জাহাঙ্গীর কবির নানক রাজনীতিতে দুর্নীতি এবং সন্ত্রাস প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছেন। রাজনীতি মানেই যে দুর্নীতি এবং সন্ত্রাস এটি বাস্তবে প্রমাণ করেছেন এই রাজনীতিবিদ।
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসে। এ সময় নানককে দেওয়া হয় যুবলীগের দায়িত্ব। আস্তে আস্তে তিনি যুবলীগকে গড়ে তোলেন একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে। যুবলীগের প্রধান কাজ ছিল বিভিন্ন আন্দোলনের কর্মসূচিতে জ্বালাও-পোড়াও এবং নাশকতা করা। অগ্নিসংযোগ, গানপাউডার দিয়ে বাস পুড়িয়ে নির্বিচার মানুষ হত্যার মাধ্যমে নানক সারা দেশে ভীতির রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। তাঁর এ সন্ত্রাসের রাজনীতিবিদ হিসেবে গড়ে ওঠার ইতিহাস আরও পুরোনো।
আশির দশকেই নানক রাজনীতিতে শুরু করেন সন্ত্রাস কার্যক্রম। তিনি ছাত্রলীগের দায়িত্ব গ্রহণ করার পর সংগঠনটির মধ্যে একটি সশস্ত্র ক্যাডার গড়ে তোলেন। তাদের হাতে তুলে দেন অবৈধ অস্ত্র। এ অবৈধ অস্ত্র এবং সন্ত্রাস কার্যক্রমের দুটি লক্ষ্য ছিল। প্রথমত নানক চেয়েছিলেন সন্ত্রাসী কায়দায় বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষকে দমন, নিঃশেষ এবং ক্যাম্পাসগুলোয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে। দ্বিতীয়ত এর মাধ্যমে তিনি চাঁদাবাজি এবং দুর্নীতির চর্চা শুরু করেন। ছাত্রলীগ ‘সন্ত্রাসী’ সংগঠনের পরিচয় পায় মূলত নানকের হাত ধরেই। যুবলীগের দায়িত্ব পেয়ে এটিকেও তিনি সন্ত্রাসী সংগঠনে রূপ দেন। আস্তে আস্তে তাঁর এ সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক বড় হতে থাকে। নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের তিনি অন্যতম নেতা, যাঁর নিজস্ব সন্ত্রাসী ক্যাডার বাহিনী রয়েছে। ২০০১ সালের পর থেকে তিনি সম্রাট, খালেদসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসীকে জড়ো করেন। এসব সন্ত্রাসী দিয়ে একদিকে যেমন বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজি এবং অপরাধ সংঘটিত করতেন, পাশাপাশি তিনি এ ক্যাডারদের দিয়ে রাজনৈতিক কর্মসূচিও পালন করাতেন। এভাবেই আওয়ামী লীগ ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত দেশের শান্তিশৃঙ্খলা এবং স্থিতিশীলতা নষ্টের চেষ্টা করেছে। এ সময় আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকলেও নানক ফুলেফেঁপে ওঠেন চাঁদাবাজি এবং সন্ত্রাসের মাধ্যমে।
২০০৬ সালে যখন বিএনপি শান্তিপূর্ণভাবে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের সব আয়োজন সম্পন্ন করে, সে সময় শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের পথ সন্ত্রাসী কায়দায় বাধাগ্রস্ত করার জন্য একটি নীলনকশা প্রণয়ন করেন জাহাঙ্গীর কবির নানক। ২০০৬ সালের ২৭ অক্টোবর তিনি যুবলীগের পক্ষ থেকে লগি-বৈঠার কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এ লগি-বৈঠার কর্মসূচি ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কজনক ঘটনাগুলোর একটি। শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের দিন বিনা অজুহাত ও উসকানিতে নানকের নেতৃত্বে সশস্ত্র ক্যাডাররা চড়াও হয় বিএনপি এবং জামায়াতের ওপর। শুরু