ঢাকা, সোমবার, ৬ শ্রাবণ ১৪৩২, ২১ জুলাই ২০২৫, ২৫ মহররম ১৪৪৭

অন্যান্য

বাইরে ফিটফাট সাইফুজ্জামান আসলে ‘মহাদুর্নীতিবাজ’ - প্রথম পর্ব

ব্যাংক লুট ও চোরাচালানের টাকা পাচার বিদেশে

বিশেষ প্রতিনিধি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮:১০, জুলাই ২১, ২০২৫
ব্যাংক লুট ও চোরাচালানের টাকা পাচার বিদেশে

সাইফুজ্জামান চৌধুরী আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা আখতারুজ্জামান চৌধুরীর পুত্র। প্রয়াত আখতারুজ্জামান ছিলেন চট্টগ্রামের আনোয়ারা অঞ্চলের অন্যতম চোরাচালান সিন্ডিকেটের প্রধান।

তার বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতি, অনিয়ম এবং সন্ত্রাসের অভিযোগ ছিল। সেই পথেই উত্থান ঘটে তার পুত্র সাইফুজ্জামান চৌধুরী ওরফে জাভেদের। তিনি ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের টিকিটে এমপি নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালে বিনা ভোটে এমপি হওয়ার পর তাকে ভূমি প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২০১৮ সালে তিনি পদোন্নতি পেয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ের পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রী হন। পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রী হওয়ার পর তিনি মন্ত্রণালয়ের স্বচ্ছতার জয়গান গেয়েছিলেন। ‘ভূমি মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়া হয় না’, ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতা’ ইত্যাদি নানা স্লোগানে মন্ত্রণালয় ভরিয়ে  দিয়েছিলেন, নিজের একটা ক্লিন ইমেজ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন মন্ত্রণালয়ে। মন্ত্রণালয়ে তিনি ছিলেন স্বচ্ছতার প্রতীক। ভূমি মন্ত্রণালয়কে তিনি দুর্নীতিমুক্ত করেছেন বলেও দাবি করতেন। কিন্তু বাইরে ফিটফাট এই ভদ্র মানুষটির আড়ালে ছিল একজন ‘মহাদুর্নীতিবাজ’ অর্থ পাচারকারী। মজার ব্যাপার হলো, অন্যরা যেমন দুর্নীতির টাকা দিয়ে দেশে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন, সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ক্ষেত্রে তেমনটি ঘটেনি। বরং তিনি দুর্নীতির টাকা পুরোটাই বিদেশে পাচার করেছেন। বিদেশে তার এখন পর্যন্ত প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকার হদিস পাওয়া গেছে। এসব অর্থ তিনি বিনিয়োগ করেছেন যুক্তরাজ্য, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর, কানাডা, ব্রুনাই, ম্যাকাওসহ বিভিন্ন দেশে। প্রতিটি দেশেই আবাসন খাতে তার বিপুল বিনিয়োগের খবর এখন বিশ্বজুড়ে আলোচনার বিষয়। প্রশ্ন উঠেছে কীভাবে সাইফুজ্জামান জাভেদ এ অর্থ পেলেন?

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, তার এই অর্থের প্রধান উৎস হলো ব্যাংক লুট এবং চোরাচালান। সাইফুজ্জামান চৌধুরী পৈতৃকসূত্রে ইউসিবি ব্যাংক পেয়েছিলেন। যদিও বিএনপির আমলে এ ব্যাংক হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হওয়ার পর আবারও ইউসিবি ব্যাংক দখল করেন সাইফুজ্জামান চৌধুরী। এটিকে মূলত পারিবারিক সম্পত্তিতে পরিণত করেন। ইউসিবির সাম্প্রতিক সময়ের অডিটে দেখা গেছে, এখান থেকে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা বেনামে পাচার করেছেন। বেসরকারি খাতের ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি) থেকে নিয়মবহির্ভূতভাবে ২ হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়েছে জেনেক্স ইনফোসিসের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আদনান ইমামের চার প্রতিষ্ঠান। এ ঋণ দিতে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা কমিটি কোনো সুপারিশ না করলেও পরিচালনা পর্ষদে তা অনুমোদিত হয়েছে। এর বাইরে যথাযথ প্রক্রিয়া না মেনে জেনেক্স ইনফোসিসের শেয়ার কিনেও লোকসানে পড়ে ব্যাংকটি। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৪ সালের জুলাই সময়ে এসব অনিয়ম হয়।

