ঢাকা, শুক্রবার, ৬ ভাদ্র ১৪৩২, ২২ আগস্ট ২০২৫, ২৭ সফর ১৪৪৭

বাংলানিউজ স্পেশাল

আশ্রয়ণ প্রকল্প ছিল তোফাজ্জল মিয়ার আলাদীনের চেরাগ

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১:০৩, আগস্ট ২১, ২০২৫
আশ্রয়ণ প্রকল্প ছিল তোফাজ্জল মিয়ার আলাদীনের চেরাগ তোফাজ্জাল হোসেন মিয়া

ঢাকা থেকে চেক যেত প্রকল্প এলাকায়। সেই চেক ‘ক্যাশ’ হয়ে ঢাকায় ফিরতো।

সেই ‘ক্যাশ টাকা’ আবার বিভিন্ন ‘মাধ্যমে’ চলে যেতো বিদেশে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখ্যসচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়া এভাবে মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন।  

দেশেও করেছেন অঢেল সম্পদ। বিশেষকরে আশ্রয়ণ প্রকল্পের দায়িত্বভার পাওয়ার পর যেনো আলাদীনের চেরাগ হাতে পান এ তোফাজ্জল। অবশ্য শেখ হাসিনার ‘আস্থাভাজন’ প্রভাবশালী এ কর্মকর্তার খোঁজ নেই গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে। একাধিক অভিযোগে অভিযুক্ত সাবেক এ কর্মকর্তার খোঁজ পাচ্ছে না পুলিশ কিংবা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তবে অনিময়, দুর্নীতি, ঘুষ গ্রহণ, তদবির বাণিজ্যের পাশাপাশি ক্ষমতার অপব্যাহরের অভিযোগে দুদক অনুসন্ধানে নেমেছে। কূটকৌশলে আশ্রয়ণ প্রকল্পের কোটি কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগের প্রাথমিক তথ্য-প্রমাণও দুদক পেয়েছে। তোফাজ্জলের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছেন বিভিন্ন প্রকল্প এলাকার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও। তারা এ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নানা অনিময়, দুর্নীতি, ঘুষ গ্রহণ, তদবির বাণিজ্যের পাশাপাশি ক্ষমতার অপব্যাহরের অভিযোগও তুলেছেন।  

বাগেরহাট জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের একজন সাবেক কর্মকর্তা জানান, মুজিববর্ষ উপলক্ষে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণের জন্য সরকারি বরাদ্দের টাকা চেকের মাধ্যমে জেলা প্রশাসকদের কাছে পৌঁছাতো। এই চেক ক্যাশ করে নগদ টাকা ঢাকায় ফিরিয়ে আনা হতো। পরবর্তী সময়ে এই টাকা বিভিন্ন মাধ্যমে বিদেশে পাচার করা হতো। এভাবে শত শত কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে।

বরিশাল ডিসি অফিসের সাবেক ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে চেক আসতো, সেটি ক্যাশ করে ঢাকায় ফিরতো। শুধু বাগেরহাট নয়, প্রায় সব জেলা থেকেই এভাবে টাকা ঢাকায় ফেরত যেত। ’

পিরোজপুর জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের আরেক সাবেক এক কর্মকর্তা জানান, আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণে বরাদ্দকৃত টাকা রেখে প্রায় বিনামূল্যে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নির্মাণসামগ্রী সংগ্রহ করে ব্যয় দেখানো হতো। তিনি বলেন, ‘এ অঞ্চলের প্রায় সব জেলা-উপজেলায় ঘর নির্মাণে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বিনামূল্যে ইট, বালু, রড, সিমেন্ট সংগ্রহ করা হতো। তোফাজ্জল স্যারের চাচা পরিচয়ে একজন এই টাকার ভাগ নিতেন। ’

এই প্রক্রিয়ায় জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা (ইউএনও) সরাসরি জড়িত ছিলেন তোফাজ্জলের সঙ্গে। তারাও এই লোপাটের টাকার ভাগ পেতেন বলে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। মুজিববর্ষের ঘর নির্মাণে ভাগ্য খুলেছে ডিসি-ইউএনওদেরও। তবে সিংহভাগ টাকা তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার পকেটে যেত বলে অভিযোগ রয়েছে।  

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মুজিববর্ষে আশ্রয়ণ প্রকল্পের দায়িত্ব পেয়ে তোফাজ্জল হোসেন মিয়া এটিকে ব্যক্তিগত সম্পদ বৃদ্ধির ‘আলাদীনের চেরাগ’ হিসেবে ব্যবহার করেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিনিয়র সচিব হিসেবে তিনি এই প্রকল্পের সার্বিক তত্ত্বাবধান করতেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পূর্ণ আস্থা অর্জন করায় তিনি এই প্রকল্পের সব দায়িত্ব একাই পালন করতেন। জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের মাধ্যমে তিনি ঘর নির্মাণের কাজ সম্পন্ন করেন। প্রতিটি ঘর নির্মাণের জন্য অঞ্চলভেদে সরকারি বাজেট নির্ধারণ করা হতো সোয়া এক লাখ থেকে পৌনে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত। তোফাজ্জল নিজেই এই বাজেট নির্ধারণ করতেন। তবে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বিনামূল্যে নির্মাণসামগ্রী সংগ্রহ করে ঘর নির্মাণ করা হতো।

