ঢাকা: অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম প্রধান লক্ষ্যের মধ্যে ছিল অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের হাতে রাষ্ট্র ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটি রূপরেখা ঘোষণা করেছেন।
তবে ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতির তোড়জোড় চললেও পর্দার আড়ালে গভীর ও পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের জাল বোনা হচ্ছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। প্রকাশ্যে নির্বাচনের কথা বলা হলেও, এই ষড়যন্ত্রের মূল অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর), ‘জুলাই সনদ’-এর সাংবিধানিকীকরণ এবং গণপরিষদ নির্বাচনের মতো জটিল ও সময়সাপেক্ষ সংস্কারের দাবি।
এমন পরিস্থিতিতে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও বুধবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র চলছে। একটি মহল পরিকল্পিতভাবে নির্বাচন বানচাল করার জন্য নিত্যনতুন অপ্রাসঙ্গিক দাবি উত্থাপন করছে।
তিনি আরও বলেন, ‘পত্রিকায় বেরিয়ে বাংলাদেশের এক ব্যাংক লুটেরা এস আলম দিল্লিতে বসে শেখ হাসিনাকে আড়াই হাজার কোটি টাকা দিয়েছেন। ওই টাকা ব্যবহার করে নির্বাচন বন্ধ করা এবং শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
এছাড়া প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন দাবি দাওয়া নিয়ে মিছিল, মিটিং, রাজধানীর সড়ক অবরোধ করে যে অস্থিরতা সৃষ্টি করা হচ্ছে, তা নির্বাচন বানচাল করা বা পিছিয়ে দিতে বাধ্য করার একটি সুক্ষ্ম কূটকৌশল বলে বিভিন্ন গোয়েন্দা রিপোর্টে উঠে এসেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একটি বড় অংশ মনে করছেন, এই দাবিগুলো যতই গণতান্ত্রিক বা সংস্কারমূলক শোনাক না কেন, এর গভীরে লুকিয়ে আছে নির্বাচনকে নির্দিষ্ট সময়ে হতে না দেওয়ার এক সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, এই দাবিগুলোর উত্থাপন কি সত্যিই রাষ্ট্রব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের সদিচ্ছা, নাকি নির্বাচন বানচালের এক পরিকল্পিত কৌশল? এর পেছনে কার কী স্বার্থ জড়িত, আর এই জটিল সমীকরণে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎই বা কোন পথে হাঁটছে- এসব নিয়েই এখন চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।
বর্তমানে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো দুটি প্রধান ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়েছে। একটি ধারার নেতৃত্বে রয়েছে দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং তাদের সমমনা কয়েকটি দল। তারা অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষিত সময়সীমা অনুযায়ী, অর্থাৎ ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছে। তারা মনে করছেন, দেশের সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা এবং জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচন হওয়া অপরিহার্য।
অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এবং কয়েকটি ইসলামপন্থী দল নির্বাচনের আগে বিদ্যমান আসনভিত্তিক ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট' পদ্ধতির পরিবর্তে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচন আয়োজন, ‘জুলাই সনদ’-কে আইনি ভিত্তি প্রদান এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে একটি গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন করে সংবিধান প্রণয়নের মতো মৌলিক সংস্কারের দাবি জানাচ্ছে।
বিএনপির শীর্ষ নেতারা মনে করছেন, এই সংস্কারের দাবিগুলো বাহ্যিকভাবে যতই যৌক্তিক মনে হোক না কেন, এর অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য হলো নির্বাচনকে বিলম্বিত করা। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ২১ আগস্ট এক বক্তব্যে স্পষ্ট জানিয়েছেন, বাংলাদেশের বর্তমান আর্থসামাজিক, ভৌগোলিক, রাজনৈতিক পরিস্থিতি পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের জন্য উপযোগী নয়। পিআর পদ্ধতির দাবি মূলত নির্বাচন পরিস্থিতি ঘোলাটে করার অপচেষ্টা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যারা আসন্ন নির্বাচন সামনে রেখে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার অপচেষ্টা করছেন, এর মাধ্যমে আপনারা হয়তো নিজেদের অজান্তেই গণতন্ত্রের উত্তরণের পথকে বাধাগ্রস্ত করে তুলছেন। একই সাথে পতিত পরাজিত পলাতক ফ্যাসিস্ট সরকারের পুনর্বাসনের পথও হয়তো সুগম হচ্ছে। ’
