ঢাকা: মাঠ পর্যায় থেকে তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে ১৮ বছর আগে যে তথ্যভাণ্ডার গড়ে তুলেছিল নির্বাচন কমিশন (ইসি), সেই প্রক্রিয়া থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে সংস্থাটি। এক্ষেত্রে ভোটার এলাকায় না গিয়ে বরং অনলাইনে সম্পন্ন করতে চায় ভোটার হালনাগাদের কাজ।
শিক্ষার আলো নেননি বা প্রযুক্তি থেকে পিছিয়ে পড়া নাগরিকরাও ইসির এমন সিদ্ধান্তের প্রতি আঙ্গুল তুলছেন। তারা বলছেন, ভোটার হওয়া যেখানে অধিকার, সেখানে ব্যয়ের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। কেননা, ‘কম্পিউটারের দোকানে’ গিয়ে ভোটার হতে গেলে একটি নির্দিষ্ট অংকের অর্থ ব্যয় করতে হবে। আর এই সুযোগটি নিতে পারে কোনো একটি গোষ্ঠী।
নিরক্ষর মানুষ কত?
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ প্রতিবেদন (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০২৪) অনুযায়ী, দেশের সাত বছর ও তদূর্ধ্ব জনগোষ্ঠীর মধ্যে বর্তমানে সাক্ষরতার হার ৭৭ দশমিক ৯ শতাংশ। তার মানে ২২ দশমিক ১ শতাংশের মতো জনগোষ্ঠী এখনো নিরক্ষর। এ হিসেবে চার কোটির মতো মানুষ নিরক্ষর, যারা সামনে পর্যায়ক্রমে ভোটার হবেন। এই নিরক্ষর গোষ্ঠীকে অনলাইনে ভোটার নিবন্ধন করে দেওয়ার নামে কোনো দলের সমর্থন বাড়ানোর সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে কি-না, কিংবা ভোগান্তিই বাড়ে কি না, নির্বাচন কমিশনকে সেই বিষয়টি গবেষণার কথাও বলছেন অনেকে।
বাড়ি বাড়ি বা মাঠ থেকে তথ্য সংগ্রহের সুফল
বর্তমানে নির্বাচন কমিশনের যে তথ্যভাণ্ডার সেটির গোড়াপত্তন হয় ২০০৭-০৮ সালে। সে সময়কার এটিএম শামসুল হুদার কমিশন সেনাবাহিনীর সহায়তায় মাঠ পর্যায়ে কেন্দ্র স্থাপন করে ব্যাপক ভোটার কার্যক্রম সম্পন্ন করে। সে সময় ৮ কোটি ১০ লাখ মানুষের একটি ভাণ্ডা্র তৈরি হয়। পরবর্তী সময়ে ওই কমিশন ভোটার তালিকা আইন-২০০৯ প্রণয়ন করে ভোটারদের দোড়গোড়ায় পৌঁছার সিদ্ধান্ত নেয়। অর্থাৎ বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা করার প্রক্রিয়া চালু হয়। সেই থেকে মোট সাতবার এ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।
২০০৯-২০১০ সাল, ২০১২-২০১৩ সাল, ২০১৫-২০১৬ সাল, ২০১৭-২০১৮ সাল, ২০১৯-২০২০ ও ২০২২-২০২৩ এবং ২০২৪-২৫ সালে বাড়ি বাড়ি হালনাগাদ কার্যক্রমের পর এখন তথ্যভাণ্ডারে ভোটার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২ কোটি ৬৩ লাখ ৭ হাজার ৫৯৪ জন। এদের মধ্যে পুরুষ ভোটার ৬ কোটি ৪১ লাখ ৪৫৫ জন ও নারী ভোটার ৬ কোটি ২২ লাখ ৫ হাজার ৮১৯ জন। হিজড়া ভোটার ১২৩০ জন। অর্থাৎ প্রায় পুরো তথ্যভাণ্ডারটিই গড়ে ওঠেছে মাঠ পর্যায় থেকে তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে।
নির্বাচন কমিশন যা বলছে
নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ এ বিষয়ে বলেন, ‘ভোটার নিবন্ধন ৩৬৫ দিন চালু থাকে। বছরের যেকোনো সময় ১৮ বছর হলে একজন নাগরিক ভোটার হতে পারবেন। শুধু বায়োমেট্রিক দেওয়ার জন্য তাকে যেতে হবে সংশ্লিষ্ট নির্বাচন কার্যালয়ে। এটা যে শুধু বাড়ি বাড়ি গিয়ে করতে হবে বিষয়টি তা নয়। বরং ভবিষ্যতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার করার বিধানটা উঠিয়ে দেব। ’
তিনি বলেন, ‘এটা এবার করা হয়েছিল অতিরিক্ত ব্যয় নিয়ে। কারণ পর পর তিনটা বিতর্কিত নির্বাচনের পর এ ভোটার তালিকা নিয়ে আমরাই কনিফিডেন্স পাচ্ছিলাম না। এ ভোটার তালিকার কার্যকারিতা আমাদের পরীক্ষা করার দরকার ছিলো। এ কারণে আমাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করতে হয়েছে। ’
