সমন্বিত অনলাইন সত্যায়ন ব্যবস্থাপনা (এপোস্টিল সেবা) চালু করার ফলে বিদেশগামী অথবা বিদেশে অবস্থানকারী শিক্ষার্থী, পেশাজীবীদের ভোগান্তি অনেক কমেছে। খুব সহজেই এখন অনলাইনেই তারা বিভিন্ন সার্টিফিকেট সত্যায়ন করতে পারছেন।
চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সমন্বিত অনলাইন সত্যায়ন ব্যবস্থাপনার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। তবে ২০২৪ সালের নভেম্বর থেকে এপোস্টিল সেবা চালু করা হয়। এই সেবা চালুর পর থেকেই দ্রুত সেবা পাচ্ছেন বিদেশগামীরা। এপোস্টিল কনভেনশন-১৯৬১ অনুযায়ী অনলাইন সত্যায়ন সম্পন্ন হচ্ছে।
প্রতি মাসে দেড় লাখ নথি সত্যায়ন
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এপোস্টিল সেবা চালু হওয়ায় প্রতি মাসে এখন প্রায় দেড় লাখ নথি অনলাইনে সত্যায়ন করা হচ্ছে। গত মে ও জুন মাসে ২ লাখ ৯৩ হাজার নথি এপোস্টিলে সত্যায়ন করা হয়েছে। এ ছাড়া গত বছর ১০ ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের মে মাসের তথ্য অনুযায়ী, এপোস্টিল সিস্টেমে বোর্ড সার্টিফিকেট সত্যায়নে মোট আবেদন এসেছে ৭৭ হাজার ১৪৯টি। এরমধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ৭১ হাজার ৮২২টি। বিশ্ববিদ্যালয় সার্টিফিকেটের জন্য আবেদন ছিল ২৫ হাজার ৭৮টি, নিষ্পত্তি হয়েছে ২০ হাজার ৮১৩টি। মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের আবেদন ২৭৪টি, নিষ্পত্তি ১৭৯টি। মেডিকেল ইনস্টিটিউটের আবেদন ছিল ২০৫টি, নিষ্পত্তি হয়েছে ১০০টি।
এপোস্টিল সেবা কী
এপোস্টিল (Apostille) হলো একটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, যা কোনো দেশের সরকারি দলিলপত্র (যেমন: জন্ম নিবন্ধন, শিক্ষাগত সনদ, বিবাহ সনদ) অন্য দেশে ব্যবহারের জন্য সত্যায়ন করে। এপোস্টিল কনভেনশন-১৯৬১ এর নিয়ম মেনে কোনো পাবলিক ডকুমেন্টের সত্যায়নের সনদ হিসেবে দেওয়া হয়। এটি সেই ডকুমেন্টের উৎপত্তির সঠিকতা প্রত্যয়ন করে। এপোস্টিল সার্টিফিকেটের ব্যবস্থাপনা ও প্রযুক্তির মাধ্যমে বিশ্বের যেকোনো স্থান থেকে এপোস্টিলকৃত ডকুমেন্টের উৎপত্তির সঠিকতা যাচাই করা যায়। এ কনভেনশনের পক্ষভুক্ত দেশের বর্তমান সংখ্যা ১২৭টি।
বিদেশগামী ও বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি নাগরিকদের বিভিন্ন প্রয়োজনে একাডেমিক সার্টিফিকেট ও বিভিন্ন ধরনের ডকুমেন্ট বর্তমান প্রচলিত পদ্ধতিতে সংশ্লিষ্ট সার্টিফিকেট বা ডকুমেন্ট প্রদানকারীসহ একাধিক কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সত্যায়নসহ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সত্যায়ন করে। সত্যায়ন শেষে ঢাকায় অবস্থিত বিদেশি দূতাবাস, বিদেশ গমনের পর সে দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সত্যায়ন করতে হয়। এ ছাড়া যেসব দেশের দূতাবাস ঢাকায় নেই সেসব দেশের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য সমবর্তীভাবে নিয়োজিত পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর দূতাবাস থেকে ডকুমেন্ট সত্যায়নের জন্য বাংলাদেশি সেবাপ্রার্থীদের সেসব দেশে যেতে হয়।
