ঢাকা, মঙ্গলবার, ২১ শ্রাবণ ১৪৩২, ০৫ আগস্ট ২০২৫, ১০ সফর ১৪৪৭

বাংলানিউজ স্পেশাল

মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের যে রিটে পতন দেখলেন শেখ হাসিনা

ইলিয়াস সরকার, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮:২৪, আগস্ট ৫, ২০২৫
মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের যে রিটে পতন দেখলেন শেখ হাসিনা শেখ হাসিনা।

ঢাকা: ২০১৮ সাল। শিক্ষার্থীদের তীব্র আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকার প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরির সব কোটা বাতিল করে পরিপত্র জারি করে।

তিন বছর পর ২০২১ সালে সেই পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অহিদুল ইসলামসহ সাতজন। সেই রিটে রুল জারি করেছিলেন হাইকোর্ট।

তারও তিন বছর পর ২০২৪ সালের ৫ জুন। দেশের ইতিহাসে আলোচিত এক ঘটনার জন্ম দিয়েছিল। ওই রুলের ওপর দেওয়া হাইকোর্টের এক রায়ের পর ছাত্র-জনতার আন্দোলনের দুই মাসের মাথায় ৫ আগস্ট দেড় দশক ধরে ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। ক্ষমতা ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন শেখ হাসিনা।  

সরকার পতনের পর ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠন করা হয় অন্তর্বর্তী সরকার।

ঘটনার শুরু যেখানে
২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকার প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরির সব কোটা বাতিল করে পরিপত্র জারি করে।

তিন বছর পর ২০২১ সালে সেই পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অহিদুল ইসলামসহ সাতজন। একই বছরের ৭ ডিসেম্বর হাইকোর্ট রুল জারি করেন। ওই রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০২৪ সালের ৫ জুন রায় দেন বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াতের (বর্তমানে অপসারিত) হাইকোর্ট বেঞ্চ। রায়ে কোটা পদ্ধতি বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে কোটা বজায় রাখতে নির্দেশ দিয়ে যত দ্রুত সম্ভব, আদেশ পাওয়ার তিন মাসের মধ্যে পরিপত্র জারি করতে নির্দেশ দেন।

নতুন করে আন্দোলন
এরপর জুলাইয়ের প্রথম দিন থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কোটা পদ্ধতির যৌক্তিক সংস্কার চেয়ে নতুন করে আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। প্রথম কয়েক দিন মিছিল, মানববন্ধনের মত সাধারণ কর্মসূচি থাকলেও পরে ‘বাংলা ব্লকেড’ নামে শুরু হয় তাদের অবরোধ কর্মসূচি। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ব্যানারে আন্দোলনকারীরা শুরুতে চার দফা দাবিতে বিক্ষোভ করলেও পরে তাদের দাবি এক দফায় এসে ঠেকে। তাদের দাবিতে বলা হয়, সব গ্রেডে সব ধরনের ‘অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক’ কোটা বাতিল করে সংবিধানে উল্লিখিত অনগ্রসর গোষ্ঠীর জন্য কোটাকে ‘ন্যূনতম পর্যায়ে’ এনে সংসদে আইন পাস করে কোটা পদ্ধতি সংশোধন করতে হবে।

আপিল বিভাগে রাষ্ট্র
প্রথম দিকে রাষ্ট্রপক্ষ এর বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন না করলেও আন্দোলনের মাত্রা বাড়ার পর আবেদন করে। কিন্তু আপিল বিভাগ তাতে সাড়া দেননি। কিন্তু যখন আন্দোলনের তীব্রতা বাড়তে থাকে তখন ১০ জুলাই আপিল বিভাগ বিভাগ হাইকোর্টের রায়ের ওপর চার সপ্তাহের স্থিতাবস্থা দেন। পরদিন হাইকোর্টের রায়ের আদেশ অংশবিশেষ প্রকাশিত হয়। তিন দিন পর ১৪ জুলাই প্রকাশিত হয় পূর্ণাঙ্গ রায়।

আন্দোলকারীদের নিয়ে শেখ হাসিনার তির্যক মন্তব্য ও ছাত্রলীগের হামলা
এরপরও আন্দোলনকারীরা কর্মসূচি চালিয়ে যেতে থাকলে ১৪ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, সরকারি চাকরিতে কোটার বিষয়টি আদালতেই ফয়সালা করতে হবে। এছাড়া ‘রাজাকার’ সংক্রান্ত প্রধানমন্ত্রীর এক বক্তব্য ঘিরে আন্দোলন নতুন মাত্রা পায়। পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ কর্মীরা আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা করে।

এতে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে সারা দেশের ছাত্র সমাজ। ১৬ জুলাই ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে সড়ক অবরোধ করে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মধ্যে পুলিশ গুলি চালায় এবং ছাত্রলীগ হামলা করে। তাতে রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদসহ প্রাণ হারায় ছয়জন। পারদিনও বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীরা পুলিশের সঙ্গে সংঘাতে জড়ায়। সরকার সব বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে শিক্ষার্থীদের হলত্যাগের নির্দেশ দেয়।