হয় লগি-বৈঠা নিয়ে সাপের মতো মানুষ পিটিয়ে হত্যা করা। এ নারকীয় যজ্ঞের ফলে সারা দেশে একটি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়। অনেক রাজনীতি বিশ্লেষক মনে করেন, এ লগি-বৈঠার ঘটনাই এক-এগারো নিয়ে আসার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এরপর নানক বিভিন্ন গণপরিবহনে গানপাউডার দিয়ে মানুষ হত্যা করেন। ফলে পুরো দেশে অরাজকতা এবং বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। যেখান থেকে ক্ষমতা গ্রহণ করে সেনাসমর্থিত এক-এগারো সরকার। এক-এগারো শুরু হলে নানক বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। আবার ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে দেশে ফিরে আসেন। তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক মামলা থাকলেও সেসব মামলায় তিনি অলৌকিকভাবে ছাড়া পেয়ে যান। নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তিনি ক্ষমতাসীন দলের একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের জন্য সন্ত্রাসী বাহিনীকে নতুন করে ব্যবহার শুরু করেন। সে সময় প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর কাগজে কলমে তিনি যুবলীগের চেয়ারম্যান ছিলেন না। শেখ হাসিনার আত্মীয় ওমর ফারুক চৌধুরীকে যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি করা হয়। কিন্তু ওমর ফারুক চৌধুরী যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি থাকলেও কাগজে কলমে যুবলীগ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করতেন নানক। তাঁর নেতৃত্বে বিরোধী দলের ওপর আক্রমণ, খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলা এবং বিএনপি নেতা-কর্মীদের ওপর অকথ্য নির্যাতন শুরু হয়। তাঁর নেতৃত্বে ছাত্রলীগ-যুবলীগ নিয়ে গড়ে ওঠে হেলমেট বাহিনী, সন্ত্রাসী বাহিনী। নানকের কাজ ছিল মূলত বিরোধী দল কোনো কর্মসূচি দিলে তাতে বাধা দেওয়া, তাদের ওপর আক্রমণ এবং নির্যাতন-নিপীড়ন করা। এভাবে পুরো দেশে নানকের ক্যাডার বাহিনী সশস্ত্র কায়দায় বিরুদ্ধমত দমনের কাজ শুরু করে। এ কাজে তৎকালীন সরকার তাঁকে মদদ দিয়েছিল। এর ফলে নানক হয়ে ওঠেন রাজনীতিতে এক ত্রাসের নাম, সন্ত্রাসের নতুন গডফাদার। শামীম ওসমান কিংবা জয়নাল হাজারী বা তাহেরের মতো শীর্ষ সন্ত্রাসীদের পেছনে ফেলে নানক হয়ে ওঠেন বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ত্রাস। তিনি পুরো ঢাকা শহর কয়েকটি সন্ত্রাসী গ্রুপের হাতে দিয়ে দেন। তাঁর নেতৃত্বে শুরু হয় অবৈধ অস্ত্র এবং মাদকের কারবার। এর ফলে শুধু যে বিরোধী রাজনীতির ওপরই দমননীতি এসেছিল তা নয়, পাশাপাশি ঢাকাসহ সারা দেশে অবৈধ অস্ত্র এবং মাদক কারবারের পুরো নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন নানক। সেখান থেকে বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থ উপার্জন করতেন তিনি।
