ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৯ শ্রাবণ ১৪৩২, ১৪ আগস্ট ২০২৫, ১৯ সফর ১৪৪৭

অন্যান্য

বিশেষ ছাড়ে  সুবিধা পেল ২৮০ খেলাপি প্রতিষ্ঠান

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট   | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২:১১, আগস্ট ১৩, ২০২৫
বিশেষ ছাড়ে  সুবিধা পেল ২৮০ খেলাপি প্রতিষ্ঠান

বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যবসায়ীদের জন্য বিশেষ ক্ষমতায় ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ নিয়ে এসেছে, যাতে খেলাপি ঋণ থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহায়তা করা হয়। এরইমধ্যে প্রায় ২৮০টি প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ পুনর্গঠনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে, আর এক হাজারেরও বেশি প্রতিষ্ঠানের আবেদন এখনো প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

সাধারণ নীতিমালা অনুযায়ী, খেলাপি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ঋণ নবায়নের জন্য চাহিদামতো টাকা জমা দিতে পারে না। তাই এই বিশেষ সুবিধার আওতায় শুধুমাত্র যাদের ঋণের পরিমাণ ৫০ কোটি টাকার বেশি, তাদেরই ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। চলতি বছরের  শুরুতেই বাংলাদেশ ব্যাংক একটি বাছাই কমিটি গঠন করে এই প্রক্রিয়া পরিচালনা করছে।

বর্তমানে যেসব প্রতিষ্ঠানের ঋণ পুনর্গঠন অনুমোদন পেয়েছে, তাদের মধ্যে অনেকের ব্যবসা গতানুগতিক কারণ বা রাজনৈতিক কারণে (আওয়ামী লীগের শাসনামলে) বন্ধ ছিল। এ তালিকায় বিএনপির শীর্ষ ও মাঠপর্যায়ের নেতাদের ব্যবসাও রয়েছে। করোনাভাইরাস মহামারি এবং ডলার সংকটের কারণে ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঘটনাও রয়েছে। তদুপরি, কিছু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ঋণ অনিয়মের অভিযোগও উঠেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, এবার ঋণ পুনর্গঠনের সুবিধা পাওয়া কিছু প্রতিষ্ঠান আগেও এ ধরনের সুবিধা পেয়েছিল। তবে মোট কত পরিমাণ ঋণের পুনর্গঠন হয়েছে, তা এখনও নিশ্চিত নয়। ব্যাংকের সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে তখনই, যখন সংশ্লিষ্ট গ্রাহক নির্ধারিত টাকা জমা দেবেন এবং ব্যাংক তা গ্রহণ করবেন। এদিকে, যেসব প্রতিষ্ঠান ঋণ পুনর্নবায়ন করবে, তারা ইতোমধ্যে সেই প্রক্রিয়া শুরু করেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, করোনাভাইরাস, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি এবং রাজনৈতিক কারণে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য এই বিশেষ নীতিসহায়তা দেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে ২৮০টি প্রতিষ্ঠানের জন্য ব্যাংকগুলোকে চিঠি পাঠানো হয়েছে, আর বাকি আবেদন যাচাই-বাছাই চলছে। এই উদ্যোগের ফলে ব্যবসায় গতি ফিরে আসার আশা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক এনায়েতুর রহমান বাপ্পীর মালিকানাধীন বিল্ডট্রেড গ্রুপ ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে প্রায় চার হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠনের সুবিধা দিয়েছে। তার মালিকানাধীন ভার্গো মিডিয়ার (চ্যানেল নাইন) ঋণও পুনর্গঠনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিল্ডট্রেডের ঋণ এবি ব্যাংকে এবং ভার্গো মিডিয়ার ঋণ রূপালী ব্যাংকে আছে।

এ ছাড়া ঋণ পুনর্গঠনের সুবিধা পেয়েছে বিএনপির কোষাধ্যক্ষ এম রশিদুজ্জামান মিল্লাতের সৌরভ গ্রুপ, রাজশাহীর এরশাদ গ্রুপ, হবিগঞ্জের আরিফুর রহমানের ব্লু প্ল্যানেট গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলো (প্যালেস রিসোর্ট, স্কাই ক্যাপিটাল, বদর স্পিনিং মিলস) এবং ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং, বেঙ্গল প্লাস্টিক, আবদুল মোনেম গ্রুপ, ওরিয়ন গ্রুপ, দেশবন্ধু গ্রুপ, ওপেক্স সিনহা ও তানাকা গ্রুপ।

গত বছরের আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকালে আগুনে পুড়ে যাওয়া গাজী গ্রুপের ঋণও পুনর্গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়া জিয়া পরিবারের ড্যান্ডি ডাইং লিমিটেড, বিএনপির উপদেষ্টামণ্ডলীর আসলাম চৌধুরীর রাইজিং স্টিল, সিলেট বিএনপির খন্দকার আবদুল মুক্তাদিরের সাবাব ফেব্রিকস, গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের ওয়ান ডেনিম, ফেয়ার ইলেকট্রনিকস, ইফাদ গ্রুপ, এমবিয়েন্ট স্টিল, জিপিএইচ ইস্পাত, প্রাইম গ্রুপ, আনোয়ার গ্রুপ, সিল্কওয়েজ গ্রুপ, ডায়মন্ড স্পিনিং মিলস, মীম গ্রুপ, এসএমএ গ্রুপ, বিইউসি অ্যাগ্রো, ব্লিং লেদার প্রোডাক্টস, অ্যাপেক্স ওয়েভিং ও অঙ্কুর স্পেশালাইজড কোল্ডস্টোরেজের ঋণও পুনর্গঠনের আওতায় এসেছে।

