১৯৭১ সালে জন্মাইনি, তাই স্বাধীনতার যুদ্ধের ইতিহাস জেনেছি শৈশবের পাঠ্যবই আর গল্পকথার ভেতর দিয়ে। সেসব দিন চোখে দেখা হয়নি, যেমন দেখা হয়নি ৯০’র গণঅভ্যুত্থান কিংবা অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পালাবদলেরও।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন দীর্ঘ ষোল বছরের শাসনকাল ছিল এক নির্মম ফ্যাসিবাদের সময়, যার বিপরীতে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো খুঁজে পাচ্ছিল না কোনো কার্যকর প্রতিরোধের পথ। গণতন্ত্রের মুখোশ পরে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে দমন করা হচ্ছিল প্রায় সকল বিরোধী শক্তিকে। শুধু একটি দল ব্যতিক্রম ছিল এই নিষ্পেষণ থেকে। বাকিদের ওপর চালানো হচ্ছিল হত্যা, গুম, গ্রেপ্তার, মিথ্যা মামলা, হামলা-নিপীড়নের ধারাবাহিক মহড়া। রাজপথে দাঁড়ানোর অধিকারটুকুও কেড়ে নেওয়া হচ্ছিল পরিকল্পিতভাবে। রাষ্ট্রীয় এ নিপীড়নের পেছনে ছিল একক দমননীতি। যার ফলে দেশ-বিদেশে তৎকালীন সরকার পরিচিতি পায় ‘ফ্যাসিস্ট সরকার’ নামে।
ফ্যাসিস্ট সরকারের দমননীতির ভয়াবহতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল, বিরোধী দলের কোনো নেতা রাজপথে নামলেই তাদের ‘সন্ত্রাসী’ কিংবা ‘দেশবিরোধী’ বলে চিহ্নিত করা হতো। পরবর্তীতে গ্রেপ্তার করে দায়মুক্তির আশ্রয়ে চালানো হতো মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা। রাষ্ট্র যেন বিরোধীদের দমনে এক নিষ্ঠুর যন্ত্রে পরিণত হয়েছিল। তারা সরকারের বিরুদ্ধে কোনো কর্মসূচি তো দূরের কথা, ঘরোয়া পরিবেশে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সভা করলেও নিরাপদ থাকত না। ছির কেবল গোয়েন্দা নজরদারি, গ্রেপ্তারের আতঙ্ক। এইভাবেই একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে দিনের আলোয় রাত বানিয়ে রাখা হয়েছিল বছরের পর বছর।
এভাবে প্রায় ষোলো বছর ধরে গোটা দেশকে যেন একটি অদৃশ্য কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। যেখানে ছিল না স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার, ন্যায়ের আশ্রয়, রাজনৈতিক বৈচিত্র্যের স্বীকৃতি। এই বন্দিত্ব কেবল ইট-কাঠের দেয়ালে সীমাবদ্ধ ছিল না; এটি ছিল চিন্তার ওপর শেকল, প্রতিবাদের ওপর তালা, এবং স্বপ্নের ওপর লাগানো পাহারা। ছাত্র, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, পেশাজীবী কারও মাঝেই মুক্তির কোনো স্পষ্ট দিশা ছিল না। চারদিকে শুধু আতঙ্ক, নিঃসঙ্গতা আর হাল না ছাড়া এক ধরনের নিঃশব্দ কান্না। যার কোনো ভাষা ছিল না, কিন্তু ছিল একটি গভীর আকাঙ্ক্ষা: মুক্তি। এই মুক্তিই একদিন ছড়িয়ে পড়ে রাজপথে, আগুন হয়ে জ্বলে ওঠে ছাত্রের চোখে, স্লোগানে, চেতনায়।
