ঢাকা, সোমবার, ২৩ ভাদ্র ১৪৩২, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

বাংলানিউজ স্পেশাল

‘লাশ তুলে পোড়ানো মানবজাতির মর্যাদায় আঘাত’

আবাদুজ্জামান শিমুল, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২:০৪, সেপ্টেম্বর ৬, ২০২৫
‘লাশ তুলে পোড়ানো মানবজাতির মর্যাদায় আঘাত’ নুরাল পাগলার কবর, বাড়ি ও দরবার শরিফে হামলা-ভাঙচুর করা হয়

ঢাকা: সম্প্রতি দেশে ‘মব জাস্টিস’ বা সংঘবদ্ধ অপরাধ উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। কিন্তু শুক্রবার জুমার নামাজের পর রাজবাড়ীতে যে ঘটনা ঘটেছে, তা দেশের ইতিহাসে ন্যক্কারজনক দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

কথিত মাজার ও বাড়িতে হামলার পাশাপাশি সেখানে লাশ তুলে পোড়ানোর মতো ঘটনা ঘটেছে। মরদেহ নির্যাতনের এই ঘটনা সভ্য সমাজে অকল্পনীয় বলছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, কবর থেকে লাশ তুলে তা পোড়ানো সভ্যতাবিরোধী সংকট, এটি গোটা মানবজাতির মর্যাদায় আঘাত।

ঘটনাটি ঘটেছে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার জুড়ান মোল্লাপাড়ায়। নুরাল হক ওরফে ‘নুরাল পাগলা’র কবরকে কেন্দ্র করে কয়েক দিন ধরেই আলোচনা ও উত্তেজনা চলছিল সেখানে। গত ২৩ আগস্ট তার মৃত্যুর পর নুরাল পাগলাকে দাফনের কবর নিয়ে নানান প্রশ্ন ও অভিযোগ ওঠে।

স্থানীদের ভাষ্যে, আশির দশকের শেষ দিকে নিজেকে ‘ইমাম মাহদী’ দাবি করে আলোচনায় আসেন রাজবাড়ীর গোয়ালন্দের নুরুল হক ওরফে নুরাল পাগলা। ওই সময় তার দাবিকে কেন্দ্র করে জনরোষ তৈরি হলে এক পর্যায়ে মুচলেকা দিয়ে এলাকা ছাড়তে বাধ্য হন তিনি। কিন্তু কিছুদিন পর আবার ফিরে এসে তিনি গোয়ালন্দ পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডে নিজ বাড়িতে কথিত ‘দরবার শরিফ’ গড়ে তোলেন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেটি পরিচালনা করতে থাকেন।

গত ২৩ আগস্ট বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় রাজধানীর একটি হাসপাতালে নুরাল পাগল মারা যান। মৃত্যুর পর তার মরদেহ দরবারের ভেতরে মাটি থেকে প্রায় ১২ ফুট উঁচুতে বিশেষ কায়দায় দাফন করে কাবা শরিফের আদলে সাজানো হলে স্থানীয় জনতা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। লোকজন এটিকে ‘শরিয়তবিরোধী’ বলে তখন থেকেই প্রতিবাদ জানিয়ে আসছিলেন। তারা কবর সমতল করাসহ কয়েকটি দাবি জানান।

এরপর গত ২ সেপ্টেম্বর সংবাদ সম্মেলন করে নুরাল পাগলার আস্তানায় অনৈতিক কার্যকলাপের অভিযোগ করে উপজেলা ‘ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটি’। তারা ৪ সেপ্টেম্বরের মধ্যে দাবি পূরণের আলটিমেটাম দেয়। অন্যথায় ৫ সেপ্টেম্বর শুক্রবার জুমার নামাজের পর গোয়ালন্দ আনসার ক্লাব মাঠে বিক্ষোভ সমাবেশ ও পরে ‘মার্চ ফর গোয়ালন্দ’ কর্মসূচি পালন করার ঘোষণা দেয়।  

ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী শুক্রবার জুমার নামাজের পর আনসার ক্লাব চত্বরে বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করে উপজেলা ‘ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটি’। কর্মসূচিতে একদল লোক শাবল, বড় হাতুড়ি ও লাঠিসোঁটা নিয়ে হাজির হয়। এ সময় উপস্থিত আলেম-ওলামা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করলেও উত্তেজনা ছড়িয়ে ওই লোকজন মিছিল নিয়ে নুরুল হকের বাড়ির দিকে রওনা হয়। তখন পুলিশের দুটি গাড়ি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। মিছিল নিয়ে প্রথমে নুরাল পাগলার আস্তানার ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করে। তখন দরবারের লোকজন ইটপাটকেল ছুঁড়লে অপর পাশ থেকেও ইটপাটকেল ছোড়া হয়। একপর্যায়ে কয়েকশ লোক দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকে দরবারে হামলা চালায়। এ সময় ভক্তদের কয়েকজনকে বেধড়ক পেটানো হয় এবং নুরাল পাগলার বাড়িতেও ভাঙচুর চালানো হয়। পরে তার লাশ কবর থেকে তুলে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের গোয়ালন্দ বাসস্ট্যান্ডের অদূরে পদ্মার মোড় এলাকায় নিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। হামলায় উভয় পক্ষের অন্তত অর্ধশত লোক আহত হন। একজন হাসপাতালে মারা যান।

কবর ভেঙে লাশ বের করে আনা ও পুড়িয়ে দেওয়ার এরকম ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সমালোচনার ঝড় ওঠে। ভিডিওতে দেখা যায়, একদিকে আগুন জ্বলছে, আর কিছু মানুষ উল্লাস করছে। খোদ অন্তর্বর্তী সরকারই নিন্দা জানায়। এটিকে গভীর সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়ের ইঙ্গিত বলে অনেকে উল্লেখ করেন।

অন্তর্বর্তী সরকার বলেছে, ‘এই অমানবিক ও ঘৃণ্য কাজটি আমাদের মূল্যবোধ, আমাদের আইন এবং একটি ন্যায়ভিত্তিক ও সভ্য সমাজের মৌলিক ভিত্তির ওপর সরাসরি আঘাত। এ ধরনের বর্বরতা কোনো অবস্থাতেই সহ্য করা হবে না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আইনের শাসন সমুন্নত রাখতে এবং প্রতিটি মানুষের জীবনের পবিত্রতা, জীবদ্দশায় এবং মৃত্যুর পরেও রক্ষা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ’

অন্যদিকে বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় দল বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ‘আজ আমরা নিজেরা দ্বিধাবিভক্ত। আমরা কারো মাজার ভাঙছি। কোনো লাশ পুড়িয়ে দিচ্ছি। এটা তো রাসুলের (সা.) শিক্ষা নয়। ’

শনিবার নয়াপল্টনে ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে আয়োজিত মিলাদ ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, রাজবাড়ীর গোয়ালন্দের ঘটনায় তৌহিদি জনতার নামে দেশে যে উৎপাত ও নৈরাজ্য শুরু হয়েছে, এর পেছনে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র রয়েছে। বিএনপির আমলে যেমন শেখ হাসিনা দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে চক্রান্ত করছিল, আবারও সে রকম ষড়যন্ত্র চলছে কি না অন্তর্বর্তী সরকারকে তা খুঁজে বের করার আহ্বান জানান তিনি।

কবর থেকে লাশ তুলে পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি। এ ঘটনায় প্রশাসনের ব্যর্থতা ও বিএনপি ও জামাতের ‘সংশ্লিষ্টতার’ ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছে এনসিপি। একইসঙ্গে এই ‘মব সন্ত্রাসে’ জড়িতদের বিচারের দাবি জানিয়েছে তারা।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী বিবৃতি বলেছে, “লাশ উঠিয়ে পুড়িয়ে ফেলার অনুমতি ইসলাম দেয় না। এটি মানবতা এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের গুরুতর লঙ্ঘন। আমরা এই ঘটনার বিরুদ্ধে তীব্র উদ্বেগ এবং নিন্দা জানাই। ” ধর্মীয় ও মানবিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে এই কার্যকলাপকে নিন্দনীয় ও অগ্রহণযোগ্য হিসেবে দেখছে দলটি।

হেফাজতে ইসলামের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ইসলামে লাশ পোড়ানো নিষিদ্ধ। এটি মানবিক মর্যাদার প্রশ্ন। ইসলাম-প্রদত্ত এই মর্যাদা কেড়ে নেওয়ার অধিকার কারও নেই। ফলে নুরাল পাগলার লাশ পোড়ানো নিন্দনীয় ও অগ্রহণযোগ্য কাজ। একটি অন্যায় রোধ করতে গিয়ে আরেকটি অন্যায় করার সুযোগ নেই।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আইনজীবী বাংলানিউজকে বলেন, এমন আচরণ বাংলাদেশের আইনে স্পষ্টভাবে ফৌজদারি অপরাধ। মৃত ব্যক্তির মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করা এবং লাশের সঙ্গে এমন আচরণ করা দণ্ডনীয়। এ ঘটনায় যারা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন, যাতে ভবিষ্যতে কেউ এমন সাহস করতে না পারে। এছাড়া ইসলাম শান্তির ধর্ম, যেখানে মৃত ব্যক্তিকেও সম্মানের সঙ্গে দাফনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অথচ এখানে ধর্মের নামে একজনের মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে।

