ঢাকা, সোমবার, ৩০ চৈত্র ১৪৩১, ১৪ এপ্রিল ২০২৫, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

বিডিআর হত্যাকাণ্ড: ‘প্রহসনের তদন্তে’ নানা প্রশ্ন, মেলেনি উত্তর

পিংকি আক্তার, সিনিয়র রিপোর্টার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১১৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ৯, ২০২৫
বিডিআর হত্যাকাণ্ড: ‘প্রহসনের তদন্তে’ নানা প্রশ্ন, মেলেনি উত্তর

‘বড়াইবাড়ি ও রৌমারী সীমান্ত সংঘর্ষ থেকেই ক্ষোভ পুষতে থাকে ভারত। সর্বোপরি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব নষ্ট করতেই ভারতের সম্পৃক্ততায় ঘটানো হয় বিডিআর হত্যাকাণ্ড’— বলছিলেন অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ হাসান নাসির।

সাবেক এই কর্মকর্তা বিডিআর হত্যাকাণ্ডের পর গঠিত তদন্ত কমিশনে ছিলেন।

২০০৯ সালের ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি ঘটে বিডিআর হত্যাকাণ্ড। এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তে সচিব আনিসুজ্জামানের নেতৃত্বে গঠিত হয় জাতীয় তদন্ত কমিশন। এই কমিশনেরই সদস্য ছিলেন হাসান নাসির। বাংলানিউজ কথা বলেছে তার সঙ্গে।

সাবেক এই কর্মকর্তার দাবি, তিনি পুরো ঘটনার টাইম শিডিউল (সময়সূচি) উদঘাটন করেছিলেন। তবে তাকে তা প্রকাশ করতে দেওয়া হয়নি। তার ভাষ্য, জনগণের তোপের মুখে পড়েই ‘প্রহসনের তদন্ত কমিটি’ গঠন করতে হয় তৎকালীন সরকারকে।

হাসান নাসির বলেন, ‘আমি তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনকে প্রশ্ন করি যে কতটা স্বাধীনভাবে আমরা কাজ করতে পারব। কিন্তু তিনি এমন প্রশ্ন শুনে বিরক্ত হন কিছুটা। তবে তদন্ত কমিটি সবাইকে তদন্তের প্রয়োজনে ডাকতে পারবে বলেই মত দেন তিনি। তারপরই শুরু হয় প্রহসনের এই তদন্ত। আমি ছাড়া বাকিরা চা, নাস্তার খবর নিতেই ব্যস্ত ছিলেন। পরে সরকার তাদেরই নানাভাবে পুরস্কৃত করে। ’

তিনি বলেন, ‘২০০৯ সালের নির্বাচনে আওয়ামী সরকারকে পরিকল্পিতভাবেই ক্ষমতায় বসতে সহযোগিতা করে ভারত। দেশের অন্যান্য ইস্যুর চেয়েও তাদের বড় উদ্দেশ্য ছিল প্রথমে বিডিআর হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে প্রতিশোধ নেওয়া। আর এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগের সামনের সারির কিছু নেতা-কর্মীর ভূমিকা ছিল। ’ 

‘জাহাঙ্গীর কবির নানক, ব্যারিস্টার তাপস (শেখ ফজলে নূর তাপস), সাবেক বিডিআর কর্মকর্তা ও আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলী, মির্জা আজম— তারা একাধিক মিটিং করেছিলেন বিডিআরের কিছু জওয়ানের সঙ্গে। প্রকৃতপক্ষে তারা একটু একটু করে ক্ষোভ তৈরি করছিল। জওয়ানদের মধ্যে ডাল-ভাতের যে অসন্তোষের কথা বলা হয়, সেটি নিয়ে দুর্নীতি হয়েছিল সত্য, তবে অফিসারদের এমন নৃশংসভাবে হত্যা করার মতো কোনো বিষয় সেটি ছিল না। ’ 

সেই সময়ের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা বলছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরে রাইফেলস সপ্তাহের আয়োজন হয়নি। তাই নতুন (আওয়ামী লীগ) সরকার গঠনের ৫০ দিনের মাথায়ই এ আয়োজনের প্রস্তুতি নেয় বিডিআর। ২৪ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় ছিল সাজ সাজ রব।  

