ঢাকা, বুধবার, ১১ চৈত্র ১৪৩১, ২৬ মার্চ ২০২৫, ২৫ রমজান ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

৫৯ হাজার টাকার ঋণের মামলা নিষ্পত্তিতে ৩৪ বছর!

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৩৩ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০২৫
৫৯ হাজার টাকার ঋণের মামলা নিষ্পত্তিতে ৩৪ বছর! প্রতীকী ছবি

ঢাকা: ১৯৮৪ সালে ঋণ জালিয়াতির অভিযোগে একটি মামলা হয় ১৯৮৯ সালে। তদন্ত করে বিচার শুরু হতে লেগে যায় আরও চার বছর।

পরের দুই বছর পার হয়ে যায় বিচার শেষ হতে। ১৯৯৫ সালে ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল হয় উচ্চ আদালতে। সেই আপিল হাইকোর্টে নিষ্পত্তি হয় ২০২৩ সালে।

সম্প্রতি সেই মামলার রায়ের অনুলিপি প্রকাশ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে মামলা দায়ের হওয়া থেকে শুরু করে হাইকোর্ট পর্যন্ত নিষ্পত্তি হতে লেগে গেছে ৩৪ বছর। যদি হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল হয়, তাহলে কেটে যেতে পারে আরও কয়েক বছর।

মামলা নিষ্পত্তিতে এমন দীর্ঘসূত্রতার কারণ উল্লেখ করেছে অন্তর্বতী সরকার গঠিত বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন। তাদের মতে, বিচারকের সংখ্যার সঙ্গে বিচারাধীন মামলার তুলনা করলে উচ্চতর আদালতে মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতার কারণ অনুধাবন করা যায়। এই পরিস্থিতি একটি কার্যকর বিচার বিভাগের ধারণার ঠিক বিপরীত চিত্রই তুলে ধরে।

একটি কার্যকর বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা করতে হলে সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগে মামলা ব্যবস্থাপনায় উল্লেখযোগ্য সংস্কার অপরিহার্য। এ ক্ষেত্রে মামলা ব্যবস্থাপনার ধারণায় একটি মামলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কার্যপদ্ধতি, সংশ্লিষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন, জনবল ও অবকাঠামোগত নানা বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে বলে জানিয়েছে কমিশন।

মামলার শুরু যেভাবে
১৯৮৯ সালের ২৮ জুন আসামিদের বিরুদ্ধে সাটুরিয়া থানায় মামলাটি করেন মানিকগঞ্জের দুর্নীতি দমন ব্যুরোর সহকারী পরিদর্শক মো. ইসহাক মিয়া।

মামলার এজাহারে বলা হয়, আসামি হালেমা খাতুন ৮২ হাজার টাকা দামের ১২টি তাঁত থাকা সম্পর্কিত বস্ত্র দপ্তরের একটি জাল পাস বই দেখিয়ে সোনালী ব্যাংক সাটুরিয়া শাখা থেকে ৬৪ হাজার টাকা তাঁত ঋণের আবেদন করেন। কিন্তু ব্যবস্থাপক এ টি এম আসাদুজ্জামান আবেদন যাচাই কিংবা তদন্ত না করে ১৯৮৪ সালের ১৪ মার্চ ৫৯ হাজার ৪০০ টাকা ঋণ দেন। ১৯৮৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত সুদসহ এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৬৬ হাজার ৯৮৫ টাকায়। আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে এ টাকা আত্মসাৎ করেন।

বিচারিক আদালতের রায়
পরবর্তী সময়ে তদন্ত করে দুইজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। ১৯৯৩ সালের ১৩ এপ্রিল স্পেশাল সিনিয়র জজ খোন্দকার মুসা খালেদ অভিযোগ গঠনের আদেশ দেন। আর মামলাটি বিচারের জন্য অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ-২ আদালতে পাঠান। বিচারের সময় ১১ জন সাক্ষী তাদের সাক্ষ্য দেন। বিচার শেষে মানিকগঞ্জে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ-২ এর বিচারক মো. তারিক হায়দার ১৯৯৫ সালের ২০ আগস্ট রায় দেন।

বিচারিক আদালতের রায়ে বলা হয়, আসামি হালেমা খাতুন নিজেকে বস্ত্র দপ্তরের একজন খাঁটি তাঁতী হিসেবে দাবি করেন এবং তাঁত ঋণের পাস বইটি বস্ত্র দপ্তর থেকে তার নামে ইস্যু করার কথা বলেন। আর আসাদুজ্জামান বলেন, তাঁত ঋণের পাস বইয়ে বস্ত্র দপ্তরের পরিচালকের নমুনা সই দেখে তিনি বিধি অনুযায়ী ঋণ মঞ্জুর করেছিলেন।

