২০২৪ সালের ৫ আগস্ট দীর্ঘ দেড় দশকের ফ্যাসিস্ট শাসনের অবসান ঘটিয়ে শেখ হাসিনা সরকার পতনের মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটে একক কর্তৃত্ববাদী অধ্যায়ের। কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে উদ্ভূত ছাত্র-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত জাগরণ, সাধারণ মানুষের সরব অংশগ্রহণ এবং বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সক্রিয় ভূমিকা মিলেই রচিত হয় ঐতিহাসিক জুলাই গণঅভ্যুত্থান।
আশা জাগে- দেশে একটি নতুন, গণতান্ত্রিক এবং নির্বাচিত সরকার দ্বারা রাষ্ট্রব্যবস্থার সূচনা হবে। কিন্তু এক বছর পেরিয়ে এসে দেখা যাচ্ছে, সেই স্বপ্নের বাস্তবায়নে যেসব শক্তি সম্মিলিতভাবে আন্দোলন করেছিল, তারাই এখন বিভাজিত। আন্দোলন পরবর্তী রাষ্ট্রে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্থান, দেশের প্রধান রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিয়ে টানাপোড়েন, আন্দোলনের মালিকানা নিয়ে দখলবাজি, সব মিলিয়ে নতুন এক দ্বন্দ্বের আবহ তৈরি হয়েছে রাজনীতির ময়দানে।
এমন এক মুহূর্তে এসে দৃশ্যপটে ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে বিএনপির রাজনৈতিক গুরুত্ব। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, যারা একসময় আন্দোলনে ‘নীরব কৌশলে’ থেকেছে, তারাই এখন পরিণত হয়েছে ভবিষ্যতের রাষ্ট্রচিন্তা ও ক্ষমতার কাঠামো নির্ধারণে অন্যতম মুখ্য খেলোয়াড় হিসেবে।
আন্দোলনের সময় যেসব রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠন সরাসরি সম্পৃক্ত ছিল বলে আলোচিত, পরবর্তী সময়ে তাদের অনেকেই আন্দোলনের নেতৃত্ব, কৌশল ও সফলতা নিয়ে ‘ক্রেডিট পলিটিক্স’-এ লিপ্ত হয়। একেক সময়ে একেক পক্ষ নিজেদের ‘মূল মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে তুলে ধরতে থাকে। আন্দোলনের সময় ‘মেটিকুলাস ডিজাইন’ বা ‘মাস্টারমাইন্ড’ শব্দগুলো উচ্চারিত না হলেও পরে এসব ধারণা রাজনৈতিক মাঠে প্রবেশ করে।
খোদ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড মুহাম্মদ ইউনূস গত বছর সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনের ফাঁকে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের ‘ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ লিডারস স্টেজ’ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে তার তৎকালীন বিশেষ সহকারী এবং বর্তমানে তথ্য উপদেষ্টা এবং জুলাই আন্দোলনে সরাসরি অংশগ্রহণকারী ছাত্রনেতা মাহফুজ আলমকে কোটা সংস্কার আন্দোলন ও পরে সরকার পতনের ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। এরপর থেকেই মূলত নানা সময়ে আন্দোলনের আসল ‘মাস্টারমাইন্ড’ নিয়ে আলোচনা উঠে। একেক সময় একেক নামও উঠে আসে।
অভ্যুত্থানের পর থেকে জামায়াতেও বেশ প্রভাব লক্ষ্য করা যায় অনেক ক্ষেত্রে। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার কয়েকদিন আগে শেখ হাসিনা জামায়াত ও তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করেন। আওয়ামী লীগের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার দেশের দায়িত্বগ্রহণ করে সেই নিষিদ্ধের আদেশ বাতিল করে। তাই রাজনৈতিক এই পালা বদলে জামায়াত বেশ উজ্জীবিত হয়ে উঠেছিল। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ভূমিকা রাখা এবং জুলাই আন্দোলনের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে জামায়াত-শিবিরের অংশগ্রহণ ও উপস্থিতিও দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।