১৭ জুলাই সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “আমি বিশ্বাস করি কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের সাথে সন্ত্রাসীদের কোনো সম্পর্ক নেই। বরং সন্ত্রাসীরা এদের মধ্যে ঢুকে সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। ”

তিনি দেশজুড়ে সংঘাতের বিচারবিভাগীয় তদন্তের ঘোষণা দেন এবং সর্বোচ্চ আদালতের রায় আসা পর্যন্ত ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়ে আন্দোলনকারীদের বলেন, ছাত্রসমাজ ন্যায়বিচার পাবে বলেই তার বিশ্বাস।

কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর এ আহ্বানে সাড়া না দিয়ে ১৮ জুলাই সারা দেশে ‘শাটডাউনের’ ঘোষণা দেয় আন্দোলনকারীরা। তাদের এ কর্মসূচিতে প্রায় অচল হয়ে পড়ে সারা দেশ। বিভিন্ন স্থানে নিহত হন ৪১ জন।

সমঝোতা চায় সরকার
১৮ জুলাই দুপুরে এক ব্রিফিংয়ে এসে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, আন্দোলনকারীরা যখন চাইবে, তখনই তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে সরকার প্রস্তুত। কোটা সংস্কারের বিষয়ে সরকার নীতিগতভাবে একমত। কোটা নিয়ে পরিপত্র বাতিলের হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সরকার যে আপিল করেছে, তার শুনানি এগিয়ে আনা হয়েছে রোববার ২১ জুলাই।

পাশাপাশি, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী, গত কয়েক দিনের সংঘাত ও প্রাণহানির সার্বিক ঘটনা তদন্তের জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি করতেও প্রধান বিচারপতিকে অনুরোধ করা হবে বলে জানান আইনমন্ত্রী।

ইন্টারনেট বন্ধ ও কারফিউ জারি
আইনমন্ত্রীর ব্রিফিংয়ের পরও শিক্ষার্থীরা আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকেন। এক পর্যায়ে সরকার মোবাইল ইন্টারনেট ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়। ফলে ভার্চ্যুয়ালি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে পুরো দেশ।  

১৮ জুলাইও ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সেদিন রাত ১২টা থেকে সারা দেশে কারফিউ জারি করে সেনাবাহিনী নামানো হয়।

আপিল বিভাগের রায়
এই কারফিউয়ের মধ্যেই ২১ জুলাই আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বাতিল করে কোটা ব্যবস্থার নতুন বিন্যাস ঠিক করে দেন। আপিল বিভাগের রায়ে বলা হয়, মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা, বীরাঙ্গনার সন্তানের জন্য ৫ শতাংশ; ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য ১ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ শতাংশ কোটা সংরক্ষিত থাকবে। বাকি ৯৩ শতাংশ পদে নিয়োগ হবে মেধার ভিত্তিতে। সরকার অবিলম্বে গেজেট জারি করে এই নির্দেশনা কার্যকর করবে।

সেদিন রাষ্ট্রপক্ষে আপিল বিভাগে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন। আন্দোলনকারী দুই শিক্ষার্থীর পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক। রিটকারী মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী।

শুনানিতে কোটা বিষয়ে মতামত দেন এএফ হাসান আরিফ (প্রয়াত), আহসানুল করীম, জেড আই খান পান্না, তানিয়া আমীর, তানজিব উল আলম ও সারা হোসেন।

এছাড়া আইনজীবী জয়নুল আবেদীন এবং এ এম মাহবুবউদ্দিন খোকন এবং ইউনুছ আলী আকন্দ মতামত দেন।

নতুন গেজেট
এরপর সরকার ২৩ জুলাই রাতে গেজেটও জারি করে। একইদিন রাজধানীর গুলশানে নিজ বাসভবনে সংবাদ সম্মেলন করে প্রজ্ঞাপনের বিষয়বস্তু তুলে ধরেন তৎকালীন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক (বর্তমানে কারাবন্দী)।  এ সময় তৎকালীন জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাতসহ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, স্বশাসিত ও সংবিধিবদ্ধ কর্তৃপক্ষ (যেমন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান) এবং বিভিন্ন করপোরেশনের চাকরিতে সব গ্রেডে সরাসরি নিয়োগ হবে মেধার ভিত্তিতে ৯৩ শতাংশ। বাকি পদের মধ্যে বীর মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ কোটা, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য ১ শতাংশ এবং শারীরিক প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ শতাংশ কোটা থাকবে। তবে নির্ধারিত এই কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে কোটার শূন্য পদও সাধারণ মেধাতালিকা থেকে পূরণ করা হবে।

সরকারের পতন
কিন্তু ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনায় শিক্ষার্থীদের আন্দোলন রূপ নেয় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে। শেষ পর্যন্ত ৫ আগস্ট ক্ষমতা ছেড়ে দেশ থেকে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। ভেঙে দেওয়া হয় সংসদ। আর সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের মতামত নিয়ে অন্তর্বতী সরকারকে শপথ পড়ান রাষ্ট্রপতি।

ইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।