চাঁদপুরের ইটভাটা মালিক সমিতির একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি বলেন, ‘এ জেলার সব ঘর নির্মাণে স্থানীয় ইটভাটা থেকে বিনামূল্যে ইট দেওয়া হয়েছে। বালুও ফ্রি দেওয়া হয়েছে। ’ কিছু কিছু উপজেলায় মিস্ত্রীদের খরচও স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বহন করেছেন।  

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তোফাজ্জল হোসেন মিয়া সারা দেশে ডিসি ও ইউএনওদের নিয়ে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিলেন। এক পর্যায়ে ডিসি-ইউএনওদের খুঁটির জোর হয়ে ওঠেন তোফাজ্জল। এই সিন্ডিকেট তার নির্দেশে আশ্রয়ণ প্রকল্পের টাকা লোপাটের কাজ সম্পন্ন করত। স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বিনামূল্যে নির্মাণসামগ্রী সংগ্রহ করা হতো, যা স্থানীয় প্রশাসনের সুনজরে থাকার জন্য ব্যবসায়ীরা স্বেচ্ছায় দিতেন। এভাবে আশ্রয়ণ প্রকল্পের সরকারি বরাদ্দের পুরো টাকা জেলা প্রশাসকদের কাছে জমা রাখা হতো, যা পরে ঢাকায় তোফাজ্জলের কাছে পৌঁছে যেত।

জানা গেছে, তোফাজ্জল হোসেন মিয়া পিরোজপুরের ভান্ডারিয়ায় তার পৈতৃক মিয়াবাড়িতে একটি চারতলা ভবন নির্মাণ করেছেন এবং এলাকায় বিপুল জমির মালিকানা অর্জন করেছেন। কম মূল্যে জমি কিনতেন তিনি। এতিমখানা মাদ্রাসার নামে দান-দাক্ষিণ্য নিতেন বলেও অভিযোগ আছে। ঢাকার কল্যাণপুরের ১১ নম্বর রোডে ৫৭/১ নম্বর প্লটে তার একটি বাড়ি রয়েছে। এছাড়া শ্বশুরের নামে ‘প্রত্যাশা ভবন’ নামে আরেকটি বাড়ি, উত্তরার দিয়াবাড়িতে সওজ-এর জায়গায় একটি প্লট ও ফ্ল্যাট, পূর্বাচল এবং বিসিএস অ্যাডমিন হাউজিং সোসাইটিতে তার নামে প্লট রয়েছে। পূর্বাচলে ৩০ কাঠার মত জায়গায় ডুপ্লেক্স বাড়ি নির্মাণ করেন। বিদেশে ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রীর নামে সম্পদের তালিকা আরও বিস্তৃত।  

অভিযোগ রয়েছে, ভান্ডারিয়ার সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মিরাজুল ইসলাম মিরাজ তাকে দুবাইয়ে একটি ফ্ল্যাট উপহার দিয়েছেন। এছাড়া কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় তার নামে বা পরিবারের সদস্যদের নামে সম্পত্তি রয়েছে। এমনকি, তার বাবার নামে একটি অস্তিত্বহীন এতিমখানার অনুকূলে সরকারি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ওই এতিমখানার নিবন্ধন ২০২৪ সালের জুনে নেওয়া হলেও, সেখানে থাকা কোনো ছাত্রই এতিম নয়।  

তোফাজ্জল হোসেন মিয়া প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দীর্ঘদিন শীর্ষ পদে থাকায় এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রীর আস্থা অর্জন করায়, তিনি তদবির বাণিজ্য ও পদ-পদবি বাণিজ্যেও জড়িত ছিলেন। বড় পদে যাওয়া, ডিসি হওয়া, বদলি বা বড় টেন্ডার পাওয়ার ক্ষেত্রে তার কাছে ধরনা দিতে হতো। অভিযোগ রয়েছে, তার স্ত্রী আফরোজা খান এবং চাচা পরিচয়ে এক ব্যক্তিও এই বাণিজ্যে জড়িত ছিলেন। শেষ দিকে ভালো জেলায় ডিসি নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্য পুরোটাই তোফাজ্জলের স্ত্রী দেখতেন।  

বিসিএস-২৭তম ব্যাচের একজন কর্মকর্তা জানান, তিনি একটি নির্দিষ্ট জেলায় ডিসি হওয়ার জন্য তোফাজ্জলের স্ত্রীকে ৩ কোটি টাকা অগ্রিম দিয়েছিলেন, কিন্তু এখনো পদ পাননি এবং টাকাও ফেরত পাননি।  

২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে তোফাজ্জল হোসেন মিয়া আত্মগোপনে রয়েছেন। গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতা হত্যা মামলায় তার নাম আসামির তালিকায় রয়েছে। তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ ২০২৪ সালের ৭ আগস্ট বাতিল করা হয়। এর আগে ২০২২ সালের ৭ ডিসেম্বর তিনি মুখ্যসচিব হিসেবে নিয়োগ পান এবং ২০২৩ সালের ৪ জুলাই থেকে এক বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান, যা ২০২৪ সালের ২৬ জুন আরও এক বছর বাড়ানো হয়।

আইএইচ/এজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।