এই প্রক্রিয়াগুলো সম্পন্ন করতে নাগরিকদের অনেক সময়, শ্রম ও অর্থ ব্যয় করতে হয়। নাগরিকদের এ সমস্যা নিরসনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ এপোস্টিল কনভেনশন-১৯৬১-এ পক্ষভুক্ত হয়। এপোস্টিল কনভেনশনের পক্ষভুক্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পাবলিক ডকুমেন্টের সত্যায়নের সনদ হিসেবে এপোস্টিল সার্টিফিকেট দেয়। এই এপোস্টিল সার্টিফিকেট ব্যবহার করলে সেবাপ্রার্থীদের সময় ও অর্থ ব্যয় করে ঢাকাস্থ বিদেশি দূতাবাস এবং বিদেশে গমনের পর সেই দেশে অবস্থিত অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে তাদের ডকুমেন্টগুলো আর সত্যায়ন করতে হয় না। এ ছাড়া এপোস্টিল সার্টিফিকেটে বিদ্যমান কিউআর কোড স্ক্যান করে বিশ্বের যেকোনো স্থান থেকে এপোস্টিলকৃত ডকুমেন্টের উৎপত্তির সঠিকতা যাচাই করতে পারে।
প্রতি বছর প্রায় ৭০০ কোটি টাকা সাশ্রয়
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বিদেশি দূতাবাসগুলো প্রতি পাতা ডকুমেন্ট সত্যায়ন করতে ৩ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত সার্ভিস ফি আদায় করে থাকে। এপোস্টিল প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন হওয়ায় বিদেশি দূতাবাসে সার্ভিস ফি দিয়ে ডকুমেন্ট সত্যায়ন করতে হচ্ছে না। এতে বাংলাদেশি নাগরিকদের প্রতি বছর প্রায় ৫০০ থেকে ৭০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে।
কমেছে দালালদের দৌরাত্ম্য
সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে ডকুমেন্টের হার্ড কপিতে ম্যানুয়ালি সত্যায়ন করার সময় সেবাপ্রার্থীরা দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকেন। এই ভোগান্তি এড়াতে অনেক সময় দালালের খপ্পরে পড়েন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এপোস্টিল প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন হওয়ায় এখন দালাল ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমেছে। একই সঙ্গে জাল বা নকল সিল ও স্বাক্ষরের মাধ্যমে সত্যায়ন করার প্রবণতাও কমেছে।
এপোস্টিলে যেভাবে কাজ হয়
বিদেশগামী শিক্ষার্থী ও পেশাজীবীরা তাদের ডকুমেন্টগুলো সত্যায়নের জন্য www.mygov.bd পোর্টালে গিয়ে এপোস্টিল সার্টিফিকেট প্রাপ্তির জন্য অনলাইনে আবেদন করতে পারেন। ডকুমেন্টটি ইস্যুকারী কর্তৃপক্ষ যাচাইপূর্বক সত্যায়ন সম্পন্ন করে তা নিয়ন্ত্রণকারী মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে থাকে। নিয়ন্ত্রণকারী মন্ত্রণালয় ডকুমেন্টটি প্রতি সত্যায়ন করে অনলাইনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এপোস্টিল কনভেনশনের নিয়ম মেনে ডকুমেন্টটিতে প্রতি সত্যায়ন করে। সত্যায়নের সনদ হিসেবে অনলাইনে ই-এপোস্টিল (e-Apostille) সার্টিফিকেট দেয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক সত্যায়ন কার্যক্রম সম্পন্ন হলে সেবাপ্রার্থীর রেজিস্ট্রেশনকৃত মোবাইল নম্বরে নোটিফিকেশন যায়। সেবাপ্রার্থীরা তাদের মাইগভ পোর্টালের ব্যক্তিগত ড্যাশবোর্ডের ‘ডাউনলোড’ বাটনে ক্লিক করে ই-এপোস্টিল সার্টিফিকেট ডাউনলোড করে নিতে পারেন।
এপোস্টিলে যেসব সেবা মেলে