ইউসিবিতে যখন এসব অনিয়ম ঘটে, তখন ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ছিলেন সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ওরফে জাভেদের স্ত্রী রুকমিলা জামান ও নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন তার ভাই আনিসুজ্জামান চৌধুরী। মোহাম্মদ আদনান ইমাম যুক্তরাজ্যের নাগরিক, সে দেশে আবাসন খাতে তার ব্যবসা রয়েছে। ইউসিবি সূত্রে জানা গেছে, জেনেক্স ইনফোসিসকে যে ঋণ দেওয়া হয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তা খেলাপি হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংককে শরীফ জহির ইউসিবি ব্যাংক সম্পর্কে একটি চিঠি দিয়েছেন। শরীফ জহিরের চিঠিতে ব্যাংক দখল হওয়ার পর সাইফুজ্জামান চৌধুরী কীভাবে ব্যাংকের চেয়ারম্যানের ভূমিকা পালন করেছেন, তা তুলে ধরা হয়েছে।

চিঠিতে বলা হয়, ২০১৯ সালে নিয়মবহির্ভূতভাবে বড় অঙ্কের ঋণ বিতরণ করা হয়েছে বলে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। জেনেক্স ইনফোসিস লিমিটেড, জেনেক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড, এ অ্যান্ড পি ভেঞ্চার লিমিটেড, এডব্লিউআর ডেভেলপমেন্ট এবং এডব্লিউআর রিয়েল এস্টেট লিমিটেডের স্বার্থে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন করা হয়। ব্যবস্থাপনা পর্যায়ের সুপারিশ ছাড়াই এ ঋণগুলো অনুমোদিত হয় বলে নিরীক্ষায় উঠে এসেছে। এডব্লিউআর ডেভেলপমেন্ট এবং এডব্লিউআর রিয়েল এস্টেট লিমিটেডের চেয়ারম্যান আদনান ইমামের বাবা চৌধুরী ফজলে ইমাম। চিঠিতে বলা হয়, সাইফুজ্জামান চৌধুরীর চাচাতো ভাই আলমগীর কবীর অপুকে সম্পূর্ণ ‘অযৌক্তিকভাবে’ ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট পদ থেকে উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে তিনিই ব্যাংক কর্মকর্তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে নিয়মবহির্ভূত ঋণ অনুমোদন ও বিতরণ নিশ্চিত করেন। সরকার পতনের পরপরই তিনি বিদেশে পালিয়ে যান এবং ইমেইলের মাধ্যমে নিজের পদত্যাগপত্র জমা দেন।

মজার ব্যাপার হলো- ‘হোয়াইট কালার ক্রিমিনালরা যেরকম করেন, সেরকমই ধুরন্ধর প্রকৃতির ছিলেন সাইফুজ্জামান চৌধুরী। নিজের নামে কোনো ঋণ নেই, কিন্তু তিনি বেনামে বিভিন্ন ব্যক্তিকে ঋণ পাইয়ে দিয়েছেন এবং সেসব ঋণের টাকা পুরোটাই তিনি আত্মসাৎ করেছেন। ইউসিবি ব্যাংকের সাম্প্রতিক অডিটে দেখা গেছে সেখানে যে খেলাপি ঋণগুলো আছে তার সবটার সঙ্গেই সাইফুজ্জামান চৌধুরী জড়িত। তার সুপারিশে এবং তার সভাপতিত্বে বোর্ড সভায় এসব ব্যক্তিদের ঋণ দিয়েছেন। যারা কোনো না কোনোভাবে তার সঙ্গে সংযুক্ত। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান ছিল নামসর্বস্ব, প্যাডসর্বস্ব এবং তাদের ঠিকানাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। আর এ প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ দিয়ে পুরো টাকাটা নিজে আত্মসাৎ করেছেন এবং পাচার করেছেন। শুধু ইউসিবি ব্যাংক নয়, মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের প্রভাব খাটিয়ে তিনি অন্যান্য ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করেছেন। সাইফুজ্জামান চৌধুরীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য যেমন ঠিক তেমনি ইউসিবির চারিত্রিক বৈশিষ্টকেও তিনি তেমনি তৈরি করেছেন। ইউসিবি ব্যাংককে বাইরে থেকে দেখা যায় যে ব্যাংকটি খুব ভালো এবং চমৎকার কাজ করছে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে ব্যাংকের হিসাবনিকাশে ভয়াবহ গরমিল। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক যেসব ব্যাংকের ওপর কঠিন নজরদারি রাখছে তার মধ্যে ইউসিবি অন্যতম। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, যে কোনো ঋণগ্রহীতারা ঋণের আবেদন করলে সেই বিষয়টি সাইফুজ্জামান চৌধুরীর কাছে আসত। তিনি ওই ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একটা অঘোষিত চুক্তির পর ঋণ প্রদান করতেন। ইউসিবি ব্যাংকের সাম্প্রতিক সময় হিসাবনিকাশে দেখা গেছে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তথ্য গোপন করে লাভ দেখানো হয়েছে এবং শেয়ার মার্কেট থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা তোলা হয়েছে।