একসময় ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে পরিচিতরা আন্দোলনের পর আবির্ভূত হতে থাকে ছাত্রশিবির পরিচয়ে। প্রকাশ্যে আসে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের ভেতর আত্মগোপনে থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ছাত্রশিবিরের সভাপতি সাদিক কায়েমসহ অনেকের পরিচয়। কথা উঠে, ছাত্রশিবিরের বর্তমান নেতারা এক সময় ছাত্রলীগের ছত্রছায়াতেই লালিত-পালিত হয়েছেন।
তবে ক্রেডিট নেওয়ার এই দৌড়ে প্রথম থেকে কিছুটা নীরব অথবা পিছিয়ে ছিল বিএনপি। সম্প্রতি যেমন দলটির নেতাকর্মীরা জুলাই আন্দোলনের ‘মূল নায়ক’ হিসেবে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে উল্লেখ করছেন। আন্দোলনের সময় অথবা আন্দোলনের পর পর কিন্তু এই দাবি তারা করেননি। বরং আন্দোলনের সময় থেকেই বিএনপির পক্ষ থেকে কোটা আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের ‘নৈতিক সমর্থন’ দেওয়ার কথাই বলা হয়েছে।
দলের মহাসচিব সেসময় ওই আন্দোলনে বিএনপির সরাসরি জড়িত থাকার কথা অস্বীকারও করেছেন। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, কৌশলগতভাবেই সেসময় বিএনপি আন্দোলনে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করতে চায়নি। এতে আন্দোলনকে ‘ষড়যন্ত্র’ বলে আখ্যায়িত করার সুযোগ পেত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং জন মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণও হয়তো সম্ভব হতো না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ছাত্র-জনতা সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণেই এই গণঅভ্যুত্থান সফল হয়েছে। তাদের মতে, বিএনপি একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল, আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের প্রধান প্রতিপক্ষ। এই আন্দোলনে অবশ্যই বিএনপি এবং এর অঙ্গ সংগঠন ছাত্রদলের ভূমিকা ছিল। সেটা না হলে এত বড় আন্দোলন সংগঠিত হওয়া কিছুটা কঠিন হতো বলে তারা মনে করছেন। তবে এই আন্দোলনে কোনো একক দল বা নেতার ভূমিকাও ছিল না বলে তারা উল্লেখ করেন।
যদিও জুলাই আন্দোলন দমনে কঠোর অবস্থান নেওয়া তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার প্রথম থেকেই এই আন্দোলনের ‘ষড়যন্ত্রকারী’ হিসেবে বিএনপি ও জামায়াতের দিকে ক্রমাগত আঙুল তুলেছিল। আন্দোলন চলাকালীন তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ ১৭ জুলাই গণমাধ্যমকে বলেছিলেন ‘তারেক জিয়া ( তারেক রহমান) বিভিন্নজনকে নির্দেশ দিচ্ছেন কোটা আন্দোলনকারীদের ভেতর ঢুকে পড়ার জন্য। ’
তবে আন্দোলন পরবর্তী সময় বিএনপির মহাসচিব দাবি করেন, ছাত্র আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদের সঙ্গে বিএনপির এবং দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সব সময় যোগাযোগ বা সংযোগ ছিল। সেসময় ঢাকা থেকে বিএনপির সাড়ে তিন হাজার নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং সে আন্দোলনকে বিএনপি ওউন করে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
এ বিষয়ে গণমাধ্যমকে তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশের কালচারে প্রবলেম হচ্ছে, ছাত্ররা অনেক সময় অন্য দলকে ওউন করতে চায় না এবং সমর্থন দিলে বলে দেয় যে সমর্থন আমাদের দরকার নেই। আমরা তো মাঠে ছিলামই। ’
কিন্তু বিএনপির পক্ষ থেকে যাকে এই আন্দোলনের ‘মূল নায়ক’ বলা হচ্ছে, সেই তারেক রহমানও আন্দোলন পরবর্তী সময় বারবার বলে আসছেন, ‘আওয়ামী অপশাসনের বিরুদ্ধে জুলাই আন্দোলন কোনো দল বা ব্যক্তির একার নয়, এটা সবার। ’ তারেক রহমানের বক্তব্যকে রাজনৈতিক বিচক্ষণতার প্রতীক হিসেবে দেখছেন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা।
