কলসিন্দুর, ধোবাউড়া (ময়মনসিংহ)ঘুরে এসে: কিশোরী ফুটবলারদের মনে নতুন স্বপ্নের বীজ তিনিই বুনেছিলেন। শুধু পুঁথিগত বিদ্যা নয়, খেলার মাঠেও দ্যুতি ছড়াতে শিখিয়েছেন উদ্দীপক মন্ত্র।
দেশের ফুটবল অঙ্গন ছাপিয়ে বিদেশের মাটিতেও ক্রমশ আসতে শুরু করে সাফল্য। বাংলাদেশ অনুর্ধ্ব-১৪ নারী ফুটবল দলের ১০ কিশোরী ফুটবলারের এ পর্যায়ের উঠে আসার পেছনের কারিগরের নাম মিনতি রাণী শীল। ময়মনসিংহের সীমান্তবর্তী ধোবাউড়া উপজেলার কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা।
বৃহস্পতিবার(৩০ এপ্রিল’২০১৫) সরেজমিনে ওই বিদ্যালয়ে গেলে আলাপ হয় নারী ফুটবলের জাগরণে ব্রত আদর্শবান এ শিক্ষিকার। নিজের বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের মানসম্মত পড়াশুনার পাশাপাশি খেলাধূলার গুরুত্বও আন্তরিকভাবে উপলব্ধি করেন।
আলাপাচারিতায় তিনি এক ঝাঁক প্রমিলা ফুটবলার তৈরির শুরু গল্প, তাদের নিয়ে স্বপ্ন, সমস্যা ও সম্ভাবনার কথামালাও অকপটে বাংলানিউজের কাছে তুলে ধরেন।
এ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গন্ডি পেরিয়ে ক্ষুদে ফুটবলাররা এখন বিদ্যালয়ের সামনের কলসিন্দুর উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করছে। দূর থেকে হাতছানি দেয়া দৃষ্টিনন্দন পাহাড়ি সৌন্দর্যের নয়নাভিরাম উপজেলা ধোবাউড়ার স্থানীয় কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে ২০০৯ সালের গোড়ার দিকে যোগ দেন মিনতী রাণী শীল।
ওই বছরই বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ফুটবল টুর্নামেন্টে তার বিদ্যালয়ের ছেলেদের টিম উপজেলায় চ্যাম্পিয়ন হয় এবং জেলায় খেলতে যায়।
সেইদিনের স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠে মিনতী রাণীর। নিজেই বলেন, ‘তখন প্রায়ই মনে হতো বিদ্যালয়ের এত বড় খেলার মাঠ। যদি মেয়েরাও খেলতে পারতো খুব ভাল হতো। টিভিতে মেয়েদের খেলাও দেখতাম। ’
নিজের মনে এ ভাবনা উঁকি দেয়ার এক বছরের মাথায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মহাপরিচালকের(ডিজি) অফিস থেকে বিদ্যালয়ে চিঠি আসে। বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেসা মুজিব গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্টে মেয়েদের অংশ নিতে হবে। যেই নির্দেশ সেই কাজ।
অন্যরকম মিশন শুরু হলো আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর এ শিক্ষিকার। নতুন এ স্বপ্ন বিনির্মাণে সঙ্গী হিসেবে পেলেন সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. মফিজ উদ্দিন ও নিজের উচ্চ শিক্ষিত পুত্র সুরঞ্জিত রায়কে।
যেন নতুন যুদ্ধজয়ের দৃঢ় সংকল্প। তাদের দু’জনকে দায়িত্ব দিলেন প্রমিলাদের ফুটবলের অ, আ, ক, খ শেখানোর। প্রতিদিন নিয়ম করে বিকেলে বিদ্যালয় মাঠেই হতো প্রশিক্ষণ।
‘অনেক কষ্ট করে মেয়েদের মাঠে নামালাম। ওরা কেউ নামতে চায় না, লজ্জা পায়। অভিভাবক মহল থেকেও আপত্তি আসতে শুরু করে। ফুটবল ছেলেদের খেলা, মেয়েরা খেলবে কেন। তখন তাদের প্রতিনিয়ত বুঝিয়েছি সরকার থেকে চিঠি এসেছে। উপজেলা পর্যায়ের অফিসারদেরও এনেছি মেয়েদের অভিভাবকদের বুঝাতে’ বলেন মিনতি রাণী শীল।
প্রথম বছরেই সাফল্য ধরা দেয় কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কিশোরী ফুটবলারদের। উচ্ছ্বাস ভরা কণ্ঠে তিনি বলেন, ২০১১ সালে অনুষ্ঠিত বঙ্গমাতা প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্টে এ বিদ্যালয় ঢাকা বিভাগীয় চ্যম্পিয়ন হলে এলাকায় ব্যাপক সাড়া পড়ে। জেলা প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও দারুণভাবে উৎসাহ দেন।
বিজয়ীর মুকুট পড়ে মেয়েরা ঢাকা বিভাগীয় চ্যাম্পিয়ন হবার পরম গৌরব অর্জনের পর তাদের দেয়া হয় রাজসিক সংবর্ধনা। আর এতেই মেয়েদের উৎসাহ আরো বেড়ে যায়। ২০১২ সালে অনুর্ধ্ব-১৪ দলে এ বিদ্যালয়েরই দু’নারী ফুটবলার মার্জিয়া ও তাসলিমা শ্রীলংকায় অনুষ্ঠিত এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশন (এএফসি) চ্যাম্পিয়নশিপ খেলতে যায়।
মার্জিয়া প্রথম গোল করে। ২০১৩ সালেও আমরা বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হই বলতে বলতে খানিকটা থামেন মিনতি। বলেন, জাতীয় পর্যায়ে প্রথমবারের মতো দেশসেরা হয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পুরস্কার নেয় মেয়েরা। এতে তাদের খুশির মাত্রা বাড়তে থাকে। ওই সময় স্থানীয় এলাকার বাসিন্দারা কয়েক বাস করে ঢাকা বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে গিয়েছিল।
কলসিন্দুরের মেয়েরা একদিন জাতীয় মহিলা ফুটবল টিমের হাল ধরবে মনে করেন অনুর্ধ্ব-১৪ জাতীয় দলের সেরা ১০ ফুটবলার তৈরির মূল কারিগর এ শিক্ষিকা। তিনি বলেন, আমি মনে করি এ ১০ জনের মধ্যে কমপক্ষে ৭ জন ফুটবলার মেধা ও যোগ্যতা দিয়েই জাতীয় মহিলা ফুটবল টিমে জায়গা করে নেবে।
তবে কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কলসিন্দুর উচ্চ বিদ্যালয়ের যে মাঠ থেকে খেলে মেয়েরা দেশের বাইরের মাঠেও সাফল্য পেয়েছেন সেই মাঠের সংস্কার না হওয়ায় আক্ষেপ ঝরে মিনতি রাণীর কণ্ঠে- এ মাঠে বর্ষাকালে পানি জমে থাকায় প্র্যাকটিস করা যায় না। অনেকবার দাবি জানালেও পানি নিস্কাশনের ব্যবস্থা হয়নি। ’
ধোবাউড়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) এম.এ.হক বলেন, কলসিন্দুরের মেয়েরা ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। এটা আমাদের জন্য অন্ত্যন্ত গর্বের।
বাংলাদেশ সময়: ০৫১২ ঘণ্টা, মে ০১, ২০১৫
এনএস/
** জাতীয় দলে এক গ্রামেরই ১০ কিশোরী!