২০২৪ সালের জুলাই মাসের শুরু থেকেই কোটা সংস্কারের দাবিকে কেন্দ্র করে দেশের ছাত্রসমাজ আবারও জেগে ওঠে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে হাজারো শিক্ষার্থী রাজপথে নামে। শুধু রাজধানী নয়, আন্দোলনের আগুন ছড়িয়ে পড়ে দেশের প্রতিটি শহর, উপজেলা, এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত। এটি ছিল এক নির্লজ্জ বৈষম্যের বিরুদ্ধে জাতির তরুণতম কণ্ঠের প্রতিবাদ। কিন্তু এই গণআন্দোলনের জবাবে সরকার বেছে নেয় পুরনো ফ্যাসিস্ট কৌশল, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে লেলিয়ে দেওয়া হয় আন্দোলনকারীদের ওপর। রাষ্ট্রীয়ভাবে নামানো হয় নির্যাতনের স্টিম রোলার। জলকামান, টিয়ারশেল, লাঠিচার্জ; সবই ব্যবহৃত হয় রাজপথের স্লোগানরোধে। প্রতিটি মিছিল ভাঙার জন্য চালানো হয় দমননীতির সর্বোচ্চ চেষ্টা। তবু থেমে থাকেনি ছাত্রসমাজ। কারণ, এই আন্দোলন ছিল কেবল শুধু কোটার বিরুদ্ধে নয়, এটি ছিল দীর্ঘ বৈষম্য, অন্যায় ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে জমে ওঠা এক ঐতিহাসিক প্রতিরোধ।
তবে যতই দমন-পীড়নের কৌশল প্রয়োগ করুক, কিছুতেই যেন আন্দোলনকে থামানো যাচ্ছিল না। বরং প্রতিদিন, প্রতিঘণ্টা আন্দোলন হয়ে উঠছিল আরও তীব্র, আরও সংগঠিত, আরও বিস্ফোরক। স্লোগানের জোরে কেঁপে উঠছিল ক্যাম্পাস, রাজপথ, শহর থেকে গ্রাম। ঠিক সেই মুহূর্তেই আন্দোলনকারীরা ঘোষণা করে এক ঐতিহাসিক কর্মসূচি, ‘মার্চ ফর ঢাকা’। রাজধানীমুখী এই গণমিছিল ছিল সরকারের ঘুম হারাম করে দেওয়ার মতো এক পদক্ষেপ।
এই কর্মসূচি প্রতিরোধ করতে সরকার আর কোনো কৌশল গোপন রাখেনি। ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়; ঢাকার প্রবেশপথগুলোয় বসানো হয় সেনা নজরদারির মতো কঠোর ব্যারিকেড। কিন্তু তাতেও থামানো যায়নি এই জনস্রোত। বরং এই অবরোধ-নির্ভর দমননীতিই আন্দোলনের আগুনকে পৌঁছে দেয় দেশের আনাচে-কানাচে। গ্রাম থেকে শহর, পাহাড়-সমতল; বাংলার প্রতিটি প্রান্তে যেন ছড়িয়ে পড়ে ক্ষোভের বিস্ফোরণ। একটি ছাত্র-আন্দোলন ধীরে ধীরে রূপ নেয় এক জাতীয় গণজাগরণে, যার কেন্দ্রবিন্দু শুধু ঢাকা ছিল না, ছিল পুরো বাংলাদেশ।
মার্চ ফর ঢাকা কর্মসূচিকে ব্যর্থ করতে সরকার তার সমস্ত শক্তি নিয়োগ করেছিল। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, নজরদারি, বাধা, ভয়ভীতি; সবকিছুই। কিন্তু এসব দমনচেষ্টা উপেক্ষা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এক সাহসী সিদ্ধান্তে পৌঁছে যায়। তারা ঘোষণা করে সরকার পতনের এক দফা কর্মসূচি। এ ছিল আর কোনো মধ্যপন্থার দাবি নয়, এ ছিল একটি জমানার শেষের ঘণ্টাধ্বনি। তরুণরা স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, তাদের যুদ্ধ কেবল কোটার বিরুদ্ধে নয় বরং একক ক্ষমতার দুঃশাসনের বিরুদ্ধে। একটি বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দাবিতে তারা এবার আর পিছিয়ে আসবে না। রাজপথ তখন আর আন্দোলনের নয়, হয়ে ওঠে অভ্যুত্থানের মঞ্চ।
৫ আগস্ট, সকাল আটটা। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে বেরিয়ে পড়ি বনশ্রীর বাসা থেকে, গন্তব্য পল্টন। কিন্তু সেদিন সকালটা ছিল যেন অন্য রকম। একটি ভোর নয়, যেন ইতিহাসের এক চূড়ান্ত মুহূর্ত। বনশ্রীর প্রধান সড়কে পা রাখতেই চোখ আটকে যায়। এ দৃশ্য কোনোদিন দেখিনি, এমনকি কল্পনাও করিনি। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা, সব বয়সের মানুষ রাজপথে নেমে এসেছে, হাতে হাত, কণ্ঠে এক স্লোগান: ‘এক দফা এক দাবি, স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতন চাই!’
