অনুবাদক ও গবেষক ফাদার সিলভানো গারেল্লো ডায়াসে আসেন ১০ জনের পরে। সঞ্চালকের ঘোষণা, তিনি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখতে আসছেন।
তার অনুধাবন শতভাগ ঠিক। তাও যদি হয় আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া সম্পর্কে, তাহলে তো দুইশ’ভাগ সঠিক। সংক্ষেপে সবাই আ ক ম যাকারিয়া নামে চেনেন। সুরসাধকরা ওস্তাদজির নাম নেওয়ার আগে এক কানে হাত দিয়ে নেন, এটাই গুরু-শিষ্য পরম্পরা। আ ক ম যাকারিয়ার নাম নেওয়ার আগে ‘প্রতœতত্ত্ববিদ, নৃতত্ত্ববিদ, ইতিহাসবিদ, অনুবাদক, পুঁথিসাহিত্য বিশারদ ও ক্রীড়া সংগঠক’ এবং ‘আমলা ও প্রশাসক’ শব্দগুলো বসাতে হবে, এরপর কানে হাত। না বসালে দুই কানে হাত! কারণ, তিনি যে জ্ঞানসাধনার গুরু।
ঠিক এমনটিই বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. নাজমা খান মজলিশ, প্রত্নতত্ত্বের প্রাতিষ্ঠানিক কেউ না হয়েও এক্ষেত্রে স্যার নিজেকে এমন জায়গায় নিয়ে গেছেন যে তাকে প্রত্নতত্ত্বের বিশারদ বলা চলে। আমার কাছে এসব বিষয়ে কেউ পিএইচডি করতে এলে সবার আগে তাদের স্যারের বই পড়তে বলি। এখানেই তার মাহাত্ম্য। তিনি খুবই আগ্রহের সঙ্গে ঢাকার স্থাপত্য বিষয়ক গ্রন্থ প্রণযন কমিটির সঙ্গে কাজ করেছেন, নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি ফারসি ভাষার আকর গ্রন্থগুলো অনুবাদ করেছেন।
শুরুতে ডায়াসের কথা হচ্ছিলো। আর ডায়াস যেহেতু ছিলো তাই মঞ্চও এসে যায়। শনিবার (১৯ মার্চ) ঢাবির নওয়াব নবাব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে মঞ্চে ব্যানার ওঠে ‘আ ক ম যাকারিয়ার স্মরণসভা এবং আলোকচিত্র ও গ্রন্থ প্রদর্শনী’র। আয়োজক, ঢাকার স্থাপত্য বিষয়ক গ্রন্থ প্রণয়ন কমিটি। শুরুতেই এ মহাত্মার জন্য এক মিনিট নীরবতা, এরপর সূচনাসঙ্গীত- ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্যসুন্দর...’।
ঠিক যেনো তাই। জ্ঞানের আনন্দ আর মঙ্গলালোকে তিনি সত্যসুন্দর নিয়ে সর্বদা বিরাজ করছেন।
এজন্যই কমিটির সদস্য অনুবাদক ও গবেষক এবং দেশের বৃহত্তম ঈদ জামায়াত শোলাকিয়ার খতিব মওলানা ফরিদউদ্দিন মাসউদ বলেন, তার মতো আলোকিত মানুষ আমি আর দেখিনি। তার সুন্দর হাসি দেখলেই বোঝা যায়, তার মন কতো সাদা। মানুষ হিসেবেও তিনি ছিলেন অসাধারণ।
১৯১৮ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জন্ম নেওয়া আ ক ম যাকারিয়া সারাজীবন সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও, জ্ঞানাগ্নির পরশমণি প্রাণে ছুঁইয়ে পূণ্য অর্জনে ভোলেননি। মায়ের ভাষা বাংলা ছাড়াও তার দখল ছিলো ফার্সি, ফরাসি, উর্দু, ইংরেজি, আরবি ভাষায়।
‘ফারসি লেখার চারটি স্টাইলই তিনি রপ্ত করেছিলেন। এজন্য অতি জটিল লেখার পাঠোদ্ধারও তিনি করতে পারতেন। প্রাচীন শিলালিপির পাঠোদ্ধারে আরবী-ফারসিই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয়। খুব সূক্ষ্ম বিষয়ও তার চোখ এড়াতো না’। তার সম্পর্কে কমিটির সদস্য অনুবাদক ও গবেষক অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম খানের এমনই মত।
অনুবাদক ও গবেষক মওলানা নুরুদ্দিন ফতেহপুরী আবার ‘বাংলার আবুল ফজল ফয়েজী’ উপাধিতে ভূষিত করেন কমিটির এশীয় ভাষার অনুবাদ সম্পাদনা পরিষদের সভাপতি আ ক ম যাকারিয়াকে।
এলাহাবাদের এক কবির উর্দু কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে আরও যোগ করেন, তিনি কেবল পড়ালেখা, চাকরি আর পেনশন নিয়েই অধিকাংশের মতো জীবন শেষ করেননি- পরবর্তী প্রজন্মের জন্য দেখিয়ে গেছেন জ্ঞানের পথ। এ পথে তিনি কেবল অগ্রপথিকই ছিলেন না, শীর্ষেও পৌঁছেছিলেন। তিনি পুরনো ইতিহাস ঘেঁটে ইতিহাসের নতুন নির্দেশনা দিতেন। তার সঙ্গে কাজ করা ভাগ্যের ব্যাপার।