সেদিন তৎকালীন বিডিআর সদরদপ্তরে তিন দিনব্যাপী রাইফেলস সপ্তাহের উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ঠিক তার আগের দিনই পিলখানা থেকে তিনটি এসএমজি (এক ধরনের অস্ত্র) চুরি যায়। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হতে দেখা যায়নি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্ট বাহিনীটিকে। তদন্তে বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন হাসান নাসির।

২২ ফেব্রুয়ারি সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা থেকে স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের (এসএসএফ) পরিচালক বরাবর পাঠানো প্রতিবেদনে বলা হয়, সন্ত্রাসী চক্রের সংঘবদ্ধ বা বিচ্ছিন্নভাবে আক্রমণের সুনির্দিষ্ট কোনো হুমকির শঙ্কা নেই। ‘যেখানে এমন ঘটনায় প্রধানমন্ত্রীর ভিজিট বাতিল হওয়ার কথা, সেখানে এ বিষয়ে তেমন কোনো পদক্ষেপই নিতে দেখা যায়নি কাউকে, যা অবাক করার মতো’, বলেন নাসির।

‘অনুষ্ঠান উদ্বোধন করে প্যারেড নিলেও প্রধানমন্ত্রী সেদিন গালা ডিনারে তার উপস্থিতি বাতিল করেন। প্রধানমন্ত্রী পিলখানায় যাওয়ার চার দিন আগে ২১ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রীকে সম্বোধন করে লিফলেট বিলি করা হয়, যা বিডিআর কর্তৃপক্ষের নজরে আসে। কিন্তু দেশের প্রধান গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এ লিফলেট সম্পর্কে কিছুই জানত না বলে তখন প্রতিবেদন দেয়। ’

তিনি বলেন, ‘ওই লিফলেটে বলা হয়েছিল— বিডিআর বাহিনীতে ওদের (সেনাবাহিনী) দেখতে চাই না। প্রয়োজনে আন্দোলনের মাধ্যমে কুকুরের মতো সরাব— এত বড় বিষয় কীভাবে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নজর এড়িয়ে গেল, সেটি বড় প্রশ্ন। এই প্রশ্ন আমি তদন্তে তুলে ধরেছিলাম। তবে গোয়েন্দা সংস্থার কাউকে জবাবদিহির আওতায় আনতে পারিনি শুধুমাত্র তদন্তে সরকারের অন্যান্য শাখায় দায়িত্বে থাকা কর্তা-ব্যক্তিদের অসহযোগিতামূলক আচরণের কারণে। ’

২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টা। রাজধানীর পিলখানায় তৎকালীন বাংলাদেশ রাইফেলসের (বিডিআর) দরবার হলে শুরু হয় দরবার। অনুষ্ঠানের শুরুতেই বিডিআর মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ বক্তব্য শুরু করেন। বক্তব্যের একপর্যায়ে কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিডিআরের কিছু বিদ্রোহী সদস্য অতর্কিত হামলা চালায় দরবার হলে।  

হাসান নাসির বলেন, ‘২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে ডিজি, ডিডিজিসহ ১৫-১৮ জনকে হত্যার মাধ্যমে ব্যপক হত্যাকাণ্ড শুরু হয়। এ সময় মিডিয়ার ভূমিকা তুলে ধরে তিনি জানান, যেখানে ঘটনা ঘটে ৯টা ৩০ মিনিটের কাছাকাছি সময়ে, সেখানে আচমকা এটিএন নিউজের সাংবাদিক মুন্নি সাহা সকাল ১০টায় পিলখানা গেটে হাজির হয়ে লাইভ টেলিকাস্ট শুরু করেন। এটি কীভাবে সম্ভব? তদন্তে যা পাই সেটি হলো, এই পুরো ঘটনায় মিডিয়ার মাস্টার রোল প্লে করেন সাংবাদিক মুন্নি সাহা ও জ ই মামুন।  

