ঢাকা: টানা ১৫ বছর নানা অনিয়মের কারণে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি দেশের পুঁজিবাজার। শেয়ার কারসাজি চক্র বাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা তুলে নিলেও রয়ে গেছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
নতুন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর গত আট মাসে বিভিন্ন অনিয়মের কারণে হাজার কোটি টাকার বেশি জরিমানা করেছে। কিন্তু আদায় হয়নি এক টাকাও।
কোনো ধরনের অনিয়মের কাছে মাথা নত করবে না বলেও ঘোষণা দিয়ে বিএসইসি নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, ইতিমধ্যে বিএসইসি নানা অনিয়মের কারণে বড় ধরনের জরিমানা করলেও এটা আদায়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। সবার আগে আইনের সংস্কার প্রয়োজন।
জরিমানা আদায় হয়েছে কি না জানা নেই উল্লেখ করে বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী সম্মিলিত পরিষদের সভাপতি আতাউল্লাহ নাঈম বাংলানিউজকে বলেন, দেশের পুঁজিবাজারের ইতিহাসে জরিমানা করে তা আদায় হওয়ার রেকর্ড আছে বলে আমার জানা নেই। এর কারণ হচ্ছে, সময়োপযোগী কার্যকর আইন না থাকা। নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিয়ে আইন প্রয়োগ করলে তা বাস্তবায়ন হতো। কিন্তু আইনি মারপ্যাঁচের ফাঁকে কারসাজি চক্র বেঁচে যাওয়ায় একই কাজ বারবার করার সুযোগ পায়। যার কারণে জেনেশুনেই তারা কারসাজি করে।
যে জরিমান করে আদায় করা যায় না, তা না করে বিকল্প শাস্তির ব্যবস্থা নিয়ে কমিশনকে ভাবতে হবে বলে মনে করেন ক্যাপিটাল মার্কেট জার্নালিস্ট ফোরামের সভাপতি গোলাম সামদানী ভূঁইয়া। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, সম্প্রতি আমরা দেখছি পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি বেশকিছু প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে বড় অংকের আর্থিক জরিমানা করেছে। যতটুকু জেনেছি, গত ৮ মাসে রাশেদ মাকসুদ কমিশনের জরিমানা করা অর্থের পরিমাণ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। বিশাল অংকের অর্থ জরিমানা করলেও বাস্তবে আদায়ের পরিমাণ একেবারে শূন্য বলা চলে। এই অবস্থায় আমি মনে করি, এ ধরনের অবাস্তব জরিমানা না করে বিকল্প কোনো শাস্তির ব্যবস্থা করা যায় কি না তা কমিশনকে ভাবতে হবে। কারণ জরিমানা করে যদি জরিমানার অর্থ আদায় করা না যায়, এই জরিমানা করার কোনো মানে হয় না। যাদেরকে অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে তাদের একটা বড় অংশ পরবর্তীতে আদালতে গিয়ে জরিমানা স্থগিতের অর্ডার নিয়ে এসেছে। ফলে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন তাদেরকে শাস্তি দেওয়ার জন্য যে অর্থ জরিমানা করেছিল তা কোনো কাজে আসেনি।