সাংবাদিক মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু তুলে ধরেন তার সময়নিষ্ঠ ও একাগ্রতার কথা, স্যারকে দেখে আমরা তরুণরাই লজ্জা পেয়ে যেতাম।
আয়োজকদের সূচনা বক্তব্যে বলা হয়, কমিটির ৬৮টি সভার ৬৬টি সভাতেই তিনি উপস্থিত থেকেছেন। আসতেন সবার আগে, আর যেতেন সবার পরে।
ফারসি ভাষার সম্পাদক শামীম বানুর মতে, সবাইকে কুর্নিশ করে মিটিংয়ে অভর্থনা জানাতেন তিনি।
দীর্ঘদিনের কর্মসঙ্গী ক্রীড়া সংগঠক কাজী আনিসুর রহমান বলেন, যাকারিয়া ভাইয়ের কাছ থেকে আমি তিনটি জিনিস শিখেছি- সরলতা, সততা ও নিজের ব্যক্তিত্ব দিয়ে অন্যকে শিক্ষা দেওয়া।
স্মরণসভায় কমিটির মাঠকর্মী জাকারিয়া মন্ডলের সূচনা বক্তব্যের মধ্য দিয়ে স্মৃতিচারণ পর্ব শুরু হয়। এর আগে অনুষ্ঠিত হয় বিশেষ দোয়া। সহধর্মিনী রেহানা বেগমও ছিলেন মঞ্চে। অনুষ্ঠানে আরো স্মৃতিচারণ করেন আলোকচিত্রী পাভেল রহমান, আ ক ম যাকারিয়ার কন্যা মাসুদা খানম ও ছেলে মারুফ শমসের যাকারিয়া।
বাবাকে নিয়ে তাদের আবেগী গলা। মারুফ শমসের যাকারিয়ার ভাষ্যে বাবা হলেন, খুব নিয়মানুবর্তী ও পরিবারকেন্দ্রিক মানুষ। শত ব্যস্ততার মধ্যেও পরিবারকে নিয়ে তার চিন্তা অবিস্মরণীয়।
‘কোথাও কোনো পুরনো মসজিদ-মন্দিরের খোঁজ পেলেই ছুটে যেতেন। ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন আজীবন সত্যসন্ধানী। বাবার সঙ্গে কোথাও বের হলে প্রত্যেকটি জায়গা ধরে ধরে বলে দিতেন, এইখানে এই ছিলো, ওইখানে ওই ছিলো। এজন্য অনেকেই তাকে ‘লিভিং এনসাইক্লোপিডিয়া’ বলতেন। বাবা একদা কাজ করেছেন এমন জায়গায় চল্লিশ বছর পর গিয়েও দেখেছি, বাবার ছেলে হিসেবে আমাকে দেখতে এসেছেন। রোজ অফিসে যাওয়া-আসার সময় বাবাকে বারান্দায় বসে থাকতে দেখতাম। এখন বাবা নেই কিন্তু বারান্দার দিকে ঠিক চোখ চলে যায়। ’
কমিটির চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক তার এই না থাকাকে (১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬) বলছেন, বায়োলজিকাল ডেথ, কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে তিনি বেঁচে রয়েছেন ও থাকবেন।
তিনি বলেন, ঢাকার স্থাপত্য বিষয়ক গ্রন্থ প্রণয়ন কমিটি তরুণদের উদ্যোগে গঠিত। তিনি পরিণত বয়সে ও তারুণ্যের উদ্যম নিয়ে কাজ করেছেন। এ কমিটির সবচেয়ে বয়স্ক সদস্য ছিলেন আ ক ম যাকারিয়া। জানার ও জানানোর বিষয়ে তার ছিলো অফুরন্ত কৌতুহল। কমিটির সদস্যরা তাকে সবসময় স্মরণ করবে, অনুসরণ করবে। ভালো মানুষ হওয়ার শিক্ষা নেবে আ ক ম যাকারিয়ার কাছ থেকে।
স্মৃতিচারণের ফাঁকে ফাঁকে বেশকিছু প্রস্তাবও আসে। মওলানা ফরিদউদ্দিন দাবি তোলেন, তার উপর স্মারক গ্রন্থ, ঢাবিতে তার নামে চেয়ার ও তার বইগুলো বারবার প্রকাশের।
কমিটির মাঠকর্মী তরুণ সরকারের দাবি, আ ক ম যাকারিয়ার অধিকাংশ বই অপ্রকাশিত, শিগগিরই রচনাবলী আকারে এগুলো প্রকাশিত হওয়া দরকার। এজন্য বিভিন্ন প্রকাশনী ও সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো উদ্যোগ নিক।
এদিন স্মরণসভার পাশাপাশি আ ক ম যাকারিয়া এর বিভিন্ন কর্মতৎপরতা নিয়ে তোলা পাঁচজন আলোকচিত্রীর আলোকচিত্র প্রদর্শিত হয়। তারা হলেন- জিয়া ইসলাম, শেখ হাসান, কাকলী প্রধান, ইন্দ্রজিৎ ঘোষ ও জয়ীতা রায়। আরও প্রদর্শিত হয় আ ক ম যাকারিয়ার লেখা ৩০টি গ্রন্থ।
শুরু হয় সিলভানোর কথা দিয়ে, তার কথা দিয়েই শেষ করা যাক। ‘আমার সঙ্গে তার যখন প্রথম দেখা হয় তখন তিনি অনেকগুলো প্রশ্ন নিয়ে হাজির হন। তিনি প্রশ্ন করতে জানতেন। প্রশ্ন করা গভীর বিষয়। এটাই সক্রেটিসের শিক্ষা। ’
ঠিক, জ্ঞানসাধনার গুরুদের এটাই কাজ- প্রশ্ন করা ও রেখে যাওয়া!
বাংলাদেশ সময়: ১২৪০ ঘণ্টা, মার্চ ২০, ২০১৬
এসএস