তারা বলছেন, ফ্যাসিস্ট পরবর্তী রাষ্ট্রে তারেক রহমানের এই বক্তব্য আন্দোলনের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্য সুদৃঢ় করতে ভূমিকা রাখবে।
অভ্যুত্থান পরবর্তী রাষ্ট্রেও বিএনপিকে কোণঠাসা করে রাখার প্রচেষ্টা দেখা গেছে নানাভাবে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর থেকেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা এবং পরবর্তীতে তাদের একাংশের নেতৃত্বে গড়ে উঠা রাজনৈতিক দল এনসিপি এবং জামায়াতের প্রভাব দেখা গেছে প্রশাসন থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গায়। নানা সময় সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল এই দুটি দলের প্রতি পক্ষপাতিত্ব আচরণ করা নিয়েও। যদিও সরকারের তরফ থেকে বারবারই বলা হয়েছে, জুলাই আন্দোলনে অংশ নেওয়া সব দলের প্রতিই তারা সমান আচরণ করছে। তবে বাস্তবতা ছিল বেশ ভিন্ন।
দীর্ঘদিন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভোটের অধিকারসহ গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে যারা রাজপথে শামিল ছিলেন, মাত্র এক বছরের মাথায় এসে তারা এখন একে অপরকে নিশানা বানাচ্ছেন। শেখ হাসিনার শাসনের বিরুদ্ধে রাজপথে আন্দোলনে একমুখী ছিল সব পক্ষ। বছরখানেক আগের সেই আন্দোলনে ডান, বাম, মধ্যম, ইসলামপন্থিসহ সব পর্যায়ের শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে এক ধরনের ঐক্য গড়ে উঠেছিল। সময়ের পরিক্রমায় নানা ইস্যুতে সেই ঐক্যে বিভাজন দেখা দিয়েছে। রাজনীতির মাঠে অনৈক্যের সেই সুর ক্রমেই তীব্র হচ্ছে। বিশেষ করে ভোটের হিসাব-নিকাশ যত এগিয়ে আসছে, বিরোধ ততই প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে।
এক এগারোর ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলার’ মতো জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরবর্তী সময় আওয়ামী লীগের পাশাপাশি বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার উচ্চাভিলাষ ছিল স্বার্থান্বেষী মহল ও কিছু গোষ্ঠীর। কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়ায়, আওয়ামী লীগের পর তাদের মূল টার্গেট ছিল বিএনপি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এরই ফলস্বরূপ বিএনপিকে নানাভাবে কোণঠাসা করার ছকও তারা সুনিপুণভাবে আঁকার চেষ্টা করেন। তবে দীর্ঘ গণতান্ত্রিক লড়াইয়ে সংগ্রাম করে আসা এবং বহু নির্যাতনেও আপস না করা নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার দল বিএনপিকে নানা চেষ্টা করেও একটা বৃহৎ সমর্থকদের মন থেকে সরাতে তারা সক্ষম হয়নি।
এই বিপুল সমর্থনের প্রথম নিদর্শন দেখা যায় বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র পদ বুঝিয়ে না দেওয়ায় সংগঠিত আন্দোলনে। শাহবাগ থেকে মৎস্য ভবন এবং কাকরাইল মোড় পর্যন্ত এলাকাজুড়ে টানা তিন সপ্তাহ ধরে এই বিক্ষোভ চলে। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময় বিএনপির বিভিন্ন কর্মসূচি ঘিরে লাখ লাখ মানুষের সমাগম ঘটেছে রাজধানীতে।
২৮ মে দলটির তারুণ্যের সমাবেশ ঘিরে লাখও মানুষের জমায়েত ঘটে নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয় এবং এর আশেপাশের এলাকা ঘিরে। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ৩ আগস্ট শাহবাগে ছাত্রদলের সমাবেশ এবং ৬ আগস্ট বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনের অংশগ্রহণে বিজয় র্যালিতেও দেখা যায় একই চিত্র। ফলে নানা মহল থেকে বিএনপিকে জনবিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করা হলেও বাস্তবতা এর বিপরীতেই অবস্থান করছে।
