গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তীব্র জনরোষ থেকে বাঁচতে তিনি পালিয়ে আশ্রয় নেন ভারতে।
ভারতে আশ্রিত হাসিনার নামে বেশ কিছু অডিও এবং ফোনালাপ অনলাইনে ছড়িয়েছে। এর মধ্যে তার দল ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজেও দেখা গেছে অডিও এবং ফোনালাপ। যদিও এর কোনোটিই বাংলানিউজ যাচাই করতে পারেনি।
১২ আগস্ট শেখ হাসিনার কথিত একটি ফোনালাপ ফাঁস হয়। তিন মিনিটের ওই আলাপের অপর প্রান্তে ছিলেন বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো. জাহাঙ্গীর কবির।
ফোনালাপে ওই নারী কণ্ঠকে বলতে শোনা যায়, ‘আপনারা শৃঙ্খলা মেনে দলীয় কার্যক্রম চালাবেন। ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসকে যথাযথভাবে পালন করবেন। ’
জবাবে মো. জাহাঙ্গীর বলেন, ‘আপা আপনি ঘাবড়াবেন না, মনোবল হারাবেন না। আপনি ঘাবড়ালে আমরা দুর্বল হয়ে যাই। আমরা শক্ত আছি। ’
তখন অন্য প্রান্ত থেকে বলা হয়, ‘আমি ঘাবড়াব কেন? আমি ভয় পাইনি। আমাদের কর্মীদের মেরেছে। বোরকা পরে মেরেছে। এ দেশটা রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন হয়েছে। আপনারা যেভাবে আছেন, থাকেন। ’
পরে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি কলরেকর্ডের অডিও ভাইরাল হয়। তখন বলা হচ্ছিল শেখ হাসিনা ও যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাবেক ছাত্রলীগ নেতা তানভীর কায়সারের মধ্যে এই আলাপচারিতা হয়। সেখানে শেখ হাসিনার মতো কণ্ঠে যাকে কথা বলতে শোনা যাচ্ছিল, তিনি বলেন এখনও পদত্যাগ করেননি।
তার কথায়, ‘আমি তো পদত্যাগ করি নাই। আমাদের কনস্টিটিউশনের আর্টিকেল ৫৭ অনুযায়ী যেভাবে পদত্যাগ করতে হয়, আমার কিন্তু সেভাবে পদত্যাগ করা হয়নি। ’
তাকে আরও বলতে শোনা যায়, গণভবন থেকে সরে যেতে বাধ্য হলেও রাষ্ট্রপতির কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগপত্র জমা দেননি। ফলে নিজেকে তখনো বাংলাদেশের ‘কনস্টিটিউশনাল ইলেকটেড প্রাইম মিনিস্টার’ হিসেবে উল্লেখ করেন।
অডিওতে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অর্থপাচার ও রাজনৈতিক চক্রান্তের অভিযোগও তোলেন তিনি। দাবি করেন, ৬ আগস্ট তার বিরুদ্ধে রায়ের আগেই ‘পরিস্থিতি সৃষ্টি করে’ ৫ আগস্ট লং মার্চ সংগঠিত করা হয়। এতে প্রাণহানি ঘটে, যা তাকে সরে যেতে বাধ্য করে।
তাকে বলতে শোনা যায়, ‘যে কটা মার্ডার হইছে, পুলিশের গুলিতে হয়নি। মুভমেন্টের ভেতরে কিলিং এজেন্ট ছিল। বোরকা পরে কেউ কেউ ইন্ডাস্ট্রিতে আগুন দিয়েছে। আমি লাশের স্তূপ দেখতে চাইনি। আমি থাকতে চাইনি। ’
অন্যদিকে, তানভীর কায়সারকে অডিওতে বলতে শোনা যায়, ‘আপা, আপনি ফিরে আসবেন ইনশাআল্লাহ, আর বেশি দিন নাই। ’ তিনি ইউরোপীয় পার্লামেন্টে বিষয়টি জানানো হচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন।
সবশেষে, ওই নারী কণ্ঠ দাবি করেন, তার ‘পদত্যাগপত্রের’ কোনো কপি কেউ দেখাতে পারেনি এবং গণভবনে যা ছিল, তা লুটপাট ও অগ্নিকাণ্ডে হারিয়ে গেছে। একই কণ্ঠে বলতে শোনা যায়, তিনি দেশের খুব কাছাকাছি অবস্থান করছেন, যাতে চট করে দেশে ঢুকে পড়তে পারেন।
অক্টোবরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয় শেখ হাসিনার কণ্ঠসদৃশ আরেকটি ফোনালাপ। ওই কথোপকথন হয় গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের সাবেক ছাত্রলীগ সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান শাকিল আলম বুলবুলের সঙ্গে।
ফোনালাপে ওই নারী কণ্ঠে শোনা যায়, ‘ডিসেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তোমাদের বাড়িঘরে যারা আগুন লাগিয়েছে, তাদের বাড়িঘর নেই? সব কথা কি বলে দিতে হয়?’