বিএসইসির আইনে বলা আছে, অর্ডার ইস্যুর পর একটা নির্দিষ্ট সময় দেওয়া থাকে, এই সময়ের মধ্যে জরিমানা পরিশোধ করতে হয়। এই সময়ে জরিমানা পরিশোধ না করলে প্রতিদিনের জন্য পুনরায় আরেকটি জরিমানার বিষয় রয়েছে এবং এটি পাওয়ার পরে পরবর্তী সময়ে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জের অর্ডিন্যান্স ৬৯- এর সেকশন- ২২ এর ধারায় জরিমানা করা হয়।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) পরিচালক ও মুখপাত্র মো. আবুল কালাম বলেন, যাদের বিরুদ্ধে জরিমানা করা হয়, তাদের কিছু রাইটস আছে। তারা ডিভিশন করতে পারেন অথবা রিভিউ করতে পারেন। ডিভিশনের জন্য আছে ৯০ দিন আর রিভিউয়ের জন্য আছে ১৮০ দিন। আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়ার জন্য এই সময়টা অপেক্ষা করতে হবে। ফলে প্রায় আট থেকে নয় মাস লেগে যাবে।
তিনি বলেন, যে প্রক্রিয়াগুলো রয়েছে, এতে কেউ যদি আবেদন করে বা কেউ কোনো মামলা নাও করে, কিন্তু ওই সময়টা ধরে আমাদেরকে যেতে হবে। এটা পাবলিক ডিমান্ড হিসেবে পিডিআর অ্যাক্টে সার্টিফিকেট কোর্টে আমরা মামলা করবো। আমরা জরিমানা করেছি। কেউ না দিলে এটা তো আর জোর করে নিয়ে আসতে পারবো না। মামলা করার পরে ওই কোর্ট তাকে সমন জারি ও ওয়ারেন্ট ইস্যু করে নিয়ে আসতে পারে। জরিমানা হলেই যে আদায় হয়ে যাবে, ঘটনাটা এমনও নয়। এছাড়া আরেকটি বিষয় রয়েছে, কেউ যদি আমাদের এই জরিমানাকে চ্যালেঞ্জ করে রিট করে। এই রিট নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত জরিমানার টাকা পাওয়া যাবে না।
তিনি আরো বলেন, কেউ চাইলে জরিমানার বিপরীতে রিভিশন রিভিউ (পুনর্বিবেচনা পর্যালোচনা) করতে পারে। রিভিউ করার পরেও সে মনে করলো এটা ঠিক নয়, পরবর্তীতে সে কোর্টে গিয়ে এটার জন্য মামলা করতে পারে। সে ক্ষেত্রে নিয়ম হলো, রিভিউ বা রিভিশন করতে ওই সংক্রান্ত চূড়ান্ত যে জরিমানা রয়ে গেলো, তার ১৫ শতাংশ কমিশনে জমা দিয়ে কোর্টে যেতে পারবে। কোর্ট যতক্ষণ এটা নিষ্পত্তি না করবে, ততক্ষণ এই জরিমানা আদায় হবে না। আইনের প্রক্রিয়া মেনেই আমাদের জরিমানা আদায় করতে হয়।
বিএসইসির এক কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, বর্তমান কমিশন দ্রুততম সময়ে বেশ কিছু এনফোর্সমেন্ট কার্যক্রম শেষ করে অর্ডার ইস্যু করেছে। অর্ডার ইস্যুর ক্ষেত্রে অর্ডারের মধ্যে একটা নির্দিষ্ট সময় দেওয়া থাকে যে এতদিনের মধ্যে জরিমানা পরিশোধ করতে হবে। তবে আদেশের ডেটের এই সময়ের মধ্যে জরিমানা না দিয়ে রিভিশন বা রিভিউ করতে পারেন অভিযুক্তরা। এক্ষেত্রে প্রত্যেকেই রিভিশন বা রিভিউ করেছে। রিভিউ আন্ডার প্রসেসে আছে। বেশ কিছু রিভিউ রিজেক্ট হয়েছে। আগের জরিমানাই বহাল আছে। এই রিভিউ প্রক্রিয়া শেষ হলে রিভিউয়ের আগের জরিমানা যদি বহাল থাকে, রিভিউতে আবার হেয়ারিং করে তাদের বক্তব্য শোনার পরে যদি জরিমানা বহাল থাকে, সেক্ষেত্রে ওই আদেশটাকে মহামান্য আদালতে চ্যালেঞ্জ করে রিট করতে পারে।
তিনি বলেন, এই আইনের প্রসেসগুলো যখন শেষ হবে, তারপরও যদি জরিমানা আদায় না হয় তখন সার্টিফিকেট কেস হবে। সার্টিফিকেট কেস হলো জরিমানা আদায়ের জন্য, আদালতের আদেশক্রমে পরবর্তীতে জরিমানা আদায় করা হয়। হাইকোর্ট যদি এই রায় স্থগিত করে দেয় তাহলে পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত কার্যক্রম স্থগিত থাকে আর যদি হাইকোর্ট নিষ্পত্তি করেও দেয় এরপরও মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের ফুল বেঞ্চেও আপিলের সুযোগ থাকে। এই আইনের সব লেয়ার সম্পূর্ণ হওয়ার পরই জরিমানা কত হলো বা কতটুকু আদায় হলো না তা বলা যাবে। কেননা প্রত্যেকটি লেয়ারে আবার পরিবর্তন এবং বিভিন্ন নির্দেশনাও আসতে পারে। আগামীতে যে সংস্কার হবে টাস্ক ফোর্সের যে সুপারিশ করবে সেগুলো বাস্তবায়িত হলে এবং গভর্নেন্স যদি কমিশন এনসিওর করতে পারে তাহলে আগামীতে একটি ম্যাচিউরড বাজার দেখতে পারবো, সে বাজারের যে গ্রোথ হবে সেটা টেকসই হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