রায়ে আরও বলা হয়, হালেমা খাতুনের ব্যবহৃত ১৪৬৮১৪ নম্বরের পাস বই ১৯৮৪ সালের ১৫ জানুয়ারি ইস্যু করা হয়। এ বইয়ে তাঁতের সংখ্যা ১২টি থাকার কথা উল্লেখ ছিল। কিন্তু বস্ত্র দপ্তর থেকে জব্দ করা ১৪৬৮১৪ নম্বরের পাস বই রাধারমন নাথের নামে ইস্যু করা হয় বলে দেখা যায়। বইয়ে তাঁতের সংখ্যা উল্লেখ ছিল একটি।

বস্ত্র দপ্তরের নথি অনুযায়ী, হালেমা খাতুন তালিকাভুক্ত তাঁতী নন। ১৯৮৪ সালে ১৫ জানুয়ারি ১৪৬৮১৪ নম্বরের কোনো পাস বই ইস্যু করা হয়নি। ১৪৬৮১৪ নম্বরের বইটি রাধারমন নাথের নামে ১৯৮৪ সালের ২৭ নভেম্বর ইস্যু করা হয়। এ ছাড়া পরিচালকের সইয়েরও অমিল ছিল।

বিচার শেষে হালেমা খাতুনকে আদালত এক বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড এবং ৬০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে তিন মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন। আর এ টি এম আসাদুজ্জামানকে দুই ধারায় দুই বছর ও ৬০ হাজার টাকা জরিমানা করেন।

হাইকোর্টে আপিল ও রায়
রায়ের পর হালেমা খাতুন হাইকোর্ট বিভাগে আপিল করেন। দীর্ঘদিন পর ২০২৩ সালের ১৭ আগস্ট শুনানি শেষে আদালত রায় দেন।

হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, সব সাক্ষী পরস্পর পরস্পরকে সমর্থন করে বক্তব্য দিয়ে প্রসিকিউশন পক্ষের অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন। বিচারিক আদালতের রায় পর্যালোচনায় কোনো ক্রটি-বিচ্যুতি পরিলক্ষিত হয়নি। রায় ও দণ্ডাদেশ সঠিক এবং ন্যায়ানুগ হয়েছে। তাই আপিলটি নামঞ্জুর করা হলো। বিচারিক আদালতের রায় বহাল রাখা হলো। রায় পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে আসামিকে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ দেওয়া হলো।

২০২৩ সালের ১৭ আগস্ট রায়টি দিয়েছিলেন বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের একক হাইকোর্ট বেঞ্চ। সম্প্রতি রায়টি প্রকাশ করা হয়েছে। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নূর উস সাদিক, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল লাকী বেগম ও ফেরদৌসী আক্তার।

বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে যা বলা হয়েছে
সুপ্রিম কোর্টের নিজস্ব প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত আপিল বিভাগে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল ২৮ হাজার ৯০১টি এবং হাইকোর্ট বিভাগে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল পাঁচ লাখ ৭৭ হজার ২৮০টি। এই দুই বিভাগে কর্মরত বিচারকের সংখ্যার সঙ্গে বিচারাধীন মামলার এই সংখ্যার তুলনা করলে উচ্চতর আদালতে মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতার কারণ অনুধাবন করা যায়।

হাইকোর্ট বিভাগে দেওয়ানি, ফৌজদারি, রিট ও আদি এখতিয়ারভুক্ত মামলার নিষ্পত্তিতে বিলম্বের কারণ সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়— মামলার নোটিশ জারির ক্ষেত্রে বিলম্ব ও কার্যকর তদারকির অভাব; নিম্ন আদালতের রেকর্ড সময়মতো মামলার মূল নথির সঙ্গে শামিল না হওয়া। এ ছাড়া আদালতের প্রাথমিক আদেশে (রুল-জারির আদেশে) নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রতিপক্ষের জবাব দেওয়ার ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা না থাকায় মামলা হওয়ার পর দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও প্রতিপক্ষ জবাব দেওয়া থেকে বিরত থাকে।

মামলার নিষ্পত্তিতে বিলম্বের কারণ হিসেবে মামলায় জবাব দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারপক্ষের দীর্ঘসূত্রতার প্রবণতা এবং এক্ষেত্রে আদালতের তদারকির অভাব; অন্তর্বর্তী আদেশের মেয়াদ বারংবার বাড়ানোর ক্ষেত্রে আদালতের তদারকির অভাব; বেঞ্চ পুনর্গঠন বিষয়ে কোন সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকা, এবং এর ফলে প্রতিবার বেঞ্চ পুনর্গঠনের সময় চূড়ান্ত শুনানির জন্য তালিকাভুক্ত মামলা তালিকাচ্যুত হওয়া।

এ ছাড়া আদালতের আদেশ ও রায় সইয়ের ক্ষেত্রে বিলম্ব; মামলার বিভিন্ন পর্যায়ে আদালতের সহায়ক কর্মচারিদের অসহযোগিতা ও অবহেলা; মামলার আবেদনকারী বা আপিলকারী পক্ষ চূড়ান্ত শুনানির সময় অনুপস্থিত থাকা এবং অনুপস্থিতিজনিত কারণে মামলা খারিজ  হওয়ার পর তা আবার পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে সময়ক্ষেপণ করার মতো কারণও প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ০০২৯ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০২৫
ইএস/আরএইচ/এজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।