তবে সংশ্লিষ্ট গ্রুপগুলোর সব প্রতিষ্ঠানই খেলাপি হয়েছে এমন নয়। কোনো কোনো গ্রুপের কিছু প্রতিষ্ঠান খেলাপি হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানকে ঋণ পুনর্গঠনের সুবিধা দিতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণদাতা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণ পুনর্গঠনের জন্য এবার বিশেষ সুবিধা দিয়েছে। সাধারণ নিয়মে ঋণ নবায়নের জন্য গড়ে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ এককালীন জমা, এক বছরের গ্রেস পিরিয়ড ও সাত বছর পর্যন্ত ঋণ পরিশোধের সময় দেওয়া হয়। তবে বিশেষ সুবিধার আওতায় ঋণ পরিশোধের সময় ৫ থেকে ১৫ বছর এবং মাত্র এক শতাংশ এককালীন জমা দেওয়ার শর্তে, তিন বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে।

ব্যাংক সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, এই বিশেষ সুবিধার কারণে অনেক ভালো ব্যবসায়ীরাও ঋণের কিস্তি পরিশোধে অনিয়মিত হয়ে পড়েছেন, যা ব্যাংকের তারল্য ব্যবস্থায় সমস্যা সৃষ্টি করছে এবং সুদের হার বাড়াচ্ছে। তবে দীর্ঘদিন খেলাপি ঋণ থেকে কিছু অর্থ পাওয়া ও গ্রাহকের সঙ্গে পুনরায় যোগাযোগ স্থাপন করা ব্যাংকের জন্য ইতিবাচক দিক।

অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের কোষাধ্যক্ষ শেখ মোহাম্মদ মারুফ মনে করেন, প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান যেমন গাজী গ্রুপের জন্য সুবিধা যৌক্তিক। কিন্তু করোনাভাইরাস ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে যারা সুবিধা পাচ্ছে, তার প্রয়োজন ছিল না এবং ১৫ বছরের সময় দেওয়া ঠিক নয়।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, এর আগে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণ দেখিয়ে ২০১৫ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঋণ পুনর্গঠনের বিশেষ সুবিধা দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন ১১টি শিল্প গ্রুপকে ১৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠনের সুবিধা দেওয়া হয়েছিল।  

ওই সময় সুবিধা পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ছিল বেক্সিমকো গ্রুপ, ওরিয়ন গ্রুপ, যমুনা গ্রুপ, সিকদার গ্রুপ, কেয়া গ্রুপ, এননটেক্স, রতনপুর গ্রুপ, এসএ গ্রুপ, বিআর স্পিনিং, রাইজিং গ্রুপ ও আবদুল মোনেম। এসব প্রতিষ্ঠানের কয়েকটি এবারও ঋণ পুনর্গঠনের সুবিধা পেয়েছে এরই মধ্যে।

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বিতরণ করা ব্যাংক ঋণের একটি বড় অংশ এখন খেলাপি হয়ে যাচ্ছে, বিশেষ করে দলের শীর্ষ নেতাদের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে। এছাড়া দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক মন্দা এবং নতুন নীতিমালার প্রভাবেও খেলাপি ঋণ বেড়ে চলেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুনে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে ৫ লাখ ৩০ হাজার ৪২৮ কোটি টাকায় পৌঁছেছে, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ২৭ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যাংকের মোট ঋণের এক-চতুর্থাংশের বেশি এখন খেলাপি। তুলনামূলকভাবে, গত মার্চে খেলাপি ঋণ ছিল ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা, তখন খেলাপি ঋণের হার ২৪.১৩ শতাংশ। ২০২৪ সালের জুনে খেলাপি ঋণ ছিল ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা; এক বছরের মধ্যে এটি বেড়ে ৩ লাখ ১৯ হাজার ৩৭ কোটি টাকায় পৌঁছেছে।

ব্যাংকাররা মনে করছেন, বিশেষ ব্যবস্থায় ঋণ পুনর্গঠনের ফলে খেলাপি ঋণ কিছুটা কমবে। তবে ব্যবসায়িক গতি না ফিরলে এই ঋণ আবার খারাপ হয়ে যেতে পারে। তাই ব্যবসার স্বাভাবিক পরিবেশ ও কার্যক্রম পুনরায় চালু করা জরুরি।

এ বিষয়ে এবিবির সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, আগে রাজনৈতিক কারণে এ ধরনের সুবিধা দেওয়া হতো, কিন্তু এবার যৌক্তিক কারণে সুবিধা দেওয়া হচ্ছে, যাতে সবাই আবেদন করতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে নানা ধরনের নিরীক্ষা, যাচাই-বাছাই ও পরিদর্শন করছে। চূড়ান্ত কার্যকর করার দায়িত্ব ব্যাংকের হাতে রাখা হয়েছে, যা ভালো। তবে মেয়াদ বেশি হওয়ায় ঋণ ফেরত পাওয়া নিয়ে এখনও দুশ্চিন্তা রয়েছে।

এনডি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।