ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩১ ভাদ্র ১৪৩২, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২৩ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

বাংলানিউজ স্পেশাল

বাংলানিউজ এক্সপ্লেইনার

অভ্যুত্থানে ‘নেতৃত্ব দেওয়া’ ছাত্রনেতাদের ‘ভরাডুবি’ কেন?

ফাহিম হোসেন, ইউনিভার্সিটি করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১:৩৫, সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২৫
অভ্যুত্থানে ‘নেতৃত্ব দেওয়া’ ছাত্রনেতাদের ‘ভরাডুবি’ কেন?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে এবার অংশ নিয়েছিলেন জুলাই অভ্যুত্থানে সামনের সারিতে নেতৃত্ব দেওয়া একাধিক নেতা। তবে নির্বাচনে জয়ী হতে পারেননি কেউই; শীর্ষ তিনেও স্থান পাননি অনেকেই।

অভ্যুত্থানে সামনের সারিতে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের একটি অংশ ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ থেকে বের হয়ে ২৮ ফেব্রুয়ারি ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি’ নামে রাজনৈতিক দল গঠন করে। উপদেষ্টার পদ ছেড়ে দলের হাল ধরেন অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম।

আরেকটি অংশ ক্যাম্পাসে থেকে যান এবং ছাত্ররাজনীতি চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। চলতি বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি সাবেক সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদারকে আহ্বায়ক এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দপ্তর সম্পাদক জাহিদ আহসানকে সদস্য সচিব করে তারা ‘গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন।

সংগঠনটি মধ্যপন্থী রাজনীতি করবে বলে ঘোষণা দেয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ও একাডেমিক এলাকায় রাজনৈতিক কার্যকম পরিচালনা করবে না বলে সিদ্ধান্ত নেয়।

এবারের ডাকসু নির্বাচনে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আহবায়ক আব্দুল কাদের ভিপি পদে এবং কেন্দ্রীয় আহবায়ক আবু বাকের মজুমদার জিএস পদে নির্বাচন করেন। এ ছাড়া একাধিক সাবেক সমন্বয়ক ও গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের নেতা এই প্যানেল থেকে নির্বাচনে অংশ নেন।

‘বিপুল সম্ভাবনা’ থাকলেও নির্বাচনে ‘অপ্রত্যাশিত’ ফল পেয়েছেন এই নেতারা। ভিপি পদে আব্দুল কাদের পেয়েছেন মাত্র এক হাজার ১০৩ ভোট। ক্রম অনুযায়ী যা চতুর্থ। যেখানে শিবিরের মোহাম্মদ আবু সাদিক (সাদিক কায়েম) ১৪ হাজার ৪২ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন।

জিএস পদে আবু বাকের মজুমদার ভোট পেয়েছেন ২ হাজার ১৩১; পদক্রম অনুযায়ী তার অবস্থান পঞ্চম। শিবিরের এসএম ফরহাদ ১০ হাজার ৭৯৪ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন।

এজিএস পদে আশরেফা খাতুনের অবস্থা আরও শোচনীয়। মাত্র ৯০০ ভোট পেয়ে তিনি ষষ্ঠ অবস্থানে রয়েছেন। জয়ী প্রার্থী পেয়েছেন ১১ হাজার ৭৭২ ভোট।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিপি পদে এবার ভোট দিয়েছেন ২৯ হাজার ২৫৭ জন শিক্ষার্থী। আব্দুল কাদের এরমধ্যে ৩ দশমিক ৭ ভাগ ভোট পেয়েছেন। অন্যদিকে জিএস পদে ২৮ হাজার ৬৮৭ ভোটারের বিপরীতে আবু বাকের মজুমদার ৭ দশমিক ৪৩ ভাগ ভোট পেয়েছেন।

দলটির অভ্যন্তরীণ অনৈক্য, শক্তিশালী সাংগঠনিক ভিত্তি তৈরিতে ব্যর্থ হওয়া, শিক্ষার্থীদের কাছে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা উপস্থিত করতে না পারা, প্রচারণায় ঘাটতি এবং শুধু অনলাইনে অব্যাহত প্রচারণার ফলে শিক্ষার্থীদের কাছে তারা গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পারেননি।

আত্মপ্রকাশের পর প্রথমদিন থেকেই সংগঠনটি বিতর্কের মুখে পড়ে। আত্মপ্রকাশের দিন ‘পদবঞ্চিত’ অভিযোগ এনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থীর সাথে হাতাহাতি হয় নবগঠিত সংগঠনের নেতাদের। এই হাতাহাতি সারা ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়ে।