এদিকে শেয়ার কারসাজিতে জড়িতদের বক্তব্য এবং তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা থেকে প্রতীয়মান হয়, উপস্থাপিত অভিযোগসমূহ সঠিক ও ইচ্ছাকৃত এবং কর্মকাণ্ডের ফলে পুঁজিবাজারের সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন যা পুঁজিবাজার উন্নয়নের পরিপন্থী, সেহেতু এক্ষেত্রে অভিযুক্তদের ব্যাখ্যা কমিশনের নিকট গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয়নি। যেহেতু অভিযুক্তদের কর্মকাণ্ড সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিনেন্স, ১৯৬৯ এর সেকশন ১৭(ই)(৫) এবং সেকশন ১৭(ই)(২) লংঘন করেছে, যা সিকিউরিটিজ আইনের পরিপন্থী। যেহেতু অভিযুক্তরা উপর্যুক্ত কর্মকাণ্ড সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিনেন্স, ১৯৬৯ এর সেকশন ২২ অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ: যেহেতু, কমিশনের বিবেচনায়, সিকিউরিটিজ আইন ও বিধি-বিধান পরিপালনে ব্যর্থতার জন্য, পুঁজিবাজারের শৃঙ্খলা, স্বচ্ছতা এবং জনস্বার্থে আলোচ্য ব্যক্তিদের জরিমানা করা হয়।
যেসব প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে জরিমানা করা হয়েছে
ইমাম বাটনের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে এক কোটি টাকা জরিমানা:
ইমাম বাটনের (বর্তমানে হামি ইন্ডাস্ট্রিজ) শেয়ার লেনদেনে সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘন করার অপরাধের কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাসিব হাসানকে এক কোটি টাকা জরিমানা করা হয়।
কর্ণফুলী ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার কারসাজি, ২০ লাখ টাকা জরিমানা:
কর্ণফুলী ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের শেয়ারের লেনদেনে কারসাজি করে সিকিউরিটিজ আইন ভঙ্গ করায় ৮ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ২০ লাখ টাকা জরিমানা করে বিএসইসি। এক্ষেত্রে শাহারা জামান ও তার সহযোগী আশফাকুজ্জামানকে আড়াই লাখ টাকা করে মোট ৫ লাখ টাকা, সিটি ব্যাংক ক্যাপিটাল রিসোর্সেস লিমিটেডকে ১০ লাখ টাকা এবং লুতফুল গনি টিটু, মাহমুদুল হাসান, খাইরুল হাসান বেনজু, লুতফুন্নাহার বেগম ও আকিকুন্নাহারকে ১ লাখ টাকা করে মোট ৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরন্সের শেয়ার কারসাজির ঘটনায় ১ কোটি ৬৩ লাখ টাকা জরিমানা:
প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরন্স কোম্পানি লিমিটেডের শেয়ার কারসাজিকে চিহ্নিত করে ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানসহ চার ব্যক্তি এবং তিন প্রতিষ্ঠানকে ১ কোটি ৬৩ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এর মধ্যে সাকিব আল হাসানকে ৫০ লাখ টাকা, আবুল খায়ের হিরুকে ২৫ লাখ টাকা, ইশাল কমিউনিকেশন লিমিটেডকে ৭৫ লাখ টাকা, মোনার্ক মার্ট লিমিটেডকে ১ লাখ টাকা, আবুল কালাম মাতব্বরকে ১০ লাখ টাকা, লাভা ইলেকট্রোডস ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডকে ১ লাখ টাকা এবং মো. জাহেদ কামালকে ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
