ঢাকা, শনিবার, ১০ শ্রাবণ ১৪৩২, ২৬ জুলাই ২০২৫, ০০ সফর ১৪৪৭

বাংলানিউজ স্পেশাল

পাশাপাশি কবরে ‌‘একই গাছের তিন ফুল’

সুব্রত চন্দ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩:৩৬, জুলাই ২৪, ২০২৫
পাশাপাশি কবরে ‌‘একই গাছের তিন ফুল’ কবর

এক বছরের ব্যবধানে জন্ম হয়েছিল উত্তরার মাইলস্টোন স্কুলের শিক্ষার্থী মাহিদ হাসান আরিয়ান (১১), মো. আশিকুর রহমান উমাইর (১০) ও বোরহান উদ্দিন বাপ্পির (১০)। একই বংশের হওয়ার তাদের সম্পর্ক চাচা-ভাতিজার, বাড়িও পাশাপাশি।

পিঠাপিঠি হওয়ায় একসঙ্গেই ছিল তাদের বেড়ে ওঠা, খেলাধুলা। স্কুলেও যাওয়া-আসা করতো একসঙ্গে। কিন্তু গত সোমবার স্কুলে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনা, নিভিয়ে দেয় তাদের জীবন প্রদীপ।

গত সোমবার (২১ জুলাই) রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি ভবনে বিধ্বস্ত হয় বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান এফটি-৭ বিজিআই। এ সময় স্কুলেই ছিল আরিয়ান, উমাইর ও বাপ্পি। আরিয়ান ওই স্কুলের চতুর্থ, উমাইর ও বাপ্পি ছিল তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। তারা তিনজনই বিমান বিধ্বস্তের আগুনে পুড়েছে।  

তাদের তিনজনের পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছে বাংলানিউজ। কথা বলে জানা গেছে, বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় উমাইর ঘটনাস্থলেই আগুনে পুড়ে মারা গেছে। কিন্তু তার লাশ মেলে গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে। আরিয়ানকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করে প্রথমে বাংলাদেশ মেডিকেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে তাকে এভারকেয়ার হাসপাতাল, পরে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে নেওয়া হয়। সেখানে সোমবার দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে তার মৃত্যু হয়।  

জীবিত উদ্ধার হয়েছিল বাপ্পিও। তাকে ইউনাইটেড হাসপাতাল, পরে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে নেওয়া হয়। মঙ্গলবার (২২ জুলাই) ভোর সাড়ে ৬ টার দিকে মৃত্যু হয় বাপ্পির।  

পরিবারগুলোর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আরিয়ান, উমাইর ও বাপ্পির জানাজা হয়েছে একসঙ্গে। দাফনও করা হয়েছে পাশাপাশি। মাইলস্টোন থেকে দশ মিনিটের পায়ে হাটা রাস্তা, সেখানে দিয়াবাড়ি তারারটেক মসজিদপাড়া এলাকা। ওই মসজিদের সামনেই পারিবারিক কবরস্থান, যেখানে চিরনিদ্রায় রয়েছে তিন চাচা-ভাতিজা। তাদের হারিয়ে পরিবারের সমস্ত লোকজন শোকে স্তব্ধ, বাকরুদ্ধ হয়ে আছে এলাকার মানুষও।

সরেজমিনে দেখা গেছে, হাঁটু সমান প্রাচীর দিয়ে ঘেরা কবরস্থানটিতে ১১টি কবর, এর মধ্যে তিনটি নতুন। এই তিনটিতেই শুয়ে আছে আরিয়ান, উমাইর ও বাপ্পির। বৃষ্টির পানি যাতে না ঢুকে সেজন্য কবরগুলো ঢেকে রাখা হয়েছে প্লাস্টিক দিয়ে। প্লাস্টিক যাতে উড়ে না যায়, সেজন্য প্রতিটি কবরের ওপর দিয়ে রাখা হয়েছে গাছের ডাল।

বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) সকালে সেই কবরস্থানের পাশে দাঁড়িয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখা যায় আরিয়ানের চাচাতো ভাই সৈকত হোসেনকে। কথা বলে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ওইদিন দুপুরে হঠাৎই বিকট শব্দ শুনি। কিছুক্ষণ পরেই বিভিন্ন মানুষের কাছে জানতে পারি স্কুলে বিমান ভেঙে পড়েছে। ছোট ভাই ও ভাতিজাদের খোঁজে দৌড়ে যাই ঘটনাস্থলে। গিয়ে দেখি সেনাবাহিনী আরিয়ানকে স্ট্রেচারে করে অ্যাম্বুলেন্সে উঠাচ্ছে। তাদের সঙ্গে উঠে পড়ি। প্রথমে তাকে বাংলাদেশ মেডিকেলে নেওয়া হয়, পরে সেখান থেকে অ্যাপোলোয় নেওয়া হয়। কিন্তু সেখানকার চিকিৎসকরা তাকে রাখেনি। পরে বার্ন ইনস্টিটিউটে নিয়ে যাই। ওই অ্যাম্বুলেন্সে তানভীর নামে আরেকটি ছেলে ছিল, পথে তার মৃত্যু হয়।