বর্তমানে বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ, চাকরির আবেদন, বিদেশে স্থায়ী হওয়া, বিদেশি নাগরিকদের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনসহ নানাবিধ প্রয়োজনে বিদেশগামী ও বিদেশে অবস্থানরত নাগরিকদের বিভিন্ন দলিলাদি (যেমন: জন্ম নিবন্ধন, শিক্ষাগত সনদ, বিবাহ সনদ) একাধিক কর্তৃপক্ষের সত্যায়নের প্রয়োজন হয়। এখন এপোস্টিলে এসব ডকুমেন্টস সত্যায়ন হয়ে থাকে। এপোস্টিল সেবা চালু হওয়ার আগে দেশের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সত্যায়নসহ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সত্যায়ন শেষে সেবাপ্রার্থীদের পুনরায় বিদেশি দূতাবাস, সংশ্লিষ্ট দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বিদেশি বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের কাছে সত্যায়নের জন্য উপস্থিত হতে হতো। যা ছিল অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ, শ্রমসাধ্য এবং ব্যয়বহুল। তবে এপোস্টিল সেবা চালু হওয়ার পর এখন ভোগান্তি কমেছে।
যেভাবে এপোস্টিলে যুক্ত হলো বাংলাদেশ
এপোস্টিল কনভেনশনে যুক্ত হওয়ার জন্য বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিল। অবশেষে ২০২৪ সালের ২৯ জুলাই বাংলাদেশ ‘দ্য কনভেনশন অন এবোলিশিং দ্য রিকোয়ারমেন্ট অব লিগালাইজেশন অব ফরেন পাবলিক ডকুমেন্ট’ বা অ্যাপোস্টিল কনভেনশন-১৯৬১-এর পক্ষভুক্ত হয়। পরে ২০২৪ সালের নভেম্বর থেকে এপোস্টিল সেবা চালু করা হয়।
হেগ কনভেনশন কী?
হেগ কনভেনশন-১৯৬১ হলো একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি, যা বিভিন্ন দেশের সরকারকে একটি সরলীকৃত নথিপত্র বৈধকরণ প্রক্রিয়া গ্রহণ করতে বাধ্য করে। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল—একটি দেশের সরকারি নথিকে অন্য দেশের চোখে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বৈধ করে তোলা, যেন কূটনৈতিক বা কনস্যুলার অফিসে গিয়ে বারবার লিগালাইজ করতে না হয়।
যেভাবে আবেদন করতে হয়
বিদেশগামী শিক্ষার্থী ও পেশাজীবীরা তাদের ডকুমেন্টস সত্যায়নের জন্য www.mygov.bd পোর্টালে গিয়ে অ্যাপোস্টিল সার্টিফিকেট প্রাপ্তির জন্য অনলাইনে আবেদন করতে পারেন। ডকুমেন্টটি ইস্যুকারী কর্তৃপক্ষ যাচাই করে সত্যায়ন সম্পন্ন করে তা নিয়ন্ত্রণকারী মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। নিয়ন্ত্রণকারী মন্ত্রণালয় ডকুমেন্টটি সত্যায়ন করে অনলাইনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অ্যাপোস্টিল কনভেনশনের নিয়ম মেনে ডকুমেন্টটিতে সত্যায়ন করেন এবং সত্যায়নের সনদ হিসেবে অনলাইনে ই-অ্যাপোস্টিল সার্টিফিকেট দেয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক সত্যায়ন কার্যক্রম সম্পন্ন হলে সেবাপ্রার্থীর রেজিস্ট্রেশন করা মোবাইল নম্বরে নোটিফিকেশন যাবে এবং সেবাপ্রার্থীরা তাদের মাইগভ পোর্টালের ব্যক্তিগত ড্যাশবোর্ডের ‘ডাউনলোড’ বাটনে ক্লিক করে ই-অ্যাপোস্টিল সার্টিফিকেট ডাউনলোড করে নিতে পারেন, যা ১২৭টি দেশে গ্রহণযোগ্য।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এম তৌহিদ হোসেন বলেছেন, এপোস্টিল সেবা চালু হওয়ার পর বাংলাদেশের নাগরিকরা খুব সহজেই আরও বেশি সেবা পাবেন। এটা খুব ভালো উদ্যোগ। এই উদ্যোগ আমাদের তরুণরা বাস্তবায়ন করেছে, তাদের ধন্যবাদ।
টিআর/এমজেএফ