সোনালী পেপারের তিন শেয়ারধারীকে ৬০ লাখ টাকা জরিমানা:
প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার কারসাজির অপরাধে সোনালী পেপারের তিন শেয়ারধারীকে ২০ লাখ টাকা করে মোট ৬০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। যাদের জরিমানা করা হয়ে তারা হলেন- সোনালী পেপারের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইউনুস, ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মাহফুজা ইউনুস ও পরিচালক মোহাম্মদ জাবেদ নোমান।
বেক্সিমকো লিমিটেডের চার ব্যক্তি ও পাঁচ প্রতিষ্ঠানকে ৪২৮ কোটি ৫২ লাখ টাকা জরিমানা:
শেয়ার কারসাজির অপরাধে বেক্সিমকো লিমিটেডের সংশ্লিষ্ট চার ব্যক্তি ও পাঁচ প্রতিষ্ঠানকে ৪২৮ কোটি ৫২ লাখ টাকা জরিমানা করে বিএসইসি। এর মধ্যে মুশফিকুর রহমানকে ১২৫ কোটি, মমতাজুর রহমানকে ৫৮ কোটি, আব্দুর রউফকে ৩১ কোটি ও মারজানা রহমানকে ৩০ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এছাড়া শেয়ার কারসাজির দায়ে পাঁচ প্রতিষ্ঠান যথাক্রমে ক্রিসেন্ট লিমিটেডকে ৭৩ কোটি, আর্ট ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডকে ৭০ কোটি, জুপিটার বিজনেস লিমিটেডকে সাড়ে ২২ কোটি, অ্যাপোলো ট্রেডিং লিমিটেডকে ১৫ কোটি ১ লাখ ও ট্রেডনেক্সট ইন্টারন্যাশনালকে ৪ কোটি ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। দেশের পুঁজিবাজারের ইতিহাসে একক কোন শেয়ার কারসাজিতে সর্বোচ্চ জরিমানা এটি।
বে-লিজিংয়ের শেয়ার কারসাজিতে ৪ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানকে ১৯ কোটি ৫৫ লাখ টাকা জরিমানা:
বে-লিজিংয়ের শেয়ার কারসাজির সঙ্গে জড়িত থাকায় ৪ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানকে ১৯ কোটি ৫৫ লাখ টাকা জরিমানা করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এর মধ্যে বে-লিজিংয়ের শেয়ার লেনদেনে সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘন করায় সাউথইস্ট ব্যাংক ক্যাপিটাল সার্ভিসেসকে ৫ লাখ টাকা এবং মূল্য সংবেদনশীল তথ্যের ভিত্তিতে আইন ভঙ্গ করে শেয়ার বিক্রি করায় সাউথইস্ট ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আলমগীর কবিরকে ১২ কোটি টাকা, বে-লিজিংয়ের তৎতকালীন পরিচালক অধ্যাপক সুরাইয়া বেগমকে ৫ কোটি টাকা এবং তুষার এলকে মিয়াকে ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করে বিএসইসি।
হিরু তার পরিবারের সদস্য এবং প্রতিষ্ঠানকে ১৩৪ কোটি ৫৪ লাখ টাকা জরিমানা:
তালিকাভুক্ত ৪ কোম্পানির শেয়ার কারসাজির দায়ে হিরু, তার পরিবারের সদস্য এবং প্রতিষ্ঠানকে ১৩৪ কোটি ৫৪ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। কোম্পানিগুলো হলো- ফরচুন সুজ, ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক এবং সোনালী পেপার।
ফাইন ফুডসের শেয়ার কারসাজিতে জড়িতদের ১.৯৬ কোটি টাকা জারিমানা:
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি ফাইন ফুডস লিমিটেডের শেয়ার নিয়ে কারসাজি করে কৃত্রিমভাবে দাম বাড়ানোর অভিযোগে চারজন বিনিয়োগকারী ও দুইটি প্রতিষ্ঠানকে ১ কোটি ৯৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। ২০২৩ সালের মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত অর্থাৎ চার মাসে কোম্পানটির শেয়ার কারসাজি করে দাম বাড়ায় কারসাজি চক্র।
আমিনুল-হিরু চক্রকে ১০ কোটি ১৩ লাখ টাকা জরিমানা:
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ওরিয়ন ফার্মাসিউটিক্যালসের শেয়ার কারসাজিতে জড়িত থাকার অভিযোগে নাবিল গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিনুল ইসলামকে ৩ কোটি ২০ লাখ টাকা, তার প্রতিষ্ঠান নাবিল ফিড মিলসকে ১০ লাখ টাকা ও আরেক প্রতিষ্ঠান নাবিল নাবা ফুডসকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। একই সঙ্গে এনআরবিসি ব্যাংকের শেয়ার কারসাজিতে জড়িত থাকার অভিযোগে সমবায় অধিদপ্তরে উপ-নিবন্ধক ও শেয়ার ব্যবসায়ী আবুল খায়ের হিরুকে ২.৩০ কোটি টাকা, তার বাবা আবুল কালাম মাতবরকে ৪.১৫ কোটি টাকা, তার স্ত্রী কাজী সাদিয়া হাসানকে ১১ লাখ টাকা, তার বোন কনিকা আফরোজকে ১ লাখ টাকা, তার মা আলেয়া বেগমকে ১ লাখ টাকা, তার ভাই মোহাম্মদ বাসারকে ১ লাখ টাকা, ভাই সাজিদ মাতবরকে ১ লাখ টাকা, তার প্রতিষ্ঠান ডিআইটি কো-অপারেটিভকে ১২ লাখ টাকা এবং তার আরেক প্রতিষ্ঠান মোনার্ক হোল্ডিংসকে ১ লাখ টাকা জরিমানা কর হয়।
তিন কোম্পানির শেয়ার কারসাজি, সাত প্রতিষ্ঠান ও ১২ ব্যক্তিকে ১৩৪ কোটি জরিমানা:
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত তিন কোম্পানির শেয়ার কারসাজির দায়ে সাত প্রতিষ্ঠান ও ১২ ব্যক্তিকে মোট ১৩৪ কোটি ১৮ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। দুই দফায় বাংলাদেশ ফাইন্যান্স লিমিটেডের শেয়ারে কারসাজি হয়। এর মধ্যে প্রথম দফায় কারসাজির দায়ে সিটি জেনারেল ইনস্যুরেন্স কোম্পানিকে ৮৫ লাখ টাকা এবং আনোয়ার গ্যালভানাইজিং লিমিটেডকে ৭ কোটি ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এ দফায় সমীর সেকান্দারকে ১০ লাখ, মেহের সেকান্দারকে ১০ লাখ, আবু সাদাত মো. সায়েমকে ৪ কোটি ৯০ লাখ ও আব্দুল মবিন মোল্লাকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। দ্বিতীয় দফায় শেয়ার কারসাজির কারণে সমীর সেকান্দারকে ২৩ কোটি ২৫ লাখ, মেহের সেকান্দারকে ৪২ লাখ, আবু সাদাত মো. সায়েমকে ১৭ কোটি ও অনিকা ফারহীনকে ৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করে কমিশন।
খান ব্রাদার্সের শেয়ার কারসাজি ৭ ব্যক্তি ও ৩ প্রতিষ্ঠানকে ৮৬ লাখ টাকা জরিমানা:
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের শেয়ার কারসাজির অভিযোগে ৭ ব্যক্তি ও ৩ প্রতিষ্ঠানকে মোট ৮৬ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩ থেকে ১২ নভেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত সময়ে বস্ত্র খাতের কোম্পানি খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগ ইন্ডাস্টিজের শেয়ারের দাম কারসাজি করে বাড়ানোর দায়ে সাত ব্যক্তি ও তিন প্রতিষ্ঠানকে এই জরিমানা করা হয়।