‘যেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েকটি শাখা গেটের কাছাকাছি যেতে পারছিল না, সেখানে মুন্নি সাহা ভেতরের চিত্র না জেনেই জওয়ানদের ভাই সম্বোধন করে ডাল-ভাতের দুর্নীতির বিষয়সহ তাদের বঞ্চনার কয়েকটি বিষয় মিডিয়াতে তুলে ধরে এই হত্যাযজ্ঞের গ্রাউন্ড তৈরি করছিলেন। পরে বিষয়টি তদন্তে উঠে এলে তাদের হাজির করার বিষয়ে কোনো সহযোগিতা আমরা পাইনি। ’

সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা বলছিলেন, ‘আমরা দেখতে পাই, প্রথমে ভারতের এনডিটিভি নিহতের খবর প্রথমে প্রকাশ করে। অর্থাৎ এ বিষয়ে ভারত সজাগ ছিল। সরকার চাইলেই তখন এই হত্যাকাণ্ড ঠেকাতে পারত। কিন্তু বিভিন্ন বৈঠক করে সময়ক্ষেপণ করেছে। ’

পিলখানা হত্যাকাণ্ডে সাবেক সেনাপ্রধান মঈন ইউ আহমেদের নীরব ভূমিকা ছিল। ‘তার নীরবতা ইতিহাসের সবচেয়ে ন্যক্কারজনক ঘটনা। র‌্যাব যেখানে চাইলেই পরিস্থিতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে পারত, সেখানে তাদের শুধু আদেশের অপেক্ষায় রেখে সময় অতিবাহিত করা হয়েছিল, যা আমার তদন্তে উঠে আসে। ’

হাসান নাসির তার তদন্তে একটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস তুলে ধরেন। সেটি হলো, রাইফেলস দিবসের আগে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে মিষ্টি বিতরণ করা হয়। ভারত থেকে সেই মিষ্টি বহন করে আনা হয় ঢাকা পর্যন্ত। সেই মিষ্টি কারা ট্রাকে এনেছিলেন, সেই তথ্য পাননি তিনি। ইমিগ্রেশনের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের কাছ থেকেও সহযোগিতা পাননি। তার ভাষ্য ‘যারা ভারত থেকে এই মিষ্টি বহন করে নিয়ে এসেছিলেন, তারাই বিডিআরের এই কিলিং মিশনে জড়িত। ’

বেলা ১১টা থেকে ১১টা ৩০ মিনিটের মধ্যে তৎকালীন স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক ও হুইপ মির্জা আজম পিলখানার দিকে যান। তখন পিলখানার ভেতর থেকে গুলির শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল। ‘এমন অবস্থায় যেখানে পিলখানার কাছাকাছি যেতে পারেননি কেউই। সেখানে তারা কীভাবে ভেতরে প্রবেশ করলেন? যেখানে র‌্যাবকে নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করিয়ে রাখা হয়েছিল, সেখানে গোলাগুলি বন্ধ করে বিদ্রোহী জওয়ানদের আলোচনায় বসার আহ্বান জানান এই দুই নেতা। ’

হ্যান্ড মাইকে ঘোষণা দিয়ে তখন তারা দুটি মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করার আহ্বান জানান। এরপর বিকেল তিনটার দিকে জাহাঙ্গীর কবির নানক ও মির্জা আজম সাদা পতাকা হাতে পিলখানার ভেতরে প্রবেশ করেন। ‘অথচ তাদের কাপড়ে একটু ধুলো পর্যন্ত লাগেনি, যা রীতিমতো অবাক করার মতো ঘটনা। ’ 

‘এদিকে তদন্তে আমরা জড়িত সন্দেহভাজনদের কল লিস্ট পর্যবেক্ষণ করি। যেখানে দেখতে পাই, তোরাব আলীর কাছে সিঙ্গাপুর ও ভারত থেকে কল আসে। ২২ থেকে ২৭ ফ্রেয়ারি মধ্য ১টি মিসড কল ও ৪টি কল আসে সিঙ্গাপুর থেকে আর ৪টি কল আসে ভারত থেকে ।  যেখান থেকে তৎকালীন তদন্ত কমিশন ধারণা করছে , সেই সময়ে জয় (সজীব ওয়াজেদ জয়) সিঙ্গাপুরে ছিলেন। তখন তার সঙ্গেই কথা চালিয়ে যাচ্ছিলেন তোরাব আলী।

বাংলাদেশ সময়: ২১১০ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৯, ২০২৫
আরএইচ/এজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।