কলসিন্দুর, ধোবাউড়া (ময়মনসিংহ) ঘুরে এসে: নতুন ইতিহাস রচনা থেকে মাত্র এক ম্যাচ দূরে। স্বাগতিক নেপালকে হারিয়ে দিলেই দক্ষিণ মধ্য এশিয়া অঞ্চলের এএফসি অনুর্ধ-১৪ চ্যাম্পিয়নশিপের সেরার মুকুট।
এই কম্পন মৃত্যুর মুখে দাঁড় করালো কিশোরী ফুটবলারদের। জীবন নিয়ে দেশে ফেরা হবে না কী হিমালয় কন্যার বুকেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন-এমন চরম বাস্তবতার মুখোমুখি। ভূমিকম্পের ভয়াবহতা জানার সীমাকেও ছাড়িয়ে গেলো। জীবন-মৃত্যুর দোলাচলের সেই দুর্বিষহ অভিজ্ঞতার কথা স্মৃতিতে ভেসে উঠতেই ফ্যাকাসে হয়ে উঠে কিশোরী ফুটবলারদের মুখ।
বৃহস্পতিবার সরেজমিন এসব নারী ফুটবলারদের ‘আঁতুর ঘর’ ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গেলে বাংলানিউজের কাছে নরকবাসের সেই মুহূর্তগুলোর টুকরো টুকরো স্মৃতি তুলে ধরেন ফাইনালে উঠেও না খেলে ফিরে আসা গোলাম রব্বানী ছোটনের শিষ্যরা।
এবারের অনুর্ধ্ব-১৪ চ্যাম্পিয়নশিপে মারিয়া মান্দার পা ছুঁয়ে আসে ৪ গোল। গোটা টুর্নামেন্টে দুর্দান্ত খেলা এ মিড ফিল্ডার দফায় দফায় ঘটে যাওয়া ভয়াবহ সেই ভূকম্পনের সাক্ষী। ওই দিনের দুর্বিষহ ঘটনার স্মৃতি মনে করতেই এখনো শিউরে উঠেন।
নিজেকে স্বাভাবিক করে বলেন, আমরা ৮ তলা হোটেলের ৫ম তলায় ছিলাম। আমাদের খেলার মিটিং চলছিল। ফাইনালের আগেভাগে কোচ ছোটন স্যার আমাদের নেপালকে হারানোর কলাকৌশল দেখিয়ে দিচ্ছিলেন। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে দেখি চেয়ার-টেবিল নড়তাছে। প্রথমে মনে হয়েছিল জানালা দিয়া বাতাস আইতাছে।
কিন্তু পরে নিচের দিকে তাকাইয়া দেখি দোলনার মতো ঘর দুলতাছে। তখনই বুঝতে পারি ভূমিকম্প। আগে যখন রুমের ভেতর সবাই একসঙ্গে থাকতাম তখন দরজা লক অইতো না। অথচ ভূমিকম্পের দিন লক অইয়া গেলো। বলতে বলতে ভারী হয়ে উঠে মারিয়ার কন্ঠ।
এরপর বলতে থাকেন, অনেক কষ্টে দরজা খুইল্ল্যা খোলা আকাশের নিচে চইল্লা যাই। আমরা এক রাত হোটেলের নিচে ছিলাম। সেইদিন ১০ মিনিট পর পর ভূমিকম্প অইছে। ওইদিন ৬০ থেকে ৭০ বার ভূকম্পন হয়। বার বার ওই সময় মনে হইছে অন্তত যেন দেশে ফিরতে পারি। মা-বাবার মুখটা বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। রাতে আমরা সবাই কেঁদেছি।
মারিয়া মান্দার সঙ্গে আলাপচারিতার সময় খানিকটা দূরে চেয়ার পেতে বসেছিলেন কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা ও প্রমিলা ফুটবলারদের সাফল্যের নেপথ্য রূপকার মিনতি রাণী শীল। দলের তারকা খেলোয়াড় সানজিদাকে নিয়ে এসে তাকে বিপদসংকুল সেই ঘটনার আদ্যোপান্ত বলতে বললেন।
