ঢাকা, বুধবার, ২ আশ্বিন ১৪৩২, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২৪ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

অন্যান্য

খাদ্য মূল্যস্ফীতি, দারিদ্র্য ও বৈষম্য

ড. জাহাঙ্গীর আলম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮:৩৭, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২৫
খাদ্য মূল্যস্ফীতি, দারিদ্র্য ও বৈষম্য

বাংলাদেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার খুবই ধীরগতিতে কমছে। কখনো দুই মাস কমে তো পরের দুই মাস বাড়ে।

২০২৪ সালের জুলাই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ছিল সর্বাধিক ১৪.১০ শতাংশ। এরপর তা হ্রাস পায়।

নভেম্বরে তা আবার বেড়ে গিয়ে ১৩.৮ শতাংশে দাঁড়ায়। এরপর পুনরায় তা হ্রাস পেতে থাকে। গত জুন মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৭.৩৯ শতাংশ। জুলাই মাসে  চাল ও শাক-সবজির দাম বাড়ার কারণে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কিছুটা বেড়ে ৭.৫৬ শতাংশে দাঁড়ায়।

আগস্ট মাসে তা আরো বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৭.৬০ শতাংশে। তাতে নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পায়। তাদের কষ্ট বেড়ে যায়। খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার বিবেচনায় ২০২১ সালের জুন থেকে বিশ্বব্যাংকের লাল তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান।

যেসব দেশের  খাদ্যপণ্যের দাম প্রতি মাসে গড়ে ৫ থেকে ৩০ শতাংশের মধ্যে বৃদ্ধি পায়, তাদের লাল তালিকাভুক্ত করে বিশ্বব্যাংক। অন্যদিকে যেসব দেশের খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার প্রতি মাসে গড়ে ২ শতাংশের কম বাড়ে, ওইসব দেশকে সবুজ তালিকায় রাখা হয়। তাদের কোনো ঝুঁকি নেই। যেসব দেশের প্রতি মাসে গড় মূল্যস্ফীতির হার ২ থেকে ৫ শতাংশের মধ্যে থাকে তারা হলুদ তালিকাভুক্ত। অর্থাৎ তারা ঝুঁকির দিকে যাচ্ছে।