বিএনপির নীতিনির্ধারকদের মতে, নির্বাচন বিলম্বিত করার ‘ষড়যন্ত্র ও কৌশল’ হিসাবেই এসব ইস্যু সামনে আনা হচ্ছে। নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতেই হবে। মানুষ ভোট দিয়ে তার প্রতিনিধি নির্বাচন করবে এবং সেই প্রতিনিধিরা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে। সেই ভোটই মানুষ দেখতে চায়। নেতাদের অভিযোগ, নির্বাচনে বিএনপির সম্ভাব্য ‘বড় জয়’ ঠেকানোর জন্যই এসব করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে একটি চিহ্নিত মহল দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে নির্বাচন ঠেকানোর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছে বলে দাবি করছেন বিএনপির নেতারা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ এ প্রসঙ্গে বাংলানিউজকে বলেন, ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক এবং সামাজিক ব্যবস্থায় মানুষ তার নির্দিষ্ট নির্বাচনী এলাকায় একজন ব্যক্তিকে জনপ্রতিনিধি হিসাবে দেখে অভ্যস্ত। যিনি জনগণের প্রতিনিধিত্ব করবেন, তাকে দেখেই ভোট দেওয়া হয়। একাধিক প্রতিনিধি মানুষের মধ্যে ভোটের আগ্রহ কমিয়ে দেবে এবং কার্যকরী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে না। পিআর পদ্ধতিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথা যারা বলছেন, তারা হয় নির্বাচন বিলম্বিত করতে, না হয় বাংলাদেশে নির্বাচন না হওয়ার উদ্দেশ্য সামনে রেখেই এমনটি বলছেন। ’
এর বিপরীতে, সংস্কারপন্থীদের যুক্তি হচ্ছে- গত কয়েক দশকের ভঙ্গুর ও বিতর্কিত নির্বাচনী ব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতির আমূল পরিবর্তন ছাড়া একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করলেও তার ফল টেকসই হবে না। তাদের মতে, পুরোনো পদ্ধতির অধীনে নির্বাচন হলে ক্ষমতার পালাবদল হলেও শাসনব্যবস্থার গুণগত কোনো পরিবর্তন আসবে না এবং দেশ আবারও পুরোনো সংকটেই ফিরে যাবে।
জামায়াতে ইসলামী পিআর পদ্ধতির পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়ে জানিয়েছে, ভোটের প্রকৃত প্রতিফলনের জন্য এই পদ্ধতিই সর্বোত্তম এবং এই দাবিতে তারা প্রয়োজনে আন্দোলন কর্মসূচির কথাও ভাবছে। জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘যারা সংস্কারের বিরুদ্ধে, তারা যেনতেন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসতে চায়। আমরা যারা পিআর চাই, আমরা যারা সংস্কার চাই, যারা দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ চাই, সবাই মাঠে আবার ঐক্যবদ্ধভাবে দাবি পূরণে সরকারকে বাধ্য করব। ’
এদিকে সংবিধান–সম্পর্কিত বিষয়গুলো বাস্তবায়নের জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে এনসিপি। গণপরিষদ নির্বাচন না করে তারা জাতীয় সংসদ নির্বাচন চান না বলেও মন্তব্য করেছেন এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন।
তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করি, গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সংবিধান করে তারপর রিস্টার্ট করবেন বাংলাদেশকে। ’ দলটির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীও জানিয়েছেন, বাংলাদেশে যদি কোনো নির্বাচন হয়, আগে অবশ্যই গণপরিষদ নির্বাচন হতে হবে। জনগণের নিরাপত্তা ও শহীদদের রক্তের মর্যাদা রক্ষার জন্য একটি নতুন সংবিধান জরুরি বলে তারা মনে করছেন। তাদের মতে, বিদ্যমান সংবিধানের আওতায় থেকে কাঙ্ক্ষিত সংস্কার সম্ভব নয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, পিআর পদ্ধতি নিয়ে বিতর্কের মূলে রয়েছে বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক লাভ-ক্ষতির জটিল হিসাবনিকাশ। বর্তমানে বাংলাদেশে যে আসনভিত্তিক নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রচলিত আছে, তাতে কোনো একটি আসনে যিনি সবচেয়ে বেশি ভোট পান, তিনিই নির্বাচিত হন, পরাজিত প্রার্থীদের ভোটগুলো মূল্যহীন হয়ে যায়। এর ফলে প্রায়শই দেখা যায়, কোনো দল দেশব্যাপী ৪০ শতাংশ ভোট পেয়েও দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়ী হয়ে যায়, আবার ৩৮ শতাংশ ভোট পেয়েও বিরোধী দলে পরিণত হয়।