সাইফুজ্জামান চৌধুরীদের মূল পারিবারিক ব্যবসা হলো চোরাচালান। আনোয়ারা অঞ্চল ছিল বিদেশি মদ এবং মাদকদ্রব্য আনার অন্যতম রুট। শুধু তাই নয়, এই রুটের মাধ্যমে অবৈধ অস্ত্র আসত। এসব অবৈধ অস্ত্র এবং মাদকের লাভ অনেক বেশি। ৫০০ থেকে ১০০০ গুণ লাভের এসব মাদক কেনাবেচা হতো। যার পুরো নিয়ন্ত্রণ করতেন সাইফুজ্জামান চৌধুরী। আর যেহেতু তিনি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন, সেজন্য এসব মাদক চোরাচালানের বিরুদ্ধে কোনোরকম ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেত না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০১৫ সালে চট্টগ্রামের আনোয়ারায় মাদকের বিরুদ্ধে একটি অপারেশন পরিচালনা করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কথা ছিল এক মাসে সব মাদকদ্রব্যের রুট বন্ধ করা হবে এবং মাদক চোরাচালানের উৎসমুখ বন্ধ করা হবে। কিন্তু চার দিনের মাথায় এই অপারেশন বন্ধ করা হয়।

২০১৬ সালে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের চাপ বাড়ার পর মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্ত ব্যবস্থাপনা আলগা হয়ে যায়। তখন সাইফুজ্জামান চৌধুরীর কপাল আরও খুলে যায়। তিনি তখন তার মাদক এবং অন্যান্য চোরাচালানের সিন্ডিকেট নতুন করে শুরু করেন। ঢাকা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মিয়ানমার থেকে নানারকম মাদকদ্রব্য, অস্ত্র নিয়ে এসে সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করেন সাইফুজ্জামান চৌধুরী। যে নেটওয়ার্কের মাধ্যমে উপার্জন করেন হাজার হাজার কোটি টাকা। আর এ টাকা তিনি পুরোটাই হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করেছেন। আর এ কারণেই মন্ত্রণালয়ে তিনি একটা ক্লিন ইমেজ নিয়েছিলেন। মন্ত্রণালয়ের কাজে তিনি দুর্নীতি করেন না বলে ঘোষণা করেছিলেন। আর সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো- সাইফুজ্জামান চৌধুরী বিদেশে যে অর্থ পাচারগুলো করতেন, সেই অর্থ পাচারের টাকা দিয়ে বিদেশে তিনি অনেকগুলো কোম্পানি খুলেছেন। যে কোম্পানিগুলোর মূল নিয়ন্ত্রণ ছিল তার কাছে। এসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের হিসাব তিনি তার নির্বাচনি হলফনামায় দেননি। সাইফুজ্জামান চৌধুরী হলেন সেই ব্যতিক্রমী অর্থ পাচারকারী এবং দুর্নীতিবাজ, যিনি বাইরে থেকে নিজের একটি ক্লিন ইমেজ তৈরি করেছিলেন। কিন্তু ভিতরে ভিতরে তিনি অর্থ পাচারের নিত্যনতুন কলাকৌশল আবিষ্কার করে বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। এ মহাদুর্নীতিবাজের এখন যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রে একযোগে তদন্ত চলছে। যুক্তরাজ্যে তদন্তের মাধ্যমে তার কিছু সম্পদ জব্দ করা হয়েছে। বর্তমানে সাইফুজ্জামান চৌধুরী দুবাইতে আরাম-আয়েশে জীবনযাপন করছেন বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।

এনডি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।