আন্দোলন পরবর্তী সময় নির্বাচনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে জামায়াত ও এনসিপি একাট্টা। গত বছরের ৫ আগস্ট থেকেই দেখা যাচ্ছে, গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রনেতা বা সমন্বয়করা আর জামায়াত নেতারা একই সুরে কথা বলছেন। এনসিপি গঠনের পর থেকে জামায়াত ও এনসিপির কৌশল ও আচরণ অনেকটা সহোদর ভাইয়ের মতোই। অর্ধশত রাজনৈতিক দল বিএনপির পক্ষে থাকলেও ওই দল দুটির অবস্থান প্রতিটি ক্ষেত্রে বিএনপির বিরুদ্ধে। বিগত ১৫ বছর আওয়ামী লীগ যেমন রাজনৈতিক ইস্যুতে ‘বিএনপি-জামায়াত’ শব্দ ব্যবহার করতো, এখন তেমনই রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ‘জামায়াত-এনসিপি’ শব্দের ব্যবহার করতে শুরু করেছেন।
৫ আগস্টের পর রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনকে সরানো, সংবিধান সংশোধন, জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন, সংস্কারের পরে নির্বাচন, পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন, জুলাই ঘোষণাপত্র এমন কি লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠক এবং সেখান থেকে যৌথ বিবৃতিতে আগামী রমজানের আগে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন হতে পারে বলে ঘোষণা করলে, সে ইস্যুতেও এনসিপি ও জামায়াত একই অবস্থানে থেকে বিএনপির সমালোচনা করে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে।
যদিও রোজার আগে আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনাকে দেশের অন্য প্রায় সবগুলো রাজনৈতিক দল স্বাগত জানিয়েছিল, খুশি ছিল দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছর ভোটাধিকার বঞ্চিত থাকা সাধারণ মানুষও। এমন কি লন্ডন বৈঠকের আগে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানও ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যেই নির্বাচনের দাবি করেছিলেন। তবে লন্ডনের বৈঠকের পর যৌথ বিবৃতি আসার পর এনসিপি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানায়। এর পর পরই জামায়াতও তাদের আগের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের দাবির অবস্থান থেকে সরে আসে।
এমন কি কিছু স্বার্থান্বেষী মহল এবং গুটি কয়েক রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল সংস্কারের অজুহাত দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় রাখার পরিকল্পনা করার ব্যাপারেও। কেউ কেউ এই প্রক্রিয়াকে সমর্থন দেওয়ার অভিযোগ উঠিয়েছিল জামায়াত-এনসিপির বিরুদ্ধেও।
রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দ্রুত নির্বাচন হলে জামায়াত-এনসিপি এখন যেভাবে ক্ষমতার খুব কাছাকাছি থেকে সবকিছু ভোগ করতে পারছেন, সেই ব্যবস্থা ভেঙে যাবে বলেই নির্বাচনের প্রতি দল দুটির এই মুহূর্তে বেশ অনাগ্রহ আছে।
গত কয়েক মাসের রাজনৈতিক বাস্তবতা বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয়, এনসিপি কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণা করলে সেখানে জামায়াত নিয়মিত উপস্থিতি নিশ্চিত করছে। একইভাবে ১৯ জুলাই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জামায়াতের সমাবেশে এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত থেকে জামায়াতের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। যদিও পিআর পদ্ধতির বিরোধিতা করায় বিএনপিকে ওই সমাবেশে আমন্ত্রণ জানায়নি জামায়াত।
এ ছাড়া এনসিপির যেসব কর্মসূচিতে জামায়াত সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছে, সেসব কর্মসূচিতে জনসমাগম তুলনামূলকভাবে দৃশ্যমান হয় বলেও জানাচ্ছে কেউ কেই। কিন্তু জামায়াতের অংশগ্রহণ না থাকলে এনসিপির সমাবেশগুলো হয়ে পড়ে সিপিবি, বাসদ কিংবা জাসদের মতো ক্ষুদ্র দলীয় জমায়েতে সীমাবদ্ধ। এরই বাস্তব রূপ দেখা গেছে ৩ আগস্ট শহীদ মিনারে অনুষ্ঠিত এনসিপির সমাবেশে।
রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজনৈতিক মেরুকরণে জামায়াত ও এনসিপি কার্যত একই মেরুতে অবস্থান করছে এবং একে অপরের ওপর নির্ভর করে রাজপথে নিজেদের অবস্থান টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে।
তাদের মতে, জামায়াত-এনসিপির কাছে অপ্রিয় হলেও এটাই সত্য যে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যকার ঐতিহাসিক লন্ডন বৈঠকের পর বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপথ অনেকটাই পাল্টে গেছে। যে বিএনপিকে ‘সংস্কার চায় না’, ক্ষমতালোভী’, ‘বিএনপি শুধু নির্বাচন চায়’, ‘চাঁদাবাজের দলসহ’ নানা আখ্যায় জামায়াত-এনসিপি, এমন কি সরকারের কিছু উপদেষ্টারাও নানাভাবে ট্যাগ দিয়ে আসছিল, সেই দলই চলে আসে রাজনীতির মাঠের কেন্দ্রবিন্দুতে।
রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টদের মতে, লন্ডন বৈঠকের পর হঠাৎ এভাবে রাজনীতির চিত্রনাট্য বদলে যাওয়ার বিক্ষুব্ধ হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত জামায়াত-এনসিপি। এরই ধারাবাহিকতায় প্রথমে নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি বলে একে পেছানো, জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন চাওয়া, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবিত মৌলিক সংস্কারগুলোতে মতবিরোধ সৃষ্টি করা, জুলাই সনদকে আইনগত ভিত্তি দেওয়ার কথা বলা এবং সর্বশেষ পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে নানাভাবেই জামায়াত-এনসিপি বিএনপির বিরোধিতা করে গেছে। এসব বিভাজনে জামায়াত-এনসিপির একতাবদ্ধ আচরণে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টদের কেউ কেউ এনসিপিকে জামায়াতের ‘বি-টিম’, সরকারের মদদপুষ্ট ‘কিংস পার্টিসহ’ নানা নামেই আখ্যায়িত করেছে।
যদিও সাম্প্রতিক সময়ে চাঁদা দাবিসহ নানা বিতর্কিত এবং সন্দেহজনক ঘটনায় এনসিপির নেতাকর্মীদের নাম জড়িয়ে যাওয়ায় জুলাই গণঅভ্যুত্থানে তাদের প্রতি মানুষের যে আবেগ কাজ করছিল, তা অনেকটাই ফিকে হয়ে এসেছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ দলের সিনিয়র নেতাদের নিয়ে এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতাদের একের পর ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্যে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাই তাদের রাজনৈতিক পরিপক্কতা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছেন। এ ছাড়া সরকারি প্রটোকলে দলীয় কর্মসূচি করা এবং নানা উসকানিমূলক বক্তৃতার কারণে ইতোমধ্যেই তারা সমালোচিত হয়েছেন।
গত ৫ আগস্ট (মঙ্গলবার) প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বহু আকাঙ্ক্ষিত ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ পাঠের পরও দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। যেই জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে জামায়াত-এনসিপির সবচেয়ে বেশি আগ্রহ ছিল, বরং বিএনপি জুলাই সনদ বা ঘোষণাপত্র চায় না বলে তারা নানা সময় মন্তব্য করে গেছেন, তারাই একে ভালোভাবে নিতে পারেননি। জামায়াতের পক্ষ থেকে সরাসরি জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করা হয়েছে।