এরপর থেকে বিভিন্ন কার্যক্রমের সংগঠনের মধ্যে শৃঙ্খলা ও কার্যক্রমে গতিশীলতার অভাবসহ একাধিক দুর্বলতা দেখা যায়। অনেকেই ‘হতাশ’ হয়ে পদত্যাগও করেন। সংগঠনের দুর্বলতা শিক্ষার্থীদের কাছে তাদের অবস্থান ক্ষুণ্ন করে।

সংগঠনের অনেকেই জুলাইয়ে সামনের সারিতে থাকার কারণে শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা ছিল বেশি। তবে সে প্রত্যাশা ধরে রাখতে পারেননি নেতারা। এছাড়া জুলাই অভ্যুত্থানের সামনে থাকা নেতাদের যারা আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন, তাদের দায়ও এই সংগঠনের ওপর এসে পড়ে।

নির্বাচনকালীন অনৈক্যে পথ হারিয়েছে সংগঠনটি

সংগঠনটির মধ্যে চূড়ান্ত অনৈক্য দেখা যায় ডাকসু নির্বাচনের প্যানেল গোছানোর সময়। সংগঠনটির নেতাদের মধ্যে পদক্রমের আনুগত্য দেখা যায়নি। প্রায় পদে বিদ্রোহী প্রার্থী যোগ হলেও তা ঠেকাতে পারেননি নেতারা।

সংগঠনের অনেকেই ধারণা করেছিলেন, জুলাই অভ্যুত্থানে ভূমিকার কারণে শিক্ষার্থীদের সমর্থন পাবেন। ফলে দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে তারা নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন।

কেবল সহ-সাধারণ সম্পাদক পদেই নির্বাচন করেছেন সংগঠনের ৫ নেতা। দলের কেন্দ্রীয় মুখ্য সংগঠক তাহমীদ আল মোদ্দাসসীর চোধুরী, মুখপাত্র আশরেফা খাতুন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখ্য সংগঠক হাসিব আল ইসলাম এবং আরও দুই নেতা সানজানা আফিফা অদিতি এবং আশিকুর রহমান জিম এই পদে নির্বাচন করেছেন। নিজেদের এমন অভ্যন্তরীণ কোন্দল শিক্ষার্থীদের মধ্যে একধরনের নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করেছে।

এজিএস পদে আশরেফা খাতুন ৯০০ ভোট, তাহমীদ আল মোদ্দাসসীর চৌধুরী ৩ হাজার ৮ ভোট, আশিকুর রহমান জিম ৭৯৬ ভোট, হাসিব আল ইসলাম ৫০০ ভোট, সানজানা আফিফা অদিতি ৩৭৩ ভোট পেয়েছেন।

মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন পদে সংগঠন থেকে মনোনয়ন পেয়েছিলেন হাসিব আল ইসলাম। একই পদে আবু সাঈদ এবং আব্দুল্লাহ সালেহীন অয়ন নির্বাচনে অংশ নেন।

এ ছাড়া কেন্দ্রের অন্যান্য সম্পাদকীয় ও সদস্য পদ এবং হলের ভিপিসহ একাধিক পদে সংগঠনটির একাধিক বিদ্রোহী প্রার্থী অংশ নেন। ফলে সংগঠনটির নিজেদের নেতাদের মধ্যেই ভোট ভাগ হয়েছে।

সাংগঠনিক ভিত্তি না থাকা

২০২৪ সালের ১৬ এবং ১৭ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগকে হল থেকে বের করে দেয়। এসময় তারা কয়েকদফা দাবি সংবলিত এক প্রজ্ঞাপন হলের প্রাধ্যক্ষ থেকে অনুমোদন করে নেয়। এরমধ্যে হলে রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি রয়েছে।

শিক্ষার্থীদের এই দাবিকে সামনে রেখে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের নেতাকর্মীরা হল এবং একাডেমিক এলাকায় রাজনৈতিক কার্যক্রম না করার ঘোষণা দেন। ফলে কোনো হলে তারা কমিটি গঠন করেননি।

হলে ছাত্রশিবিরের আগে থেকেই কমিটি সক্রিয় ছিল। ছাত্রদল ২০২৫ সালের ৮ আগস্ট হলে কমিটি ঘোষণা করে। কমিটি না থাকায় হলে তাদের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ে বলেও অনেকে মনে করছেন। এ ছাড়া গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের যেসব নেতা হলে থেকেছেন, তাদের অনেকেই হলে নিবিড়ভাবে সময় দেননি। ফলে হলে তারা ভালো অবস্থান তৈরি করতে পারেননি।