সেদিন যেন বাতাসও আন্দোলনের সুরে আন্দোলিত হচ্ছিল। সূর্য ওঠার আগেই ঢাকার প্রতিটি দেয়াল, গলি, সড়ক; সবখানে লাল কালিতে লেখা প্রতিবাদের ভাষা। পোস্টারে, ব্যানারে, হ্যান্ডবিলে ভরে উঠেছে শহর। আশ্চর্যের ব্যাপার, যেসব দেয়ালে আগে সরকারবিরোধী একটি কাগজও সাঁটানো যেত না, যেখান থেকে চোখের পলকে মুছে ফেলা হতো অন্য রাজনৈতিক দলের চিহ্নমাত্র। সেসব দেয়ালে আজ ঠাঁই নেই, ফাঁকা নেই এক ইঞ্চি জায়গা। যেন একরাত্রিতে শহরটা জেগে উঠেছে ঘুমন্ত প্রতিবাদকে সঙ্গে নিয়ে, যেন জনগণ ঘোষণা দিয়েছে, এবার আর ফিরে যাওয়া নয়।
রাস্তায় নেমে এসে মানুষের চোখে চোখ রাখতেই মনে হচ্ছিল যেন ফিরে গেছি ১৯৭১ সালের সেই উত্তাল দিনে। স্বাধীনতার যুদ্ধ চোখে দেখা হয়নি; তবে পাঠ্যপুস্তকে ভাষায় যে উত্তাপ ছিল অনুভব করেছি। বুকের ভেতর ধুকপুক করা একরাশ আবেগ, চারপাশে মানুষের জাগরণ, দেয়াল জুড়ে প্রতিবাদের অক্ষর, আর আকাশের নিচে গর্জে ওঠা জনতার ঢল, সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল এ যেন এক নতুন মুক্তিযুদ্ধ।
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শহরের সীমানা ভেঙে পড়তে থাকে জনতার ঢেউ। শুধু ছাত্র নয়, শ্রমিক, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, পেশাজীবী, রিকশাওয়ালা, গৃহিণী; সবার মুখেই এক স্লোগান, এক আহ্বান: ‘স্বৈরাচার আজই পতনের পথে!’ রাজপথে তখন আর কোনো আলাদা পরিচয় ছিল না, ছিল শুধু একটাই পরিচয়, আমরা জনগণ।
এই চিত্র পৌঁছে যায় দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশেও। প্রবাস থেকে, কূটনৈতিক মহল থেকে, আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম থেকে আসতে থাকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন, ‘এই সরকার কি আর টিকবে?’ ‘আর কত ছাত্র-জনতা প্রাণ দেবে?’ মনে হচ্ছিল, গোটা জাতি যেন এক অনিবার্য মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। যেখানে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, মাথা নত করবো না, আর কখনো নয়।
সেদিন রাজধানীর রাজপথে একটি গাড়িও চলছিল না। না বাস, না রিকশা, এমনকি একটি মোটরসাইকেল পর্যন্ত চোখে পড়ছিল না। যেন শহর থেমে গেছে, কিন্তু থেমে যায়নি মানুষ। পুরো ঢাকা তখন ছুটে চলেছে একটাই গন্তব্যে: শাহবাগ। শহরের সব রাস্তা যেন এক স্রোতে মিশে গেছে সেখানে, যেখানে জনতার ঢল আর স্লোগানের গর্জন ছাপিয়ে যাচ্ছিল ধ্বনির সীমা।
এই ছিল এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। শুধু ছাত্র নয়, পেশাজীবী, রাজনৈতিক কর্মী, সাধারণ পথচারী সবাই এসে দাঁড়িয়েছে একই দাবিতে। এক দফা— স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পদত্যাগ। আন্দোলনের এই সর্বজনীনতায়, এই স্বতঃস্ফূর্ত আগুনে যেন গোটা রাজধানী পরিণত হয়েছিল এক বিশাল প্রতিরোধ ভূমিতে। আর এই অপ্রতিরোধ্য চাপের মুখে, যখন রাষ্ট্রযন্ত্রের কোনো অস্ত্রই আর কাজ করছিল না। তখন ইতিহাসের নিয়তি মেনে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন তৎকালীন স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা। সেই মুহূর্তে ঢাকা শুধু একটি স্বৈরাচারের পতন দেখেনি, দেখেছে এক নতুন ইতিহাসের সূচনা।
আন্দোলনের মাত্র তিন দিন পর, ৮ আগস্ট বিপুল ছাত্র-জনতার দাবির মুখে ও রাষ্ট্রীয় সংস্কারের প্রত্যাশা নিয়ে অন্তবর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনুস। লাখো প্রাণের সমন্বিত স্বপ্ন, রাজপথের জ্বালাময়ী স্লোগান, এবং একটি বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গঠনের অঙ্গীকার নিয়ে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ এই দায়িত্ব কাঁধে নেন তিনি।
তবে আজ, জুলাই বিপ্লবের এক বছর পার হয়ে গেলেও বাস্তবতার চিত্র এখনো সম্পূর্ণ আশার আলোয় উদ্ভাসিত নয়। রাষ্ট্রীয় সংস্কার, জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার, আহত ও নিহত পরিবারের পুনর্বাসন এখনো অধরা স্বপ্ন হয়ে রয়েছে অসংখ্য রক্তাক্ত ঘরে।
এমন একটি ঐতিহাসিক আন্দোলনের পর এই বিলম্ব গভীর হতাশার জন্ম দেয়। তবে জনগণের আত্মত্যাগ বৃথা যেতে পারে না; এই বিশ্বাস এখনও বেঁচে আছে জনমানুষের হৃদয়ে। তাই প্রত্যাশা থাকবে, ইতিহাসে নতুন সূচনা হয়েছিল ২০২৪’র আগস্টে, সেই ইতিহাসের পূর্ণতা যেন আমরা দেখি সুবিচার, পুনর্বাসন, এবং প্রকৃত রাষ্ট্রীয় পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে— অচিরেই।
টিএ/এমজে