জামায়াতের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক এক প্রতিক্রিয়ায় দলটির নায়েবে আমির ডা. মোহাম্মদ তাহের সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘আমরা এই ঘোষণাপত্রে হতাশ, এই জাতি হতাশ। কারণ ঘোষণাপত্র সংবিধানে স্থান দেওয়ার দরকার ছিল। ৫ আগস্ট থেকে এই ঘোষণাপত্র বাস্তবায়ন করবে বলে আমরা শুনেছিলাম, কিন্তু এটা কখন থেকে বাস্তবায়ন হবে তার কোনো নির্দেশিকা নেই। ’ পরের দিন ৬ আগস্ট দলের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়াতেও এই ঘোষণাপত্রকে একটি অপূর্ণাঙ্গ বিবৃতি এবং এতে গণমানুষের প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটেনি বলে মন্তব্য করেছেন জামায়াতের নায়েবে আমির।
অন্যদিকে বিএনপি জুলাই ঘোষণাপত্রকে স্বাগত জানিয়ে দলের পক্ষ থেকে বিবৃতি দিয়েছে। ৬ আগস্ট দলটির মহাসচিব আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় জানিয়ে বলেন, ‘ঘোষিত জুলাই ঘোষণাপত্রে যেসব অঙ্গীকার করা হয়েছে, বিএনপি তা স্বাগত জানায়। আমরা বিশ্বাস করি এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, মানবিকতা, সাম্য ও ন্যায়ের ভিত্তিতে একটি নতুন, প্রগতিশীল ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের ভিত্তি তৈরি হবে। ’
যদিও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টদের মতে, জুলাই সনদে বিএনপি এবং এনসিপিকে সন্তুষ্ট করার প্রচেষ্টা দেখা গেছে।
তবে এসব ছাপিয়ে ৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ নজর কেড়েছে পুরো জাতির।
এদিন সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে লন্ডন বৈঠকের যৌথ বিবৃতির সম্ভাব্য সময় মোতাবেকই রমজানের আগে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধের যেকোনো সময়ই আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে ঘোষণা করেন প্রধান উপদেষ্টা।
এই ঘোষণায় বিএনপির দীর্ঘদিনের নির্বাচনের দাবি পুনরায় প্রাণ ফিরে পেয়েছে। ৬ আগস্ট দলের মহাসচিব আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় নির্বাচনের সময় ঘোষণা প্রসঙ্গে বলেন, ‘২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণাকে বিএনপি ইতিবাচকভাবে দেখছে। এই ঘোষণা রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটিয়ে গণতন্ত্রের উত্তরণের পথ সুগম করবে। ’
একই সময় তিনি নির্বাচনের তারিখ ঘোষণায় প্রধান উপদেষ্টা ও অন্তর্বর্তী সরকারকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের ধন্যবাদ জ্ঞাপনের বিষয়টিও গণমাধ্যমকে অবহিত করেন।
অন্যদিকে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা না করেই আগামী ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা দেওয়ায় বিস্মিত ও হতবাক হয়েছে জামায়াতে ইসলামী।
তবে দলটির নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলছেন, বিস্মিত হলেও জাতীয় স্বার্থে তারা প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণাকে ইতিবাচক হিসেবে নিতে চান।
যদিও নির্বাচন সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক না হলে এবং মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যে ভোট দিতে না পারলে এই নির্বাচন আবারও প্রশ্নবিদ্ধ হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেছেন।
একইভাবে নির্বাচনের সময় ঘোষণার এনসিপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণে নির্বাচনের যে তারিখ ঘোষণা করেছেন, সেখানে বিএনপির চাওয়াকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। জুলাই সনদের আইনি ও সাংবিধানিক ভিত্তি এবং বাস্তবায়ন পদ্ধতির বিষয়টি নিশ্চিত করেই নির্বাচনের দিকে যেতে হবে বলে তারা মন্তব্য করেছে।