সাকিব-হিরুদের শেয়ার কারসাজি, ৩১ কোটি ৩৮ লাখ টাকা জরিমানা:
শেয়ার কারসাজিতে জড়িত থাকার অভিযোগ প্রমানীত হওয়ায় সাকিব, হিরু, তার পরিবারের সদস্য, সাকিব-হিরুর প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়িক পার্টনার রয়েছেন এমন ১০ ব্যক্তি এবং ৪ প্রতিষ্ঠানকে মোট ৩১ কোটি ৩৮ লাখ টাকা জরিমানা করে বিএসইসি।
২০২১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে সোনালী পেপার অ্যান্ড বোর্ড মিলসের শেয়ার কারসাজি করে দাম বাড়ানো হয়। কোম্পানিরর শেয়ার কারসাজিতে সাকিব-হিরুরা বিভিন্ন নামে একাধিক বিও হিসাব খুলে কোম্পানির শেয়ার সিরিজ ট্রেডিংয়ের মাধ্যমে অস্বাভাবিকভাবে দাম বাড়িয়ে মুনাফা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে বিএসইসির তদন্তে উঠে এসেছে।
ওরিয়ন ইনফিউশনের শেয়ার কারসাজি, জড়িতদের ৫৩.২৫ কোটি জরিমানা:
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ওরিয়ন ইনফিউশন লিমিটেডের শেয়ার কারসাজিতে জড়িত থাকার অভিযোগে বিনিয়োগকারী শাহাদাত হোসেন ও তার ১৪ সহযোগীকে ৫৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা জরিমানা করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। কোম্পানির শেয়ার কারসাজিতে জড়িতরা ২০টি বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) হিসাব ব্যবহার করে অনৈতিকভাবে সিরিজ ট্রানজেকশন (লেনদেন) করেন।
হিরু-সাদিয়াকে ১৯ কোটি টাকা জরিমানা:
এশিয়া ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার কারসাজির দায়ে আবুল খায়ের স্ত্রী কাজী সাদিয়া হাসানকে ১০ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়।
২ কোম্পানির শেয়ার কারসাজি, ১৮ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানকে ১৯০ কোটি জরিমানা:
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত দুইটি কোম্পানিটির শেয়ার কারসাজির অভিযোগে ৯ ব্যক্তি ও ৯ প্রতিষ্ঠানকে মোটি ১৮৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা জরিমানা করেছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড একচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। শেয়ার কারসাজি করা কোম্পানিগুলো হলো- সি পার্ল বিচ রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা লিমিটেড ও সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড।
২০২২ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ১০ আগস্ট পর্যন্ত সময়ে সি পার্ল বিচ রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা ও ২০২৩ সালের ১৮ এপ্রিল থেকে ১১ জুন পর্যন্ত সময়ে সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার যোগসাজোসের মাধ্যমে কারসাজি করে দাম বাড়ানো হয় বলে বিএসইসির তদন্তে উঠে আসে।
কোম্পানিটির শেয়ার কারসাজির অভিযোগে ৯ প্রতিষ্ঠান এবং ৪ ব্যক্তিকে মোট ১৮৭ কোটি ২২ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। জরিমানা করা ব্যক্তিদের মধ্যে মো. কালাম হোসেনকে ১৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা, অন্যদের মধ্যে আবু সাদাত মো. ফয়সালকে ৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা, জামরুল হাসান মো. ইকবাল গণিকে ১ লাখ টাকা এবং মো. আবু নাঈমকে ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