এ বিষয়ে সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বাংলানিউজকে বলেন, মৃতদেহ কবর থেকে তুলে আগুনে পুড়িয়ে ফেলা—এটিকে শুধু একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখা যায় না, বরং এটি সমাজে বিদ্যমান নৈতিক অবক্ষয়, আইনশৃঙ্খলার দুর্বলতা এবং সহিংস জনমতের উত্থানের উদ্বেগজনক চিহ্ন হিসেবে চিহ্নিত। কবরস্থ একটি মৃতদেহকে অপমান করা, কবর থেকে লাশ উত্তোলন ও দাহ—শুধু একটি ব্যক্তির নয়, গোটা মানবজাতির মর্যাদার বিরুদ্ধে আঘাত।

পৃথিবীর ইতিহাসে যুদ্ধকালীন সময় বা বর্বর জাতিগোষ্ঠীর মধ্যেও এমন দৃষ্টান্ত বিরল উল্লেখ করে তিনি বলেন, সভ্য সমাজে মৃত ব্যক্তির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা একটি মৌলিক নৈতিকতা এবং মানবিকতার স্তম্ভ। এই সীমালঙ্ঘন শুধু সামাজিক ব্যর্থতা নয়, মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ঘটনাটি যে জঘন্য তা যেমন সত্য, তেমনি গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে—এই কাজটি যারা সংঘটিত করেছে, তারা কীভাবে এতটা সাহস পেল? আমরা দেখেছি, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে ‘মব জাস্টিস’ বা গণবিচারের প্রবণতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। যখন মানুষ মনে করে, আইনের মাধ্যমে ন্যায়বিচার পাওয়া সম্ভব নয়, তখন তারা নিজেরাই বিচারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, যা অত্যন্ত বিপজ্জনক সামাজিক সংকেত। কোনো একটি ঘটনা ঘটার পর তা ঠেকানো না গেলেও, ঘটনার পরপরই কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কিন্তু এ ধরনের সহিংসতা যদি বারবার ঘটে এবং অপরাধীরা শাস্তির মুখোমুখি না হয়, তবে এটি ভবিষ্যতে আরও বড় বিপদের ইঙ্গিত দেয়।  

‘এ ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র যদি কঠোর অবস্থান না নেয়, তবে আইন ও শৃঙ্খলার প্রতি জনগণের আস্থা আরও দুর্বল হয়ে পড়বে’—সতর্ক করেন এই অপরাধ বিশেষজ্ঞ।  

তিনি বলেন, এই ঘটনায় ধর্মীয় ব্যাখ্যা ও ফতোয়ার দোহাই দিয়ে সহিংসতা ঘটানো হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ধর্মীয় অনুভূতি অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি বিষয় এবং সেটিকে ভুলভাবে ব্যবহার করে জনমনে ঘৃণা ছড়ানো এক ধরনের ‘হেইট ক্রাইম’ বা বিদ্বেষমূলক অপরাধ। ধর্মকে রাজনৈতিক কিংবা প্রতিশোধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করলে সমাজে ধর্মের প্রকৃত বার্তা চাপা পড়ে যায়। এই ঘটনার মাধ্যমে উঠে এসেছে আরেকটি অন্ধকার দিক—মানবিক সহানুভূতির চরম অভাব। একটি সমাজে সহানুভূতি, সহনশীলতা এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধা যত কমে যায়, সহিংসতা ততটাই স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী সামাজিক অবক্ষয়ের ফল, যা শুধুমাত্র আইন প্রয়োগ করেই নয়, শিক্ষা, সচেতনতা ও সংস্কৃতির মাধ্যমে প্রতিরোধ করতে হবে।  

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক তৌহিদুল হক বলেন, এই ঘটনাটি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে আমরা কোথায় এসে দাঁড়িয়েছি। সভ্যতার মুখোশ পরে আমরা যেন আবার অসভ্যতার দিকে ফিরে যাচ্ছি। এখনই যদি কঠোর আইনগত ও সামাজিক পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে এমন বর্বরতা ভবিষ্যতে আর বিরল থাকবে না, এটি নৈমিত্তিক হয়ে উঠবে।

এজেডএস/এইচএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।