ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৪ শ্রাবণ ১৪৩২, ২৯ জুলাই ২০২৫, ০৩ সফর ১৪৪৭

অন্যান্য

লোটাসকাণ্ড : দুর্নীতির পদ্ম—তৃতীয় পর্ব

জনশক্তিতে লোটাস পরিবারের প্রতারণা

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮:৩৬, জুলাই ২, ২০২৫
জনশক্তিতে লোটাস পরিবারের প্রতারণা

দেশের অর্থনীতি পঙ্গু করে দেশে-বিদেশে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ওরফে লোটাস কামাল। মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানির নামে এক হাজার ১২৮ কোটি ৬১ লাখ ৫০ হাজার টাকা লোপাট ও পাচারের হোতা লোটাস কামাল।

এ ছাড়া তিনি পরিবারের সদস্যদের যোগসাজশে এক হাজার ১৫ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও মানি লন্ডারিংও (অর্থ হস্তান্তর, রূপান্তর, স্থানান্তর) করেছেন।

জানা যায়, জনশক্তি রপ্তানি বা আদম ব্যবসা হলো লোটাস কামালের প্রথম ব্যবসা।

এ ব্যবসার মাধ্যমে মানুষকে প্রলোভন দেখিয়ে, প্রতারণার ফাঁদে ফেলে হাতিয়ে নেওয়া হয় লাখ লাখ টাকা। বহু মানুষ কামালের প্রতারণার ফাঁদে নিঃস্ব হয়েছেন। পরবর্তীতে নানা ব্যবসায় জড়ালেও আদম ব্যবসা ছাড়েননি লোটাস কামাল। বরং এই ব্যবসায় যুক্ত করেন স্ত্রী এবং দুই মেয়েকে।

লোটাস কামালের রাজনৈতিক উত্থানের পর তাঁর স্ত্রী এই ব্যবসার হাল ধরেন। এতে অব্যাহত থাকে পারিবারিক প্রতারণার ব্যবসা।

মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানির নামে মোট এক হাজার ১২৮ কোটি ৬১ লাখ ৫০ হাজার টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে সাবেক অর্থমন্ত্রী লোটাস কামালসহ ১২ এজেন্সির মালিকের বিরুদ্ধে পৃথক ১২টি মামলা করে দুদক। গত ১১ মার্চ দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে (ঢাকা-১) মামলাগুলো করা হয়েছে।

মামলার এজাহারে বলা হয়, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে অপরাধজনক বিশ্বাস ভঙ্গের মাধ্যমে অসৎ উদ্দেশ্যে সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার করে বায়রার বিভিন্ন পদে থাকার সময় সিন্ডিকেট করে সরকারের নির্ধারিত টাকার চেয়ে পাঁচ গুণ অতিরিক্ত টাকা গ্রহণ করেছেন। আসামিরা শ্রমিকদের অবৈধভাবে ক্ষতিসাধন করেছেন। শ্রমিকদের কাছ থেকে পাসপোর্ট, স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং প্রতি কর্মীর নির্ধারিত ফির অতিরিক্ত অর্থ গ্রহণপূর্বক আত্মসাৎ করেছেন। এসব সিন্ডিকেটের হোতা ছিলেন লোটাস কামাল। অর্থমন্ত্রী থাকাকালে তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করে পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতায় এই সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন।

প্রথম মামলায় আসামি করা হয়েছে অরবিটাল এন্টারপ্রাইজের মালিক সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এবং তাঁর স্ত্রী কাশমেরি কামালকে। মামলায় ১০০ কোটি ৯৮ লাখ ৫৭ হাজার টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগ আনা হয়েছে। দ্বিতীয় মামলায়ও মুস্তফা কামাল এবং তাঁর স্ত্রীকে আসামি করা হয়েছে। মামলায় ৫০ কোটি ১৬ লাখ ৬২ হাজার ৫০০ টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগ আনা হয়েছে। তৃতীয় মামলায় ১১ কোটি ৫০ লাখ ৪৭ হাজার ৫০০ টাকা, চতুর্থ মামলায় ৯১ কোটি ৪২ লাখ ১৫ হাজার টাকা, পঞ্চম মামলায় ১১৯ কোটি ৩২ লাখ ৭০ হাজার টাকা, সপ্তম মামলায় ১৩০ কোটি ৪৩ লাখ ২২ হাজার ৫০০ টাকা, অষ্টম মামলায় ১৪৩ কোটি ৯১ লাখ ৬০ হাজার টাকা, নবম মামলায় ১৩৫ কোটি ৫৫ লাখ ৭৭ হাজার ৫০০ টাকা, দশম মামলায় ৭০ কোটি ৬০ লাখ ১২ হাজার ৫০০ টাকা, একাদশতম মামলায় ৪৭ কোটি ৬৫ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ টাকা এবং দ্বাদশতম মামলায় ৬৩ কোটি ৫৯ লাখ ৯৭ হাজার ৫০০ টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগ আনা হয়েছে।

প্রথম মামলায় লোটাস কামালের বিরুদ্ধে পাবলিক সার্ভেন্ট হিসেবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত উৎসর সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ ২৭ কোটি ৫২ লাখ ৫৪ হাজার ৮৩১ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং তা ভোগদখলের অভিযোগ আনা হয়েছে। একই সঙ্গে তাঁর নিজ ও ব্যাবসায়িক ৩২টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ৪৪৬ কোটি ৪২ লাখ ৫৩ হাজার ৭৮৮ টাকার সন্দেহজনক লেনদেনের অভিযোগ আনা হয়েছে।