ইতোমধ্যেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি শেষ করতে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) ৬ আগস্ট চিঠি দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়। সে অনুযায়ী কাজও শুরু করেছে ইসি। এ ছাড়া ৭ আগস্ট উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষেও একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেওয়ার বার্তা দেওয়া হয়েছে।
নির্বাচনের সময় ঘোষণা হলেও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এখনো মাঠের রাজনীতিতে নির্বাচন ঘিরে সংশয় কাটেনি বলেই মনে করছেন।
তারা বলছেন, বিদ্যমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন কঠিন হবে।
এ প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষিকা ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, ‘গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নিশ্চিতে নির্বাচন অবশ্যই অনুষ্ঠিত হতে হবে। এর আগে সংস্কার ও বিচারপ্রক্রিয়া দৃশ্যমান করতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু সেসব তো দৃশ্যমান নয়, এবং অনেক সময়ক্ষেপণও ইতোমধ্যে হয়ে গেছে। ফলে এখন যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন দিয়ে দেওয়াই ভালো। তবে এই নির্বাচন সুষ্ঠু করতে সব ধরনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। আইনশৃঙ্খলার যে পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে, সেই অবস্থার উন্নতি করতে দ্রুতই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। ’
অন্যদিকে সংকটের কোনো পরিস্থিতি তৈরি হবে বলে মনে করছেন না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ।
তিনি এ প্রসঙ্গে বাংলানিউজকে বলেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থানের সময় বিভিন্ন থানা থেকে লুট হওয়া অনেক অস্ত্রও এখনও সব উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। পুলিশ বাহিনী সবাই এখনো কার্যকর ও নিরপেক্ষ ভূমিকা রাখবে কি না, এ নিয়েও কিছুটা প্রশ্ন রয়েছে। ‘ল অ্যান্ড অর্ডারের’ ইস্যু ছাড়া নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে অন্য কোনো সংশয় আমি দেখছি না। ’
আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়ার পর দেশের সবচেয়ে বৃহৎ রাজনৈতিক দল এখন বিএনপি। অন্য রাজনৈতিক দলগুলো বিএনপির কাছাকাছি তো দূরের কথা, বিএনপির সঙ্গে কোনো ধরনের প্রতিযোগিতাই গড়ে তুলতে সক্ষম নয় বলেও মন্তব্য করছেন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা।
জামায়াত ও এনসিপিকে বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে গড়ে তোলার নানা চেষ্টাসাধ্য করা হলেই বাস্তব পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন।
টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া দীর্ঘ পদযাত্রার পরও এনসিপির সমাবেশে উল্লেখজনকভাবে সমাগমের উপস্থিতি না হওয়াই এর বড় প্রমাণ। অন্যদিকে জামায়াতের সমাবেশে বিপুল উপস্থিতি দেখা গেলেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে এখনো কোনো দক্ষিণপন্থি দল রাজনীতিতে শক্ত অবস্থান লাভ করতে সক্ষম হয়নি।
এদিকে আওয়ামী লীগ না থাকায় শক্তিশালী রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপিই সর্বোচ্চ সমর্থিত দল। বর্তমানে দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা অনুপস্থিত হলেও আওয়ামী লীগের ভোটাররা দেশেই অবস্থান করছেন। ওই ভোটাররা নির্বাচনের সময় কোনদিকে পক্ষ অবলম্বন করে, এর ওপরও অনেক কিছু নির্ভর করছে বলে মতামত রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টদের। নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে, ততই বিষয়গুলো আরও পরিষ্কার হবে বলেও তারা জানিয়েছেন।
এসবিডব্লিউে/এএটি