রাজনীতি সন্ত্রাসমুক্ত করার জন্য বিভিন্ন মহলে সব সময় বলা হয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে রাজনীতিতে সন্ত্রাস অনিবার্য এবং অপরিহার্য করেছিলেন নানক। তাঁর কারণেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিপক্ষকে গুম করা, হত্যা করা এবং প্রতিপক্ষের ওপর দমনপীড়ন-নির্যাতনের স্টিমরোলার চালানো শুরু হয়েছিল। নানকের কারণেই সম্রাট, খালেদের মতো সন্ত্রাসী গডফাদারদের জন্ম হয়। নতুন আন্ডারওয়ার্ল্ডের সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন নানক। যার মাধ্যমে বড় বড় ব্যবসায়ীর কাছ থেকে চাঁদাবাজি, তাঁদের ভয়ভীতি-হুমকি দেখানোর ঘটনা ঘটতে থাকে প্রতিনিয়ত। নানক যার কাছে যে পরিমাণ অর্থ চাইতেন, সে পরিমাণ অর্থই তাঁদের দিতে হতো। আর যদি না দেওয়া হয়, তাহলে তাঁদের ওপর নেমে আসত নির্যাতন-নিপীড়ন। নানকের সশস্ত্র ক্যাডাররা সেসব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে নির্বিচার হামলা করত। এ রকম বহু উদাহরণ আছে, যেখানে অনেক ব্যবসায়ী বাধ্য হয়ে নানকের সন্ত্রাসীদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। তাদের নিয়মিত মাসোহারা দিতে রাজি হয়েছিলেন। কারণ সে সময় নানক হয়ে উঠেছিলেন প্রবল ক্ষমতাবান। বিশেষ করে বিডিআর বিদ্রোহের পর নানকের অবৈধ অস্ত্রধারী ক্যাডাররা অবাধে সন্ত্রাসের লাইসেন্স পেয়ে যান। সরকার তাদের যে কোনো অপরাধ করার অনুমতি দেয়। ফলে তারা যা-ই করুন না কেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কিছুই করবে না, মুখ বুজে থাকবে, এমন একটি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাংলাদেশে। যে ব্যবস্থার কারণে নানক ও তাঁর ক্যাডাররা হয়ে উঠেছিলেন অপ্রতিরোধ্য সন্ত্রাসী। সন্ত্রাসের মাধ্যমেই তিনি দেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগকে নিরঙ্কুশ করতে চেয়েছিলেন।
২০১৩ সালে যখন বিএনপি সারা দেশে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে, তখন এ আন্দোলন দমনের দায়িত্ব দেওয়া হয় নানককে। নানকের নেতৃত্বেই সারা দেশে শুরু হয় বিরোধী দলের ওপর হেলমেট বাহিনীর আক্রমণ এবং নির্যাতন। নানক সে সময় পুরো এ সন্ত্রাসের কার্যক্রম তদারকি করতেন। যখনই বিএনপি কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি দিত, সে কর্মসূচি বানচাল করার জন্য নানকের হেলমেট বাহিনী চড়াও হতো। এ বাহিনীর আক্রমণের ভয়ে বিরোধী দল সব সময় অস্থির আতঙ্কে থাকত। আওয়ামী লীগ মনে করেছিল নানকের এ সশস্ত্র সন্ত্রাসী ক্যাডাররাই শেষ পর্যন্ত দলকে রক্ষা করতে পারবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো সন্ত্রাসের মাধ্যমে কোনো দিন কোনো দল ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারে না। নানক ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত যে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন, তার পরিণতি হয়েছে ভয়াবহ। বিশেষ করে চব্বিশের জুলাই গণ অভ্যুত্থানের পর নানক ঢাকা শহরে তাঁর হেলমেট বাহিনীকে লেলিয়ে দিয়েছিলেন। মোহাম্মদপুরে নানকের সহযোগীরা প্রকাশ্যে অবৈধ অস্ত্র দিয়ে ছাত্রদের ওপর গুলি চালিয়েছিল। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে তারা নারকীয় কায়দায় অত্যাচার-নিপীড়ন করেছিল। কিন্তু সবকিছুর পরও আওয়ামী লীগের পতন হয়। নানকদের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় ছাত্র-জনতা। দেশের ছাত্র-জনতা প্রমাণ করে দেয় সন্ত্রাস এবং শক্তি প্রয়োগ করে রাজনীতিতে চিরস্থায়ীভাবে টিকে থাকা যায় না।
সৌজন্যে: বাংলাদেশ প্রতিদিন