দ্বিতীয় মামলায় লোটাস কামালের স্ত্রী কাশমেরি কামালের বিরুদ্ধে স্বামীর যোগসাজশে ৪৪ কোটি ১১ লাখ ৬২ হাজার ১৪৬ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং ২০টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ২৬ কোটি ৬৪ লাখ এক হাজার ১৩৩ টাকার সন্দেহজনক লেনদেনের অভিযোগ আনা হয়েছে। মামলায় লোটাস কামালকে সহযোগী আসামি করা হয়েছে।

তৃতীয় মামলায় লোটাস কামালের মেয়ে কাশফি কামালের বিরুদ্ধে পিতার যোগসাজশে ৩১ কোটি ৭৮ লাখ ৮৩ হাজার ১৯৫ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং ৩৮টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ১৭৭ কোটি ৪৮ লাখ ২৩ হাজার ৫৪৮ টাকার সন্দেহজনক লেনদেনের অভিযোগ আনা হয়েছে। এ মামলায়ও লোটাস কামালকে সহযোগী আসামি করা হয়েছে।

চতুর্থ মামলায় লোটাস কামালের অন্য মেয়ে নাফিসা কামালের বিরুদ্ধে পিতার যোগসাজশে ৬২ কোটি ১৪ লাখ ৭৭ হাজার ৫১৬ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং ১৭টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ১৯৯ কোটি ২৩ লাখ ৪০ হাজার ৫৪৭ টাকার সন্দেহজনক লেনদেনের অভিযোগ আনা হয়েছে। এ মামলায়ও সহযোগী আসামি করা হয়েছে লোটাস কামালকে।

প্রসঙ্গত, গত ২৩ অক্টোবর লোটাস কামালের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে অনুসন্ধানে নামে দুদক।

সংস্থাটির মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন বলেন, ৬৭ হাজার ৩৮০ জনের কাছ থেকে সরকার নির্ধারিত ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকার পরিবর্তে পাঁচ গুণ বেশি অর্থ আদায় করে তাঁরা বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করেছেন।

এর মধ্যে মেসার্স অরবিটাল এন্টারপ্রাইজের মাধ্যমে ছয় হাজার ২৯ জন প্রবাসীর কাছ থেকে অতিরিক্ত ১০০ কোটি ৯৮ লাখ ৫৭ হাজার ৫০০ টাকা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। অরবিটাল এন্টারপ্রাইজের মালিক আ হ ম মুস্তফা কামালের স্ত্রী কাশমেরি কামাল। মামলায় কাশমেরির পাশাপাশি স্বামী মুস্তফা কামালকেও আসামি করা হয়েছে।

এ ছাড়া মুস্তফা কামালের মেয়ে নাফিসা কামালের কম্পানি মেসার্স অরবিটাল ইন্টারন্যাশনালের মাধ্যমে দুই হাজার ৯৯৫ জনের কাছ থেকে অতিরিক্ত ৫০ কোটি ১৬ লাখ ৬২ হাজার টাকা গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে দুদকে। মেয়ের সঙ্গে বাবাকেও মামলায় আসামি করার কথা বলছে দুদক।

অভিযোগে দুদক আরো বলছে, মালয়েশিয়াগামী প্রত্যেকের কাছ থেকে অতিরিক্ত এক লাখ ৬৭ হাজার ৫০০ টাকা করে নেওয়ার হিসাব ধরা হয়েছে।

বিভিন্ন অনিয়ম ও সিন্ডিকেটের কারণে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি নেওয়া বন্ধ করেছিল মালয়েশিয়া। ২০২১ সালের ১৯ ডিসেম্বর ফের বাংলাদেশের সঙ্গে শ্রমিক নেওয়ার চুক্তি করে দেশটি। তখন শ্রমিক ভিসায় দেশটিতে যেতে সর্বোচ্চ ৭৮ হাজার ৫৪০ টাকা ফি নির্ধারণ করে সরকার। ২০২২ সালে এক অফিস আদেশে এ খরচ নির্ধারণ করেছিল প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।

বাংলাদেশের সঙ্গে মালয়েশিয়া সরকারের চুক্তির আওতায় ২০১৬ সাল পর্যন্ত ১০টি নির্ধারিত রিক্রুটিং এজেন্সি দেশটিতে শ্রমিক পাঠাত। তবে ২০২১ সালে নতুন একটি সমঝোতা স্মারকে সই করে দুই দেশ। ওই সমঝোতায় রিক্রুটিং এজেন্সির সংখ্যা বাড়িয়ে ১০০ করা হয়। কিন্তু সেখানেও তৈরি হয় নতুন সিন্ডিকেট। ১০০ এজেন্সির মধ্যে ২০ থেকে ২৫টি এজেন্সির সিন্ডিকেটই নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর পুরো প্রক্রিয়া, যার নেতৃত্বে ছিলেন আ হ ম মুস্তফা কামাল।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, অরবিটাল ইন্টারন্যাশনাল মালয়েশিয়ায় একটি নিবন্ধিত কম্পানি। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক ও জনবল সরবরাহের জন্য কাজ করে প্রতিষ্ঠানটি। মালয়েশিয়ায় এই কম্পানির চেয়ারম্যান হিসেবে দেখানো হয়েছে কাশমেরি কামালকে। তবে এখানে বাংলাদেশের ঠিকানা ব্যবহার করা হয়নি। সংযুক্ত আরব আমিরাতের ঠিকানা ও বিনিয়োগ দেখিয়ে এই কম্পানি খোলা হয়েছে। বাংলাদেশে মামলা হলেও মালয়েশিয়ায় বহাল তবিয়তে কাজ করছে এই প্রতিষ্ঠান।

জেএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।