বিশ্লেষকরা ২০০১ সালের নির্বাচনের উদাহরণ টেনে বলেন, সেবার বিএনপি ৪০.৯৭ শতাংশ ভোট পেয়ে ১৯৩টি আসন জিতেছিল, আর আওয়ামী লীগ ৪০.১৩ শতাংশ ভোট পেয়েও মাত্র ৬২টি আসনে জয়ী হয়। পিআর পদ্ধতি চালু হলে, প্রতিটি দল দেশব্যাপী প্রাপ্ত ভোটের হারের ওপর ভিত্তি করে সংসদে আসন পাবে। এতে ছোট দলগুলোরও সংসদে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ তৈরি হবে, যা বর্তমান ব্যবস্থায় প্রায় অসম্ভব।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি বা অন্যান্য ছোট দলগুলো ভালো করেই জানে যে, বিদ্যমান পদ্ধতিতে বড় দুই দলের বাইরে তাদের পক্ষে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আসন পাওয়া কঠিন। তাই পিআর পদ্ধতির মাধ্যমে তারা সংসদে নিজেদের একটি সম্মানজনক উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায়।
অন্যদিকে, বিএনপি মনে করে, বিদ্যমান পদ্ধতিতেই তাদের এককভাবে সরকার গঠনের সম্ভাবনা বেশি। তাদের আশঙ্কা, পিআর পদ্ধতি চালু হলে কোনো দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না, যার ফলে একটি ঝুলন্ত সংসদ তৈরি হবে এবং ঘন ঘন সরকার পতনের মতো রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেখা দিতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ এ প্রসঙ্গে বাংলানিউজকে বলেন, ‘পিআর পদ্ধতিকে ঘিরে যে বিতর্ক হচ্ছে তার মূল্য উদ্দেশ্য রাজনৈতিক স্বার্থ ও ক্ষমতা ভাগাভাগির প্রশ্ন। দলগুলো নিজের স্বার্থ অনুযায়ী অবস্থান নিয়েছে। কেউ নিজ স্বার্থে বিরোধিতা করছে। আবার কেউ নিজেদের স্বার্থে এর পক্ষে কথা বলছে। এখানে ক্ষমতা ভাগাভাগির প্রশ্নই বড়। নির্বাচন পর্যন্ত এটা চলতে থাকবে। নির্বাচনের আগে মীমাংসা না হলে যেভাবে আছে সেভাবেই নির্বাচন হয়ে যাবে বলে মনে করি। ’
বিশিষ্ট আইনজীবী শাহদীন মালিক এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘পিআর পদ্ধতি অনেক জটিল। জনগণকে বোঝানো কঠিন। নিম্নকক্ষ ও উচ্চকক্ষের সম্পর্ক কী হবে এসব বিবেচনায় নিতে হবে। নিম্নকক্ষ কোনো আইন পাস করলে সেটি কি উচ্চকক্ষ বাতিল করতে পারবে? বাতিল না করে তাদেরও যদি ইয়েস বলতে হয়, তাহলে উচ্চকক্ষ থেকে লাভ কী? নিম্নকক্ষের কাজ কী হবে এবং উচ্চকক্ষের কাজ কী হবে, দুটি কক্ষের কাজ যদি একই হয়; কার সিদ্ধান্ত প্রাধান্য পাবে, এগুলো জটিল বিষয়। পিআরের ভিত্তিতে গঠিত উচ্চকক্ষে যদি বিরোধ হয় তখন কী হবে, জটিল প্রশ্ন আছে। দেশের জন্য কোনটা উপযোগী হবে, পর্যালোচনা করতেই অন্তত ১০ বছর সময় লাগবে। ’
এদিকে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আইনি ভিত্তি দেওয়া না দেওয়ার প্রশ্নেই বিএনপির সঙ্গে জামায়াত ও এনসিপির বিরোধ চরমে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এই সনদ চূড়ান্ত করার জন্য দীর্ঘ সময় ধরে বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে আলোচনা চালিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে এর আইনি ভিত্তি নিয়ে। জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির মতো দলগুলো চাইছে, এই সনদকে গণভোট বা গণপরিষদের মাধ্যমে সাংবিধানিক সুরক্ষা দিয়ে এটিকে রাষ্ট্রের একটি স্থায়ী দলিলে পরিণত করা হোক। অন্যদিকে বিএনপি এবং এর মিত্র কিছু দল ও জোট অবস্থান নিয়েছে জুলাই সনদকে আইনি ভিত্তি দেওয়ার বিরুদ্ধে।
তারা বলছে, জুলাই সনদে বিভিন্ন দলের স্বাক্ষরই এর রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতার জন্য যথেষ্ট। এটিকে সংবিধানের ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়ার যেকোনো প্রচেষ্টা একটি ‘অতি-সাংবিধানিক দলিল’ তৈরির শামিল হবে, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। গণপরিষদ নির্বাচনের প্রশ্নটাও অবান্তর বলে মনে করছেন তারা। তাদের দাবি, রাষ্ট্র সংবিধানশূন্য অবস্থায় নেই। বিদ্যমান সংবিধানের অধীনেই অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নিয়ে দেশ পরিচালনা করছে। অধিকাংশ রাজনৈতিক ও আইন বিশ্লেষকের মত যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানতম এবং একমাত্র ম্যান্ডেট হলো একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। সংবিধানের মৌলিক কাঠামো পরিবর্তন করা, নির্বাচনী ব্যবস্থা বদলে ফেলা বা গণপরিষদ নির্বাচনের মতো যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেওয়ার আইনগত বা নৈতিক কোনো এখতিয়ার এই সরকারের নেই।