সৈকত বলেন, অসুস্থতার কারণে এক মাস স্কুলে যায়নি আরিয়ান। সুস্থ হওয়ায় সোমবার তাকে স্কুলে পাঠানো হয়। সেদিন টিফিন খাওয়ার পর এক্সট্রা ক্লাসের জন্য অপেক্ষা করছিল আরিয়ান। কিন্তু কে জানতো, এই এক্সট্রা ক্লাসই তার কাল হবে। স্কুল কর্তৃপক্ষ সবাইকে এক্সট্রা ক্লাসের জন্য বাধ্য করতো বলে অভিযোগ করেন তিনি।  

আরিয়ান, উমাইর, বাপ্পি খুবই ভালো শিক্ষার্থী ছিল বলে জানিয়েছে পরিবার। আরিয়ানের বড় চাচার মেয়ে মুক্তি বলেন, তাদের পড়াশোনা নিয়ে কখনো কোনো শিক্ষক অভিযোগ জানাননি। তাদের মতো ভদ্র ছেলে নেই। যা বলতো তাই করতো।

প্রিয় সন্তানকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ আরিয়ানের বাবা সেলিম আহমেদ। কবরটির পাশেই তার বাসা। সেই বাসায় গিয়ে দেখা যায়, একটি ঝুড়ির মধ্যে পড়ে আছে আরিয়ানের খেলার ফুটবলটি। শোয়ার ঘরের আরিয়ানের টেবিলে বই-খাতাগুলো এখনো যেন আরিয়ানের অপেক্ষায় রয়েছে। সাজানো বই-খাতাগুলোর মধ্যেই একটি খাতা টেবিলের সামনে রাখা। শেষবার স্কুলে যাওয়ার আগে ওই খাতায় কিছু লিখেছিল আরিয়ান।

সেলিম আহমেদ বলেন, আরিয়ান সবার আদরের ছিল। তার হজ করার ইচ্ছা ছিল। এজন্য তাকে পাসপোর্ট করে দিতেও বলতো সে। তার ঈমানী শক্তি অনেক বেশি ছিল। পোড়া শরীর নিয়ে যখন সে হাসপাতালে কাতরাচ্ছিল তখন বলছিল, আব্বু আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। তার আম্মুকে বলে, আম্মু তুমি কাইন্দো না। তার অবস্থা দেখে আমি কোনো উত্তর দিতে পারি নাই।

মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগেও মাকে সান্ত্বনা দিয়েছিল আরিয়ান। পান করতে চেয়েছিল একটু পানি, কিন্তু পায়নি। আরিয়ানের বড় চাচা নাজমুল আলম বলেন, মৃত্যুর পাঁচ মিনিট আগে তার মাকে কাঁদতে নিষেধ করে আরিয়ান। তার ঠোঁটটা একটু ভিজিয়ে দিতে বলেছিল। পরে এক গ্লাস পানি খেতে চেয়েছিল। কিন্তু চিকিৎসকরা বলেছিল পানি না খাওয়াতে। তার অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। মাথা থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত চামড়া ঝুলে পড়েছিল।

আরিয়ানদের বাসার পাশের বাপ্পিদের বাড়ি। আরিয়ানদের বাড়ি থেকে তার বাড়িতে যাওয়ার পথেই কবরস্থানের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় বাপ্পির বাবা শাহ আলীকে। তিনি বলেন, ঘটনার কিছুক্ষণ আগেই বাপ্পিকে খাবার দিয়ে এসেছিল তার মা। স্কুল থেকে ছোট ছেলেকেও নিয়ে আসে। যদি বাপ্পিকে আমার স্ত্রী নিজ হাতে খাবার খাইয়ে আসতো, তাহলে তাকে ও আমার ছোট ছেলেকেও আর পেতাম না।

তিনি অভিযোগ করেন, মাইলস্টোনের পড়াশোনা ভালো, বাড়িরও কাছে। তাই আমাদের পরিবারের বেশিরভাগ সন্তানরা ওইখানেই পড়তে। অনেক টাকা বেতন নিতো। কিন্তু আমাদের সন্তানদের নিরাপত্তা তারা দিতে পারেনি।

তারা জানান, চাচা-ভাতিজার সম্পর্ক হলেও আরিয়ান, উমাইর ও বাপ্পি ছিল বন্ধুর মতো। উমাইরও আরিয়ান এবং বাপ্পির মতো লেখা পড়ায় ভালো ছিল। একসঙ্গে খেলাধুলা, নানা আয়োজনে ঘরকে মাতিয়ে রাখতো তারা দুজন। উমাইরের শোকে তার বাবা-মা স্তব্ধ হয়ে গেছেন। কারও সঙ্গে তেমন কথা বলছেন না।  

এলাকাবাসীর সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, বয়স অল্প হলেও এই তিনজন খুব ভদ্র স্বভাবের ছিল। সবার সঙ্গে হাসি দিয়ে কথা বলতো। একই বংশ, একই পাড়া, একই স্কুল, একই স্বপ্ন

— সবই এখন তিনটি কবরের নীরবতায় মিশে গেছে।
 একই গাছের তিন ফুল ঝরে গেছে এক ঝড়েই।

 সৃষ্টিকর্তা এই পরিবারগুলোকে শোক সইবার ক্ষমতা দিক, সেই দোয়াই করেন তারা।  

এসসি/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।