্যে একটি নৌকায় হবিগঞ্জের ৩৮ জনসহ প্রায় ৯০ জন ছিলেন, সেই নৌকাটিই নিখোঁজ হয়েছে। বাকি তিনটি নৌকা ইতালিতে পৌঁছেছে।
 
আজমিরীগঞ্জের পশ্চিমভাগ গ্রামের লিবিয়া প্রবাসী হাসান আশরাফ ওরফে হাসান মোল্লার মাধ্যমে ওই ৩৮ জন ১৭ থেকে ২০ লাখ টাকা করে দিয়ে ইতালি যাওয়ার উদ্যোগ নেন।
 
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।