যাদের  খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার প্রতি মাসে  গড়ে ৩০ শতাংশের বেশি, তারা পিঙ্গল বর্ণের তালিকার অন্তর্ভুক্ত। তারা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তাদের বেশি কমিশন গুনতে হয়। বৈদেশিক ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রেও তাদের দিতে হয় বাড়তি গ্যারান্টি ফি। ২০২১ সালের মে মাসে বাংলাদেশের খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৪.৮৭ শতাংশ। এর পর থেকে এ  হার ক্রমাগতভাবে ৫ শতাংশের ওপরে রয়েছে। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। অতি সম্প্রতি চাল, পেঁয়াজ, ডিম, মাছ ও শাক-সবজির দাম বাড়ার কারণে খাদ্য মূল্যস্ফীতির  হার বাড়ছে। আগামী নভেম্বর পর্যন্ত তা হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা কম। অর্থাৎ বিশ্বব্যাংকের লাল তালিকা থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন।
খাদ্য মূল্যস্ফীতি, দারিদ্র্য ও বৈষম্যখাদ্য মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির কারণে মানুষের দারিদ্র্য বৃদ্ধি পায়। আর্থিক অনটন নিম্ন আয়ের মানুষের পেরেশানি ও দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে দেয়। তারা অপুষ্টিতে ভোগে ও রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে। সাধারণভাবে পারিবারিক গড় ব্যয়ের প্রায় ৫৫ শতাংশ অর্থই খরচ হয় খাদ্য কেনার জন্য। নিম্ন আয়ের পরিবারের ক্ষেত্রে এর হার প্রায় ৬৫ শতাংশ। অর্থাৎ খাদ্য মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির কারণে সরাসরি বেড়ে যায় নিরঙ্কুশ দারিদ্র্য। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বিভাগ থেকে প্রকাশিত হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে (এইচআইইএস) ২০২২-এর তথ্য অনুসারে দেশে নিরঙ্কুশ দারিদ্র্যের হার ১৮.৭ শতাংশ। গ্রামে এই হার ২০.৫ শতাংশ, শহরে ১৪.৭ শতাংশ। ২০০০ সালে ছিল ৪৮.৯ শতাংশ। গ্রামে ৫২.৩ শতাংশ এবং শহরে ৩৪.৩ শতাংশ। মানুষের মৌলিক প্রয়োজন  যেমন খাদ্য, চিকিৎসা, বাসস্থান ইত্যাদির খরচ মেটানোর ভিত্তিতে জনপ্রতি মাসিক আয় ৩,৮৩২ টাকায় নির্ধারণ করা হয়েছিল ২০২২ সালের দারিদ্র্যসীমা। এতে আমলে নেওয়া হয়েছিল খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত মৌলিক প্রয়োজনসমূহ মেটানোর জন্য ন্যূনতম খরচ। তাতে সমীক্ষার অন্তর্গত ওই বছর দারিদ্র্যসীমা হ্রাসের একটি ধারাবাহিক চিত্র পাওয়া যায়। চরম দারিদ্র্য গণনায়ও একই পরিচ্ছন্ন চিত্র ফুটে ওঠে। সাধারণ দারিদ্র্র্যসীমার মধ্যে শুধু খাদ্য দারিদ্র্যসীমার কাছাকাছি নির্ধারণ করা হয় চরম দারিদ্র্যসীমা। ওই সীমারেখা (২,৭৫৫ টাকা) অনুযায়ী ২০২২ সালে চরম দারিদ্র্যের হার কমে দাঁড়ায় ৩.৫ শতাংশে, ২০০০ সালে  সে হার ছিল  ৩৪.৩ শতাংশ। গ্রামের চরম দারিদ্র্যের হার হ্রাস পায় ৩২.৫ থেকে ৬.৫ শতাংশে এবং শহরে ১৩.৭ থেকে ৩.৮ শতাংশে।  সম্প্রতি ওই ক্রমহ্রাসের প্রবণতায় ছেদ পড়েছে। বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক হিসাব থেকে ধারণা করা যায় যে দারিদ্র্যের হার বর্তমানে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর প্রধান কারণ খাদ্য মূল্যস্ফীতি। বিশ্বব্যাংকের হিসাব মতে, ২০২৫ সালে নিরঙ্কুশ দারিদ্র্যের হার ২২.৯ শতাংশে এবং চরম দারিদ্র্যের হার ৯.৩ শতাংশে বৃদ্ধি পাবে। বিশ্বব্যাংক বর্তমানে জনপ্রতি দৈনিক ৩.৬৫ ডলার আয়কে দারিদ্র্যসীমা হিসেবে চিহ্নিত করে থাকে। চরম দারিদ্র্য সীমা হলো ২.১৫ ডলার।

বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার বৃদ্ধির অতি সাম্প্রতিক তথ্য পাওয়া যায় ‘পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার’ (পিপিআরসি) পরিচালিত সমীক্ষা থেকে। তাতে প্রতীয়মান হয় যে দেশে বর্তমানে প্রতিবছর প্রায় ৩ শতাংশ হারে দারিদ্র্য বাড়ছে। গত তিন বছরে দেশে মোট দারিদ্র্যের হার বেড়েছে ১০ শতাংশ। ২০২২ সালে নিরঙ্কুশ দারিদ্র্যের হার যেখানে ছিল ১৮.৭ শতাংশ, চলতি বছর অর্থাৎ ২০২৫ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ২৭.৯৩ শতাংশে। একই সঙ্গে  অতিদারিদ্র্যের হার ৫.৬ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়েছে ৯.৩৫ শতাংশে। তা ছাড়া দেশের প্রায় ১৮ শতাংশ পরিবার দারিদ্র্যসীমার খুবই কাছাকাছি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। তারা যেকোনো সময় আয়ের পরিমাণ হারিয়ে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যেতে পারে। সাম্প্রতিক দারিদ্র্য হারে এই অবনতির জন্য চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি তথা দীর্ঘস্থায়ী খাদ্য মূল্যস্ফীতি প্রধানত দায়ী। এর সঙ্গে আছে করোনা মহামারির অভিঘাত এবং কর্মসংস্থানের তীব্র অভাব। গত এক বছরে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দারুণ খরা যাচ্ছে। তাতে নতুন উদ্যোগ স্তিমিত, হ্রাস পেয়েছে কর্মসংস্থান। মানুষের আয়ের প্রবৃদ্ধির হার অবদমিত হয়েছে।  