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচন যদি কোনো কারণে বিলম্বিত হয়, তাহলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে যারা এখনও রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত নয় এবং নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতে আরও সময় পেতে চায়। এছাড়া, একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি জিইয়ে রেখে যারা নেপথ্যে থেকে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চায়, তারাও নির্বাচন পেছানোর পক্ষে বলে মনে করছেন তারা। বিএনপির পক্ষ থেকে প্রায়শই আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে, একটি মহল দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে ষড়যন্ত্র করছে, যাদের মূল উদ্দেশ্য গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে চিরতরে নির্বাসনে পাঠানো। নির্বাচন পিছিয়ে গেলে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর দেশি-বিদেশি চাপ বাড়বে এবং দেশের ভঙ্গুর অর্থনীতি আরও সংকটের মুখে পড়বে বলেও মনে করেন তারা।
অন্যদিকে, যারা নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচন চান, বিশেষত বিএনপি, তারা মূলত দ্রুত নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের রায় নিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগটি হারাতে চান না বলে মনে করছেন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা। দীর্ঘ প্রায় দুই দশক পর দেশের তরুণ প্রজন্মের একটি বিশাল অংশ প্রথমবারের মতো ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। বিএনপি মনে করে, এই নতুন ভোটাররা এবং সরকারের পরিবর্তনকামী জনগণ তাদের পক্ষেই রায় দেবে।
যারা সংস্কারের দাবি তুলছেন, তাদের যুক্তি অনুযায়ী- সংস্কার ছাড়া নির্বাচন হলে দেশের কোনো মৌলিক সমস্যার সমাধান হবে না। তাদের মতে, তাড়াহুড়ো করে একটি নির্বাচন আয়োজন করলে তা অর্থবহ হবে না এবং দেশে আবারও একটি 'স্বৈরতন্ত্রের' জন্ম হতে পারে। তবে তাদের এই আপাত যৌক্তিক দাবির পেছনে নির্বাচন পেছানোর মাধ্যমে রাজনৈতিকভাবে নিজেদের গুছিয়ে নেওয়ার একটি কৌশলও কাজ করছে বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন।
অধিকাংশ রাজনৈতিক বিশ্লেষক এই বিষয়ে একমত যে, দেশের ভঙ্গুর গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার এবং প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জন্য একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নানা শর্ত বা জটিল সংস্কারের দাবি এই মুহূর্তে নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার ঝুঁকি তৈরি করছে। দলীয় এজেন্ডার কারণে ফেব্রুয়ারির নির্বাচন কোনো কারণে অনিশ্চিত হয়ে পড়লে দেশের বিদ্যমান নিরাপত্তা ঝুঁকি আরও বৃদ্ধি পাবে এবং সেরকম পরিস্থিতিতে আম-ছালা দুটোই চলে যেতে পারে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, ‘নির্বাচনের বিষয়ে ঐকমত্যে না পৌঁছাতে পারাটা বিপদজনক হবে। নির্বাচন না হলে কারোই কোনো লাভ হবে না, বরং সবার জন্যই ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। রাজনৈতিক দলগুলো এ ভুলের দিকে যাবে না বলে ধারণা করি। ’
বিশ্লেষকদের অভিমত- পিআর পদ্ধতি, জুলাই সনদের সাংবিধানিকীকরণ বা গণপরিষদের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও নীতি-নির্ধারণী বিষয়গুলো নিয়ে অবশ্যই আলোচনা হতে পারে, তবে সেই আলোচনার স্থান জনগণের ভোটে নির্বাচিত সার্বভৌম সংসদ। একটি অনির্বাচিত অন্তর্বর্তী সরকারের কাঁধে এই বিশাল দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়ার অর্থ হলো, নির্বাচনকে ঘিরে চলমান ষড়যন্ত্রকে সফল হতে দেওয়া।
তারা মনে করছেন, সব রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের উচিত হবে, এই মুহূর্তে সমস্ত বিতর্কিত বিষয়কে একপাশে রেখে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ তৈরিতে অন্তর্বর্তী সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা। এর মাধ্যমেই জনগণের ভোটাধিকার পুনরুদ্ধার হবে এবং দেশে একটি স্থিতিশীল ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হবে বলে মনে করছেন তারা। এর ব্যত্যয় ঘটলে দেশ এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হতে পারে বলে আশঙ্কা তাদের।
এসবিডব্লিউ/এজে