জরিমানা করা ৯ট প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ইউডিসি কনস্ট্রাকশনকে ৬৮ কোটি ১ লাখ টাকা, ভেনাস বিল্ডার্সকে ৬৯ কোটি ১ লাখ টাকা, সাতরং অ্যাগ্রো ফিশারিজকে ২৫ কোটি ৫১ লাখ টাকা, হৃদয় পোল্ট্রি ফার্মকে ১০ লাখ টাকা, হাসান নার্সারিকে ২ লাখ টাকা, আমানত অ্যাগ্রো ফিশারিজকে ৪০ লাখ টাকা, সাব্বির স্টোরকে ১০ লাখ টাকা, সরকার অ্যাগ্রো ফার্মকে ১ লাখ টাকা এবং মুক্তা ফিশারিজকে ৪ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিটির শেয়ার কারসাজির অভিযোগে ৫ ব্যক্তিকে মোট ২ কোটি ৭৩ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। জরিমানা করা ব্যক্তিদের মধ্যে নূরজাহান বেগমকে ১ লাখ টাকা, সাজিদুল হাসানকে ৭৫ লাখ টাকা, সায়েদুর রহমানকে ১ লাখ টাকা, ফেরদৌসি বেগমকে ১ কোটি ৯৫ লাখ টাকা ও লুৎফর রহমানকে ১ লাখ টাকা জরিমানা করে কমিশন।
জেমিনি সি ফুডের কারসাজি, ৩.৮৫ কোটি টাকা জরিমানা:
পুঁজিবাজারে খাদ্য ও আনসুঙ্গিক খাতে তালিকাভুক্ত কোম্পানি জেমিনি সি ফুড লিমিটেডের শেয়ার কারসাজির অভিযোগে ৫ ব্যক্তিকে মোট ৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকা জরিমানা করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এর মধ্যে বিকন ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ এবাদুল করিমকে ১১ লাখ টাকা, তার মেয়ে রিসানা করিমকে ২.১২ লাখ টাকা, তার ছেলে উফাত করিমকে ১.৪১ লাখ টাকা, তার শ্যালক সোহেল আলমকে ১০ লাখ টাকা ও ফাতেমা সোহেলকে ১১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজের কারসাজি, রাভী হাফিজকে ১৫ কোটি টাকা জরিমানা:
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের শেয়ার কারসাজিতে জড়িত থাকার অভিযোগে বিনিয়োগকারী গাজী রাভী হাফিজকে ১৫ কোটি টাকা জরিমানা করে বিএসইসি। ২০২৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি থেকে ৯ মে পর্যন্ত সময়ে আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজের শেয়ার যোগসাজশের মাধ্যমে কারসাজি করে দাম বাড়ানো হয়। কোম্পানির শেয়ার কারসাজিতে গাজী রাভী হাফিজ ৪টি বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) হিসাব খুলে সিরিজ ট্রেডিংয়ের মাধ্যমে অস্বাভাবিকভাবে দাম বাড়িয়ে মুনাফা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে বিএসইসির তদন্তে উঠে আসে। তিনি প্রাইম ব্যাংক ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডে পোর্টফোলিও ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেছেন।
সাকিব-হিরুকে ২ কোটি ১৮ লাখ টাকা জরিমানা:
শেয়ার কারসাজিতে জড়িত থাকার অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় সাকিব, হিরু ও তার পরিবারের সদস্য, তাদের প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়িক পার্টনার রয়েছেন এমন ৮ ব্যক্তি এবং ৪ প্রতিষ্ঠানকে মোট ২ কোটি ২১ লাখ টাকা জরিমানা করে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি।
এসএমএকে/এজে