দারিদ্র্যের আর একটি রূপ আপেক্ষিক দারিদ্র্য। প্রচলিত অর্থে আয়বৈষম্য। সহজ কথায় ধনী-দরিদ্রের মধ্যে অসমতা। এটি পরিমাপের জন্য সাধারণত গিনি সূচক ব্যবহার করা হয়। এর মান শূন্য থেকে ১ এর মধ্যে থাকে। শূন্য (০) মানে সবার আয় সমান, নিখুঁত সমতা। ১ মানে সর্বোচ্চ অসমতা, একজন ব্যক্তির হাতে সব আয় পুঞ্জীভূত। সূচকের মান ০.৩ এর নিচে হলে নিম্ন মাত্রার অসমতা বোঝায়। এর মান ০.৫ এর নিচে হলে মাঝারি মাত্রার বৈষম্য বোঝায়। যখন তা ০.৫ অতিক্রম করে তখন উচ্চ মাত্রার অসমতা ধরে নেওয়া হয়। বাংলাদেশে এখন আয়বৈষম প্রকট। ২০১৬ সালে গিনি সূচকে আয়বৈষম্যের পরিমাণ ছিল ০.৪৮। গ্রামে ০.৪৫ এবং শহরে ০.৫। ২০২২ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে জাতীয়ভাবে ০.৫-এ উপনীত হয়। গ্রামে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ০.৪৫ এবং শহরে ০.৫৪। গত তিন বছরে এর মাত্রা বেড়েছে। তার একটি প্রতিফলন রয়েছে পিপিআরসির সমীক্ষা প্রতিবেদন। তাতে দেখা যায়, ২০২২ সালে যেখানে খরচের বৈষম্য ছিল গিনি সূচকে ০.৩৩৪, সেখানে ২০২৫ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ০.৪৩৬। পারিবারিক খরচ আয়ের ওপর নির্ভরশীল। তাই খরচের বৈষম্য বৃদ্ধি আয়বৈষম্য বৃদ্ধিরই নামান্তর।

আয়বৈষম্যের উদ্ভব ঘটে প্রধানত সম্পদের বৈষম্য থেকে। বাংলাদেশে সম্পদের মালিকানা অতিমাত্রায় পুঞ্জীভূত। সময়ের ব্যবধানে তা ঘনীভূত হচ্ছে। ২০১৬ সালে জাতীয়ভাবে সম্পদের পুঞ্জীভূত মাত্রা ছিল ০.৮২ গিনি সূচক। গ্রামে এর মাত্রা ছিল ০.৭৫ এবং শহরে ০.৮৫। ২০২২ সালে তা বৃদ্ধি পেয়েছে ০.৮৪ গিনি সূচকে। গ্রামে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ০.৮১ এবং শহরে কিছুটা কমে হয়েছে ০.৮৪। শিক্ষার অসমতা, লিঙ্গ অসমতা, দুর্বৃত্তায়ন, আর্থিক কর্মকাণ্ডে অভিগম্যতার অসমতা এবং আয়ের অসমতা সম্পদের অসমতাকে ত্বরান্বিত করে।

সম্পদের পুঞ্জীভবন ও আয়ের অসমতা দারিদ্র্যের মাত্রা বাড়ায়। দীর্ঘমেয়াদি খাদ্য মূল্যস্ফীতিও দারিদ্র্য বাড়ায়। তাতে মানুষের দুর্ভোগ বাড়ে। সমাজে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। এ চক্র থেকে উত্তরণ প্রয়োজন। খাদ্য মূল্যস্ফীতি হ্রাস করতে হলে সবার আগে কৃষির উৎপাদন বাড়াতে হবে এবং তা স্থিতিশীল রাখতে হবে। ঘাটতির সময় দ্রুত খাদ্যপণ্য আমদানি করতে হবে। যথাযথভাবে মুদ্রা ও রাজস্বনীতি বাস্তবায়ন করতে হবে। অন্যদিকে আয়বৈষম্য হ্রাস করার জন্য দরকার অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন ও অর্থায়ন। দুর্বৃত্তায়ন প্রশমন ও প্রগতিশীল হারে আয়কর আদায়ের বিধান বাস্তবায়ন করতে হবে। গরিব পরিবারের মাঝে আয় স্থানান্তরের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে হবে। লিঙ্গ, ধর্ম, বর্ণ ও গোষ্ঠী ভিত্তিক অসমতা দূর করতে হবে। কর্মক্ষেত্রে সবার জন্য সমান সুযোগ সম্প্রসারিত করতে হবে। সৎ ব্যবসা ও বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে হবে। তাতে মানুষের আয় বৃদ্ধির সঙ্গে বৈষম্য হ্রাস পাবে। কমে আসবে সম্পদের অসমতা।

লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ

এনডি
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।