ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৩ আশ্বিন ১৪৩২, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

অন্যান্য

মাদক মাফিয়ার দৌরাত্ম্য বাড়ছে

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮:৪৩, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২৫
মাদক মাফিয়ার দৌরাত্ম্য বাড়ছে ছবি: সংগৃহীত

দেশে মারণনেশা ইয়াবার পর নতুন নতুন মাদকদ্রব্য ছড়িয়ে পড়ছে। মাদক ব্যবসায় বাড়ছে মাফিয়ার দৌরাত্ম্য।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি) সূত্র বলছে, মাদক মাফিয়ারা এই সর্বনাশা ব্যবসায় তরুণ শিক্ষার্থীদের বেছে নিচ্ছে।
নতুন মাদকদ্রব্যগুলোর মধ্যে একটি হলো ‘এমডিএমএ’, যা ‘মেথালাইন ডি-অক্সি মেথ-অ্যাম্ফিটামিন’।

সম্প্রতি এই নতুন মাদক বেচাকেনায় জড়িত থাকার অভিযোগে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়ার কথা জানিয়েছে ডিএনসি।

ডিএনসি সূত্র বলছে, তাদের কাছে ৮৫ জন গডফাদারসহ এক হাজার ২৩০ জন মাদক কারবারির পুরনো তালিকা রয়েছে। তালিকাটি হালনাগাদ করার নির্দেশ দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তবে গতকাল বুধবার পর্যন্ত সেই তালিকা হালনাগাদ করা হয়নি।

শীর্ষ মাদক গডফাদারদের বেশির ভাগ এখনো অধরা।
ডিএনসির ভাষ্য, মাদক কারবারিচক্র তাদের ব্যবসায় বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করছে। স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনা থেকে শুরু করে সারা দেশের অলিগলিতে এখন হাত বাড়ালেই মাদকদ্রব্য মিলছে। গ্রামাঞ্চলেও এখন সহজলভ্য মাদক।

অনলাইনে চলছে মাদকের রমরমা ব্যবসা। ক্রমাগত মাদকের চাহিদা বাড়ায় প্রতিবছর দেশ থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি পাচার হয়ে যাচ্ছে।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থার (মানস) প্রধান ডা. অরূপ রতন চৌধুরী বলেন, ‘দেশে বর্তমানে প্রায় দেড় কোটি মাদকসেবী রয়েছে। ’

অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, শিক্ষার্থীদের একটা অংশ শুধু মাদক সেবনই নয়, মাদক বেচাকেনায়ও জড়িয়ে পড়ছে। এসব শিক্ষার্থীকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে আরো তৎপর হতে হবে।

সাম্প্রতিক অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যের উদ্ধৃতি দিয়ে ডিএনসি ও অন্যান্য গোয়েন্দা সূত্র বলছে, তরুণসমাজের অনেকে মাদককে আড্ডার প্রধান উপকরণ হিসেবে বেছে নিচ্ছে। এই চক্রের সহস্রাধিক সদস্য সম্পর্কে তথ্য পেয়ে যাচাই করা হচ্ছে।

তারা একটি আন্তর্জাতিক মাদক বাণিজ্যের অংশ জানিয়ে একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, ‘এই চক্রের সদস্যরা দেশে মাদকের বড় বাজার তৈরির চেষ্টা করছে। এর মধ্যে তারা হেরোইন, আইস, কুশসহ কয়েকটি মাদকে তরুণসমাজের একটি অংশকে আসক্ত করতে পেরেছে। এখন মাদক কেনাবেচায় তারা বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করতে শুরু করেছে। ’

ডিএনসির মহাপরিচালক মো. হাসান মারুফ বলেন, ‘সম্প্রতি গ্রেপ্তার হওয়া বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার আড়ালে একটি সংঘবদ্ধ মাদকচক্রের সদস্য। এরা মাদক বাণিজ্যে সম্পৃক্ত ছিল। আরো অনেক শিক্ষার্থীও থাকতে পারে। চক্রটি ঢাকায় ডিজে পার্টিসহ বিভিন্ন অভিজাত এলাকায় মাদক সরবরাহ করে। ’

সম্প্রতি যুক্তরাজ্য থেকে ডাকযোগে আসা এমডিএমএর একটি চালানসহ এই চক্রের একজনকে প্রথমে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাঁর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অন্য চারজনকেও গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের কাছ থেকে ৩১৭টি এমডিএমএ বড়িসহ গাঁজা ও কিটামিন উদ্ধার করা হয়।

গত মঙ্গলবার সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, মাদক বর্তমানে সমাজের বড় সমস্যার একটি। সীমান্ত হয়ে দেশে মাদক ঢুকছে। মাদক নিয়ে ধরা পড়া কারবারির সংখ্যা বাড়ছে। এতে বোঝা যাচ্ছে, মাদক আসছে বেশি, ধরাও পড়ছে।
ডিএনসি সূত্র বলছে, মাদকের ট্রানজিট হিসেবে বাংলাদেশকে ব্যবহার করছে আন্তর্জাতিক মাফিয়াচক্র। গত এক মাসের মধ্যে নতুন মাদক এমডিএমএ, কিটামিনসহ কোকেনের চালান ধরা পড়ে। এতে জড়িত থাকার অভিযোগে বিদেশি নারী মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করা হয়। দেশে প্রতিদিন ৫০ লাখের বেশি ইয়াবা ঢুকছে।

উদ্ধার করা মাদকের মধ্যে কিটামিনের ভয়াবহতা সম্পর্কে ডিএনসি বলছে, কিটামিন মূলত একটি ‘ডিসোসিয়েটিভ অ্যানেসথেটিক’ ওষুধ, যা চিকিৎসক্ষেত্রে অপারেশনের সময় অজ্ঞান করার জন্য ব্যবহৃত হতো। বর্তমানে মাদক হিসেবে ব্যাপকভাবে এর অপব্যবহার বাড়ছে।

