ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জলবায়ু ও পরিবেশ

বন মাতানো দাগি-বসন্তের ব্যতিক্রমী প্রণয়বার্তা

বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন, ডিভিশনাল সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭০৯ ঘণ্টা, জুন ২৭, ২০২০
বন মাতানো দাগি-বসন্তের ব্যতিক্রমী প্রণয়বার্তা

মৌলভীবাজার: পাহাড়ি বন মুখর করে রাখে সে। কেবল ডাকে আর ডাকে। বিরামহীন সেই ডাক। প্রেয়সীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ক্লান্তহীন আহ্বান তার। মেয়ে পাখিটির প্রজননপ্রণয়ে বাঁধা না পড়া পর্যন্ত কিছুতেই থামে না ছেলেপাখির ডাক। সুমিষ্ট স্বরে বনান্তর মাতিয়ে রাখা এ পাখিটির নাম ‘দাগি-বসন্ত’। 

বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রখ্যাত পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হক পাখিটি সম্পর্কে বাংলানিউজকে বলেন, এ পাখির ইংরেজি নাম Lineated Barbet এবং আমরা বাংলাদেশে একে ‘দাগি-বসন্ত’ বলি। ২৮ সেন্টিমিটারের এ পাখি আমাদের প্রতিটি পাহাড়ি বনেই রয়েছে।

সে পুরোপুরি বনের পাখি। মাঝে মাঝে হয়তো বনের বাইরে বট বা পাকুড়গাছে হঠাৎ এসে পড়ে; তবে খুবই কম। এর মাথা ও বুক হালকা খয়েরি রঙের। বুকের মাঝে লম্বা লম্বা সাদা দাগের জন্যই ‘দাগি’ বলা হয়। এজন্য ওর নামকরণ দাগি-বসন্ত।
 
‘পাখিটি কিন্তু সহজ নয় দেখা, যদিও বড় পাখি। কারণ ওর রংটা গাছের পাতার সঙ্গে একেবারে মিশে যায়। ওর মাথা ও বুক শুধু হালকা খয়েরি। ওটাও চোখে পড়ার মতো রং নয়। আপনি যে কোনো পাহাড়ি বনে ঢোকার আগে এই দাগি-বসন্তের উপস্থিতির কথা সহজেই জানতে পারবেন। কারণ সে খুবই চিৎকার করে ডাকে। উঁচু গলা; তবে তীক্ষ্ম-কর্ষক নয়; বেশ মিষ্টি: ‘পুকুক-পুকুক-পুকুক’ -এ রকম করে ডাকতেই থাকে। বিশেষ করে এই প্রজননের সময় অনেক ডাকে; ফলে বন একেবারে সোরগোল করে মাতিয়ে রাখে এই একটি প্রজাতির পাখি। এই ডাকটা এক মাইল দূর থেকে পর্যন্ত শোনা যায়। এত জোরে ডাকা পাখি বাংলাদেশে খু্বই কম আছে। ’
 
পাহাড়ি বনের উপকারী পাখি ‘দাগি-বসন্ত’।  ছবি: ইনাম আল হক‘দাগি-বসন্ত বুনো ফল খাওয়া পাখি। ফলে ও সব রকম ফলের গাছে যেমন বট, পাকুড়, ডুমুর প্রভৃতি গাছে সব সময় ওকে দেখতে পাবেন। তবে আমাদের শহরের বট-পাকুড়ে গাছে ও আসবে না। পাহাড়ি বন ও বন সংলগ্ন বট-পাকুড়ে গাছে তাকে দেখা যাবে। ও এই ফল খায় বলে আমাদের প্রতিবেশ ব্যবস্থার বড় একটি উপকার করে। ও ফল খেয়ে যে মল ত্যাগ করে সেই মল থেকে প্রাকৃতিকভাবে সব গাছ হয়। পাখির পেটের ভিতর দিয়ে যে বীজগুলো কিছুটা আধাসিদ্ধ হয়ে যায়; এই আধাসিদ্ধ হলেই কিন্তু বট-পাকুড়ে গাছের বীজগুলো যেখানে পড়ে সেখান থেকেই চারা গজায়; নইলে গজায় না। এ জন্যই দাগি-বসন্ত বন সম্প্রসারণকারী একটি উপকারী পাখি। ’  
 
বুনো ফল খেয়েই বনের সম্প্রসারণ করে ‘দাগি-বসন্ত’।  ছবি: ইনাম আল হকদাগি-বসন্তের ব্যতিক্রমী প্রণয়ের দিক উল্লেখ করে এ পাখি-গবেষক বলেন, বনের গাছের উপরই নির্ভর করে তার জীবন। গাছের ফল যদি না থাকে; তাহলে সে বাঁচবে না। কারণ বুনো ফল ছাড়া সে কিছুই খায় না। আর সে বাসাও করে গাছের কোটরে। প্রতি বছর সে নতুন করে একটা কোটর বানায়। পুরনো কোটরে সে বাসা করে না। কারণ কোটর বানানোর যে প্রক্রিয়া এটাই হলো ছেলে এবং মেয়ে দাগি-বসন্তে প্রণয়ের একটা অঙ্গ।  

‘তার মানে ও যদি নতুন কোটর না বানায় তাহলে মেয়ে দাগি-বসন্ত পাখিটি ছেলেটির প্রতি আকর্ষণ তৈরি হবে না। ওর হরমোন রিলিজ (নির্গমন) হবে না, ডিম তৈরি হবে না। গাছের কোটর বানানোটা প্রথমে শুরু করে ছেলে দাগি-বসন্ত। পরে মেয়ে দাগি-বসন্ত এসেও যোগ দেয়। এটা আমন্ত্রণের মতো ব্যাপার একটা। কোটর তৈরির ৯০ শতাংশ কাজ পুরুষ দাগিবসন্তকেই করতে হয়। ’
 
‘অন্য পাখিদেরও উপকার করে’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, অনেক পাখি আছে যারা কোটরে বাসা করে; কোটর বানাতে পারে না। ফলে দাগি-বসন্তের ছানাগুলো বড় হয়ে বেরিয়ে চলে গেলেই সে কোটরে শালিক (Myna/Starling) এবং দোয়েল (Oriental Magpie Robin) ওরা ওখানে বাসা করে। ফলে দাগি-বসন্ত পাখিগুলো এভাবে আমাদের প্রকৃতির অন্য পাখিদের অনেক বেশি উপকার করে বলে জানান প্রখ্যাত পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হক।
 
বাংলাদেশ সময়: ৭০০৯ ঘণ্টা,  জুন ২৭, ২০২০
বিবিবি/এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।