এক্ষেত্রে ছাত্রশিবির নেতারা এগিয়ে ছিলেন। তারা শুরু থেকেই হলে নিবিড়ভাবে সময় দিয়েছেন এবং হলের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে সময় দিয়েছেন। ফলে শিক্ষার্থীদের কাছে তারা বেশি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছেন। ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরি এবং হলে কার্যক্রম পরিচালনার কারণে ছাত্রশিবির হলগুলোতে ‘অভূতপূর্ব’ জয় পেয়েছে।

অন্যদিকে কোনো সাংগঠনিক ভিত্তি না থাকায় গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ এক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিল। নির্বাচনের সময় মাঠ গোছাতে গিয়েও তারা হিমশিম খেয়েছে।

কর্মপরিকল্পনা কী, তা জানেন না শিক্ষার্থীরা

এবারের নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবির নিজেদের কর্মপরিকল্পনা শিক্ষার্থীদের সামনে তুলে ধরতে পেরেছে। অন্যদিকে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ নির্বাচিত হলে কী কী কাজ করবে, তা শিক্ষার্থীদের কাছে স্পষ্ট করতে পারেননি। তারা অধিকাংশ সময় প্রচারণা করতে গিয়ে ‘বিতর্কে’ জড়িয়েছেন।

এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনে একাধিক ফ্যাক্টর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বিশেষ করে প্রথম বর্ষের ভোট, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, নোয়াখালী, খুলনা, বরিশালসহ বিভিন্ন অঞ্চলের ভোট, বিভিন্ন বিভাগকেন্দ্রিক ও জেলা সংগঠন কেন্দ্রিক ভোট এবং নারী ও অনাবাসিক ভোট-এসব ভোট নিজেদের দিকে টানতে কোনো উদ্যোগই নেয়নি এই প্রার্থীরা।

প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও অঞ্চলের ভোট টানার কথা বিবেচনায় নেয়নি সংগঠনটি। ফলে নির্বাচনে তারা গুরুত্বপূর্ণ সকল ফ্যাক্টর হারিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের একাধিক হলে গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের নারী নেত্রীরা ভালো করলেও তাদের ভোটগুলোও কেন্দ্রে টানতে পারেননি কাদের-বাকের।

গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখপাত্র রাফিয়া রেহনুমা হৃদি বাংলাদেশ কুয়েত-মৈত্রী হলের ভিপি পদে ৭৭১ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। কিন্তু এই হলে আব্দুল কাদের মাত্র ৪৭ ভোট এবং আবু বাকের মজুমদার ৬৪ ভোট পেয়েছেন।

শামসুন নাহার হলে জিএস পদে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের সামিয়া মাসুদ মম ১৫৯০ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। এই হলে আব্দুল কাদের মাত্র ৫৯ ভোট এবং আবু বাকের মজুমদার ১২৪ ভোট পেয়েছেন। অন্যান্য হলের চিত্রও একই।

দুশ্চিন্তায় এনসিপি

জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি একাধিকবার গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের সাথে তাদের সম্পর্ক এড়িয়ে গেলেও দলটি এই ছাত্র সংগঠন নিয়ে গভীরভাবে ভাবছে। গুঞ্জন রয়েছে, লেজুড়বৃত্তির বিষয়টি সরিয়ে এটি জাতীয় নাগরিক পার্টির একটি ছাত্র সংগঠন হিসেবে ক্যাম্পাসে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে। এনসিপির অভ্যন্তরীণ বৈঠকে ছাত্রসংগঠনটির পরাজয়ের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।

গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ ডাকসু নির্বাচনের শীর্ষ পদে জয়ী হলে জাতীয় নাগরিক পার্টির ভাবমূর্তি চাঙ্গা হতো। তবে তা হয়নি।

সংগঠনটির সংস্কারের কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের কেন্দ্রীয় সদস্য সচিব জাহিদ আহসান।

বাংলানিউজকে তিনি বলেন, আমরা সংগঠনের সংস্কার নিয়ে কাজ করছি। নতুন করে কমিটি রিফর্মের বিষয়ে আলোচনা চলছে।

সামনে নতুন কোনো চিন্তা নিয়ে আসার পরিকল্পনা আছে কি না, জানতে চাইলে জাহিদ আহসান বলেন, আমরা এখনো আলোচনা করছি। কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

এফএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।