শিক্ষিকার মুখে অভিজ্ঞতা বর্ণনার নির্দেশনা পেয়ে সানজিদার মুখের উচ্ছ্বলতা যেন নিমিষেই উবে যায়। শিহরণ নিয়ে বললেন, হোটেলের পঞ্চম তলায় আমরা সবাই গোল হয়ে বসেছিলাম। হঠাৎ দেখি প্রজেক্টর বন্ধ। আমরা চেয়ারে দুলছি। থাইগ্লাস ঝুরঝুর হয়ে ভেঙে পড়ছে। নামতে গিয়ে সিঁড়ির কাছে গিয়ে দেখি কাগজের মতো বিল্ডিং দুলছে।
ভয়ে হোটেলের সবাই নেমে গেছে। শুধু বাংলাদেশ টিমের আমরাই রয়ে গেছি। ভয়ে সবাই চিল্লাচিল্লি করছে। ছোটন স্যার ও দুই ম্যাডাম কান্নাকাটি করছে। প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর হাতছানি। ৪ থেকে ৫ মিনিট পর সিঁড়ি দিয়া তাড়াতাড়ি নিচে নামছি। পরে ওই হোটেলের পাশে খোলা মাঠে গিয়ে বসি।
তখন আমাদের ওরা কম্বল দেয়। মাঠও কাঁপছিল। কম্বল মুড়িয়ে সারাদিন সেখানেই বসে ছিলাম। বাবা-মা আর কাছের স্বজনদের জন্য মনের ভেতরটা পুড়ছে। মনে হইতাছিল আর বাঁচতাম না। বাংলাদেশে ফেরার মতো ভরসাও পাচ্ছিলাম না- বলেন সানজিদা।
অক্ষত অবস্থায় মৃত্যুপুরী থেকে ফেরা স্বপ্নবাজ কিশোরী ফুটবলার, চলতি এএফসি অনুর্ধ্ব-১৪ রিজিওন্যাল চ্যাম্পিয়নশিপে ৩ ম্যাচে ৪ গোল করা মার্জিয়া আক্তার। বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতা স্মরণ করে এ ফুটবলার বলেন, ১৫ থেকে ২০ মিনিট পর পর ভূমিকম্প হইতো। রাতের বেলায় যখন ভূমিকম্প হইতো তখন হোটেলের নিচের ফ্লোর থেকে রাস্তায় আসতাম।
আবার ভূকম্পন থামলে হোটেলের নিচের গ্রাউন্ড ফ্লোরে গিয়া ঘুমাইতাম। সারা রাত দৌড়াদৌড়ি করছি। ঘুমের মধ্যে দৌড় দিয়া পইড়া গিয়া হাতে ব্যাথা পাইছি। এমন ভয়াবহ ভূমিকম্প কখনো দেখি নাই। বার বার মনে পড়ছে, আর দেশে ফেরা হইবো না।
নেপালের সঙ্গে ফাইনাল খেলা হয়নি। কাঙ্খিত স্বপ্নও পূরণ হয়নি। সেই কষ্ট কিশোরী ফুটবলারদের কাঁদালেও জীবন নিয়ে মা-বাবার কোলে ওরা ফিরতে পেরেছে এটাই সবচেয়ে বড় কথা’ বলেন কিশোরী ফুটবলারদের প্রথম কোচ সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. মফিজ উদ্দিন।
আর কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মিনতি রাণী শীল বলেন, এখন যেখানেই এ টুর্নামেন্টের ফাইনাল অনুষ্ঠিত হোক, আমাদের মেয়েরা নেপালকে বধ করবেই। শিক্ষিকার মুখে এমন আশাবাদী উচ্চারণের পর কিশোরী ফুটবলাররা সমস্বরে বলে উঠেন ‘আমরা পারবোই। ’
** ‘কলসিন্দুরের মেয়েরাই জাতীয় টিমের হাল ধরবে’
** জাতীয় দলে এক গ্রামেরই ১০ কিশোরী!
বাংলাদেশ সময়: ১০২২ ঘণ্টা, মে ২, ২০১৫
আরএ/জেডএম