অন্য প্রান্ত থেকে শোনা যায় শাকিল আলম বুলবুলের কণ্ঠস্বর। তিনি বলেন, ‘জ্বি নেত্রী, আপনার কথায় আমরা ভরসা রাখছি। ’
জবাবে ওই নারী কণ্ঠে বলতে শোনা যায়, ‘যারা বেশি বাড়াবাড়ি করছে, তারা বেশি ভালো থাকবে না। কাউকে পালাতেও দেওয়া হবে না। যারা নাফরমানি করেছে, তাদের অস্ত্রও থাকবে না। ’
শাকিল অনুরোধ করেন, নেত্রী যেন মাথা ঠান্ডা রেখে কৌশলে এগিয়ে যান। শেখ হাসিনা বলেন, ‘দুই মাস অপেক্ষা করো। কিছু বলো না। ওরা ফেল করবে। ’
একপর্যায়ে শাকিল বলেন, ‘মানুষ ভয়েই চুপ হয়ে আছে। ’ জবাবে ওই নারী কণ্ঠে ভেসে আসে, ‘এখন ভয় পাওয়ার সময় নয়, ভয় দেখানোর সময়। ’
নভেম্বরে আরও একটি কথোপকথন ছড়িয়ে পড়ে এতে শেখ হাসিনার কণ্ঠের মতো একজন দলীয় নেতাকর্মীদের বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দেন। ফোনালাপের শুরুতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের খুনি বলে আখ্যায়িত করা হয়।
ফোনালাপে বলতে শোনা যায়, ‘এই অবৈধ সরকারের অত্যাচারে সারাদেশের মানুষ জর্জরিত। কৃষক-শ্রমিকরা বেকার হয়ে গেছে। শ্রমিক আন্দোলন করেছে, সাথে সাথে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে। চাকরির বয়স নিয়ে আন্দোলন করতে যমুনার সামনে গেল, সাথে সাথে গুলি করলো। সেখানে একজন মারা গেলো এবং পিটিয়ে উঠিয়ে দিলো। ’
এছাড়া আরেকটি কথিত ফোনালাপে শেখ হাসিনাকে ২২৭ জনকে হত্যার হুমকি দিতে শোনা যায়। গত ৩০ এপ্রিল শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আদালত অবমাননার অভিযোগ দায়েরের পর ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম জানান, ‘আমার বিরুদ্ধে ২২৭টি মামলা হয়েছে, তাই ২২৭ জনকে হত্যার লাইসেন্স পেয়ে গেছি’, এমন মন্তব্যে অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া বিতর্কিত অডিও ক্লিপটি ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারই। এ সংক্রান্ত ফরেনসিক প্রমাণ পেয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা।
যদিও কয়েকটি ফোনালাপে শেখ হাসিনাকে বলতে শোনা যায়, তিনি অভ্যুত্থানে হত্যাকাণ্ডের নির্দেশ দেননি। ভেতর থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে আন্দোলনকারীদের।
কিন্তু সম্প্রতি বিবিসি ও আল জাজিরায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, বিক্ষোভ দমনে শেখ হাসিনা সরাসরি লেথাল উইপন (প্রাণঘাতী অস্ত্র) ব্যবহারের নির্দেশ দেন। এই নির্দেশনা দেওয়ার ফোনালাপ তারা যাচাইও করেছে।
জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুসারে, জুলাই অভ্যুত্থানকালে প্রায় ১৪শ মানুষ হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। চোখ, পা ও হাত হারান শত শত আন্দোলনকারী। রাষ্ট্রীয় এই হত্যাকাণ্ড ও নিপীড়নের সমন্বয়কের ভূমিকা ছিলেন খোদ শেখ হাসিনা।
গত বছরের নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে বিবিসি বাংলা এক প্রতিবেদনে বলেছিল, মাসে ভারতে আশ্রয় নেওয়া শেখ হাসিনার ‘ফাঁস’ হওয়া অডিওগুলো সত্য বলে একাধিক ভারতীয় সূত্র ধারণা করছে। যদিও সরকারিভাবে ভারত কোনও মন্তব্য করেনি, তবে দিল্লির সূত্রের মতে এগুলো সম্ভবত শেখ হাসিনার কণ্ঠস্বরই।
দিল্লির নর্থ ব্লকের একজন কর্মকর্তা বলেন, শেখ হাসিনার পরিচিতদের সঙ্গে যোগাযোগে কোনো বাধা নেই, কেউ সেই আলাপ রেকর্ড করে ছড়িয়ে দিলে তা নিয়ে সরকারের কিছু করার নেই।
কিছু পর্যবেক্ষকের মতে, দিল্লি ইচ্ছাকৃতভাবেই এসব কথোপকথন ফাঁস করতে দিচ্ছে যাতে তা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কাছে পৌঁছে মনোবল ধরে রাখা যায়। বিভিন্ন সময়ে হাসিনার বিবৃতিও প্রকাশিৎ হয়েছে।
ভারতে বসে শেখ হাসিনার বক্তব্য দেওয়ার বিষয়টি ঢাকা ভারতীয় হাইকমিশনার এবং দেশটির সরকারকে একাধিকবার স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়, ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ভারতে চলে যাওয়ার পর সেখানকার বিভিন্ন গণমাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে রাজনৈতিক বিবৃতি ও বক্তব্য দিচ্ছেন, সেটি বাংলাদেশ ভালোভাবে দেখছে না।
ভারতের মাটিতে বসে শেখ হাসিনা যেন নিজের বয়ানে কোনো প্রকাশ্য রাজনৈতিক বিবৃতি না দেন, সে জন্যও তাকে ভারতের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয় বলে বিবিসি জানতে পারে।
গণ-অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আওয়ামী লীগের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে জুনে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
গত ১০ জুলাই শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে পাঁচ অভিযোগে চার্জ গঠন করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। গণঅভ্যুত্থানের ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে দ্বিতীয় সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে।
আরএইচ