বাড়ি বাড়ি ভোটার হালনাগাদ থেকে সরে আসার ভাবনার পেছনে যুক্তি হিসেবে তিনি বলেন, ‘বাস্তবতার ‘পরিপ্রেক্ষিতে দেখলাম, অনেক জায়গায় আমাদের বাড়ির ভেতরে ঢুকতে দেয় না। বহুতল ভবনের নিচে থেকে পাঠিয়ে দেয়। সুতরাং আমাদের এ সীমাবদ্ধতাগুলো আছে এবং এলাকায় দুইবার তিনবার মাইকিং করার পরও আমাদের শ্রমজীবী মানুষদের পাওয়া যায় না। তাই আমি মনে করি, অনলাইনে ভোটার হওয়ার যে বিধানটা আছে এটাই থাকা উচিত। এতে যে কোনো সময় যে কেউ ভোটার নিবন্ধন করতে পারবেন। এরজন্য সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে, যাতে তারা এটা করতে পারেন। ’
যেখানে ইন্টারনেট সুবিধা অপ্রতুল বা বিদ্যুতের সমস্যা রয়েছে, সেখানে কী হবে- তার ব্যাখ্যায় এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘কোনো একটা জায়গাতে যেখানে নেটওয়ার্কের ক্যাভারেজ আছে সেখানে গিয়ে নিবন্ধন কার্যক্রমটা সম্পাদন করতে পারে। পাশাপাশি অনেক কম্পিউটারের দোকানও এ সেবা দেয়। আবার সরকার একটা ছাতার নিচে সকল সেবা পাওয়া যাবে এমন পদ্ধতি আনার চেষ্টা করছে। আমাদের নির্বাচন অফিসগুলোতে এ সেবা তো আছেই। পাশাপাশি ইউনিয়ন পরিষদের অফিসগুলোতে এ কার্যক্রম যদি শুরু করা যায়, তাহলে সহজ হয়ে যাবে এটা। ’
ইসির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তারা বলছেন, এবারও ৪৪ লাখ বাদ পড়া ভোটার আমরা তালিকায় যোগ করতে পেরেছি বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করার কারণে। এছাড়া ২১ লাখ মৃত ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া গেছে। অনলাইনে গেলে এটা সম্ভব হতো না। কেননা, অনলাইনে তো ভোটার হওয়ার ব্যবস্থা আছেই। তারপরও তো ৪৪ লাখ ভোটার সাড়া দেয়নি বা মৃত ভোটারের নাম কর্তনের কেউ আবেদন করেনি।
খোদ ইসি কর্মকর্তারা বলছেন, বাড়ি বাড়ি ভোটার তালিকা হালনাগাদের সময় অনেক তথ্যসংগ্রহকারী যে ফাঁকি দেয় না তা নয়। তারপরও ভোটার হালনাগাদের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতিই সবচেয়ে কার্যকর। কেননা, তথ্য সংগ্রহকারী বাড়ি বাড়ি না গেলেও মাইকিং তো করা হয়। কাজেই কেউ বাদ পড়লে পার্শ্ববর্তী ছবি তোলার কেন্দ্রে গেলেও ভোটার হওয়া যায়।
এ বিষয়ে সাবেক নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার বিষয়ক কমিশন সদস্য ও ইসির সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলী বাংলানিউজকে বলেন, ‘২০০৭ সাল থেকে বাড়ি বাড়ি ভোটার তালিকা কার্যক্রম হয়ে আসছে। এখন যদি সেখান থেকে সরে এসে অনলাইন বেইজ করতে চায় তাহলে আইন পরিবর্তনসহ অর্গানাইজ ওয়েতে আগাতে হবে। ভোগান্তি কমিয়ে আনা যাবে কি না সেটাও ভাবতে হবে। হুট করে সেখান থেকে সরে না এসে বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। সুবিধা-অসুবিধা রিসার্চ করে সিদ্ধান্তে আসতে হবে। ’
তিনি বলেন, ‘অনলাইনে গেলে হয়তো করা যাবে। ইউনিয়ন তথ্যসেবা কেন্দ্র আছে, নানা উপায়েই করা যেতে পারে। ইসিও উদ্যোগ নিতে পারে। বাড়ি বাড়ি গেলে ব্যয় অনেক বেড়ে যায় এটা ঠিক। কিন্তু এটা স্যাটেল করার আগে পর্যাপ্ত রিসার্চ করা দরকার। অনলাইনে ভোটার হলে আঙুলের ছাপ ও চোখের আইরিশের প্রতিচ্ছবি কোথায় দেবেন নাগরিকরা, এসবও ভাবতে হবে। কারণ প্রত্যন্ত অঞ্চলের বা গ্রাম অঞ্চলের মানুষের অসুবিধা হবে এটাও তো ঠিক। ’
ইইউডি/এজে