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, প্রতিবছর মাদকদ্রব্য উদ্ধারের তালিকায় ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদকদ্রব্য বাড়ছেই। মিয়ানমার থেকে দিনে গড়ে ৫৪ হাজার ৮৮৪ পিস ইয়াবার চালান কক্সবাজারের সীমান্তপথে বাংলাদেশে ঢুকছে। এ ছাড়াও ঢুকছে ক্রিস্টাল মেথ (আইস), হেরোইন, কোকেন, গাঁজা, আফিম, বিদেশি মদ, ফেনসিডিলসহ আরো নানা মাদক।

কিটামিন নিয়ে চক্রের নতুন কৌশল : ডিএনসি বলছে, গত ৭ সেপ্টেম্বর টঙ্গী এলাকা থেকে কিটামিনসহ আন্তর্জাতিক চক্রের দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এ বিষয়ে ডিএনসির মহাপরিচালক হাসান মারুফ বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই আন্তর্জাতিক মাদকচক্র কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবহার করে পাচার কার্যক্রম চালাচ্ছে। এ বিষয়ে গোয়েন্দা নজরদারির অংশ হিসেবে টঙ্গীর একটি কুরিয়ার সার্ভিসে অভিযান চালিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় ঢাকা থেকে ইতালিগামী একটি পার্সেল জব্দ করা হয়। পরে তোয়ালের ভেতর থেকে দ্রবীভূত অবস্থায় ৬.৪৪ কেজি কিটামিন শনাক্ত করা হয়। জব্দকৃত পার্সেল প্রেরকের ঠিকানা, সিসিটিভি ফুটেজ ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে প্রথমে চাঁদপুরের মতলব উত্তর এলাকা থেকে প্রেরক মো. মাসুদুর রহমান জিলানীকে গ্রেপ্তার করা হয়।

নতুন মাদক কেনাবেচায় জড়িত শিক্ষার্থীরা : সম্প্রতি এমডিএমএ বেচাকেনায় জড়িত থাকার অভিযোগে রাজধানীর কয়েকটি এলাকা থেকে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে ডিএনসি জানতে পেরেছে, গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সৈয়দ শাইয়ান আহমেদ ও আসিফ মাহবুব চৌধুরী রয়েছে। অন্য তিনজন হলো মো. জুবায়ের, জি এম প্রথিত সামস ও অপূর্ব রায়। এদের মধ্যে প্রথিত সামস ও অপূর্ব ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে পড়েছে। তারা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ডিএনসিকে বলেছে, আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে তারা মাদক কেনাবেচায় জড়িয়েছে।

জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের উদ্ধৃতি দিয়ে ডিএনসি কর্মকর্তারা বলেন, প্রথিত সামসের কাছে পার্সেল পৌঁছে দেওয়ার বিনিময়ে ৫০ হাজার টাকা পাওয়ার কথা জানিয়েছে জুবায়ের। এ জন্য অগ্রিম হিসেবে তিন দফায় ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকা পেয়েছে।
ডিএনসি সূত্র জানায়, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জুবায়ের জানায়, পার্সেলটি যুক্তরাজ্য থেকে অরণ্য নামের একজন ডাকযোগে পাঠিয়েছে। এটি পাঠানো হয় অরণ্যের বন্ধু অপূর্ব রায়ের নাম, ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, পার্সেলটি গ্রহণ করে অরণ্যের আরেক বন্ধু জি এম প্রথিত সামসের কাছে পৌঁছে দেওয়ার বিষয়টি ঠিক হয়।

এভাবে সম্প্রতি দেশে বেশ কয়েকটি মাদকের চালান জব্দ করার কথা জানিয়েছে ডিএনসি। গত ২৬ আগস্ট দিবাগত রাত ২টার দিকে কাতার এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসা আট কেজির বেশি কোকেনসহ এম এস ক্যারেন ‘পেটুলা স্টাফলি’ নামে গায়ানার নাগরিক এক নারীকে গ্রেপ্তার করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর।

গত ২৫ আগস্ট আদাবর থানাধীন বাইতুল আমান হাউজিং সোসাইটির একটি বাসা থেকে মো. খাইরুল ইসলাম ওরফে রিয়ান নামের একজনকে গ্রেপ্তার করে চার হাজার পিস অ্যাম্ফিটামিনযুক্ত ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়। তাঁর কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ‘অস্ট্রেলিয়া’ থেকে আসা কুশ ও এক  কেজি ৬০০ গ্রাম আইসসহ বিপুল পরিমাণ ইয়াবা উদ্ধার করা হয়।  

মাদকের টাকার ভাগ নিয়ে খুনাখুনি : খুচরা বাজারে মাদক বিক্রির টাকার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে খুনাখুনির ঘটনাও ঘটছে। অতি সম্প্রতি রাজধানীর পল্লবীর কালশী আদর্শনগর এলাকায় বাসায় ঢুকে বোনকে ছুরি মেরে ভাইকে গুলি করেছে সন্ত্রাসীরা। আহতরা হলো লাভলী বেগম ও তার ভাই সুমন মিয়া। তারা মাদক কারবারিচক্রের সদস্য বলে তদন্তে জানতে পেরেছে পুলিশ।

এর বাইরে মাদকের কারবার নিয়ে বিরোধের জেরে সম্প্রতি রাজধানীর মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্প এলাকায় নারী-শিশুসহ অন্তত ৯ জনকে হত্যার তথ্য পাওয়া গেছে।

সূত্র: কালের কণ্ঠ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।