ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জলবায়ু ও পরিবেশ

রুক্ষ বরেন্দ্রে অবিশ্বাস্য হারে নামছে পানির স্তর

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০২৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০২১
রুক্ষ বরেন্দ্রে অবিশ্বাস্য হারে নামছে পানির স্তর

রাজশাহী: রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১২৪টি উপজেলা নিয়ে বরেন্দ্র অঞ্চল। জলবায়ু পরিবর্তন, প্রকৃতির বিরূপ প্রভাব ও ব্যাপক হারে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন করায় এ অঞ্চলে অবিশ্বাস্য হারে নামছে পানির স্তর।

ভূগর্ভস্থ পানির স্তর রেকর্ড পরিমাণে ১৫০ ফুট নিচে নেমে যাওয়ায় এরই মধ্যে অকেজো হয়ে পড়েছে বেশির ভাগ হস্তচালিত নলকূপ। গভীর নলকুপগুলোতে ঠিকমতো পানি উঠছে না!

এর ফলে বৈশাখের এই তীব্র খরতাপে বিভিন্ন এলাকায় দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ খাবার পানির তীব্র সংকট। পানির স্তর নিচে নামতে থাকায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছে গবেষণা সংস্থা ডাসকো ফাউন্ডেশন।

সমন্বিত পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের আওতায় তানোরের মুণ্ডুমালা পৌরভবনের পাশেই ২০১৬ সালে তারা একটা পানি মাপার কূপ তৈরি করেছিলেন। কূপ বসানোর সময় সেখানে পানির স্তর ছিল ১০০ ফুট নিচে। কূপের ভেতর একটা ডিভাইস পাঠিয়ে গভীরতা পরিমাপ করা হতো।

ডিভাইসটি নিচে গিয়ে পানি স্পর্শ করলেই উপরে ডিভাইসের বেল বাজত। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে মাটির ১৫০ ফুট নিচে গিয়েও আর ডিভাইসের বেল বাজছে না।

অর্থাৎ ডিভাইসটি পানি পাচ্ছে না। শুধু উপজেলা নয় রাজশাহীর তানোর, গোদাগাড়ী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল, গোমস্তাপুর, নওগাঁর পোরশা, সাপাহার, নিয়ামতপুর ও পত্নীতলা উপজেলাসহ পুরো বরেন্দ্র অঞ্চলে এভাবেই কমছে পানির স্তর।  

ডাসকো’র কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম জানান, এক যুগ আগেও এসব অঞ্চলে ৬০ থেকে ৭০ ফুট গভীরে পানি পাওয়া যেত। বর্তমানে কোথাও কোথাও ১৫০ ফুট বা তারও নিচেও পানি পাওয়া যাচ্ছে না।

গবেষকরা বলছেন, কৃষি কাজের জন্য বরেন্দ্র এলাকায় অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি তোলার কারণে পানির স্তর প্রতিবছর গড়ে দুই থেকে তিন ফুট নেমে যাচ্ছে। ১৯৮০ সালেও বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির স্তর মাটির মাত্র ৩৯ ফুট নিচে ছিল। ২০১৬ সালে ১১৮ ফুট নিচে নেমে গেছে। ১০০ থেকে ১৫০ ফুট নিচে পাতলা একটা পানির স্তর পাওয়া যাচ্ছে।
দেশের গড় বৃষ্টিপাত ২ হাজার ৫০০ মিলিমিটার হলেও এ বরেন্দ্র অঞ্চলে গড় বৃষ্টিপাত মাত্র ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ মিলিমিটার। বৃষ্টিপাতে ভূগর্ভস্থ পানির গড় পুনর্ভরণের হার দেশে ২৫ শতাংশ হলেও এ অঞ্চলে মাত্র ৮ শতাংশ। বরেন্দ্র অঞ্চলের উঁচু এলাকাগুলোতে পানির সংকট ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল ও গোমস্তাপুর; রাজশাহীর তনোর ও গোদাগাড়ী; এবং নওগাঁর পোরশা, সাপাহার এবং নিয়ামতপুর সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কমপক্ষে ৪৭ মিটার উঁচু। বরেন্দ্র অঞ্চলে সবচেয়ে উঁচু গোমস্তাপুরের পার্বতীপুর ইউনিয়ন। এসব এলাকায় এখন পানির জন্য হাহাকার চলছে।

বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) কর্মকর্তারা জানান, গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে এই অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর মাত্র ৩০ ফুট নিচে ছিল যখন কৃষকরা সেচের জন্য শুধু নদী-খাল-বিল, হ্যান্ড টিউবওয়েল ও বৃষ্টির পানি ব্যবহার করতেন। পানির স্তর নিচে নামতে শুরু করলে ১৯৮৫ সাল থেকে বিএমডিএ বরেন্দ্র অঞ্চলে গভীর নলকূপ বসাতে শুরু করে। সমগ্র বরেন্দ্র এলাকায় এখন ১৫ হাজার ১০০টি গভীর নলকূপ আছে।

২০১২ সালের দিকে সরকার কৃষিকাজের জন্য আর ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারপর থেকে বিএমডিএ নতুন করে আর নলকূপ বসাচ্ছে না। ভূ-উপরস্থ পানির আধার সৃষ্টি করতে বিএমডিএ বরেন্দ্র অঞ্চলে অনেক খাল ও খাড়ি সংস্কার এবং খনন করলেও তা কাজে আসছে না। ফলে কৃষকদের ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। তাই ব্যক্তিমালিকানায়ও গভীর নলকূপ বসানো হচ্ছে।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য মতে, বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম ধান উৎপাদনকারী দেশ বাংলাদেশে সেচের জন্য যে পানি ব্যবহার হয় তার ৭৫ শতাংশই মাটির নিচ থেকে তোলা। এক কেজি বোরো ধান উৎপাদন করতে প্রায় তিন হাজার লিটার পানির প্রয়োজন হয়। গম ও ভুট্টায় প্রতি কেজি উৎপাদনে প্রায় ৪০০-৬০০ লিটার পানির প্রয়োজন হয়। এক বিঘা বোরো ধান চাষে প্রয়োজন হচ্ছে ২৪ লাখ লিটার পানি। বার্ষিক ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের পরিমাণ ১৩ হাজার ৭১০ মিলিয়ন ঘনমিটার।

সম্প্রতি বিএমডিএ’র এক হিসাব অনুসারে, বরেন্দ্র অঞ্চলের বার্ষিক ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের পরিমাণ ১৩,৭১০ মিলিয়ন ঘনমিটার যার প্রায় ৭০ শতাংশই বেসরকারি গভীর নলকূপ দিয়ে উত্তোলিত হচ্ছে। প্রকৌশলীদের হিসাব অনুযায়ী, এই পরিমাণ পানি এক বিঘা আয়তনের দুই মিটার গভীরতা বিশিষ্ট ১৮ লাখ পুকুর ভরে ফেলার জন্য যথেষ্ট।

রাজশাহী তানোর উপজেলার বাসিন্দারা বলছেন, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় হাজার হাজার হস্তচালিত নলকূপ বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক জায়গায় গভীর নলকূপেও পানি উঠছে না। অনেকেই দূর-দূরান্ত থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে। পানির জন্য এলাকায় সংঘাতও হয়। এই অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে কৃষি জমিতে সেচ ও খাওয়ার পানির ব্যাপক সংকট আরো বাড়বে।

তানোরের মুণ্ডুমালা এলাকার রহমত উল্লাহ বাংলানিউজকে বলেন, আমি ১৪৩ ফুট গভীরে পাইপ ঢুকিয়ে পানি পেয়েছি। সাবমার্সিবল পাম্প দিয়ে পানি তোলা হচ্ছে। অনেকে তিন-চারবার পাইপ পুঁতেও পানি পায় না।

বাঁধাইড় ইউনিয়নের একান্নপুর গ্রামের আলী আসগর বলেন, ৬০ বিঘার আমবাগানে সেচের ব্যবস্থা করতে ৯ স্থানে পাইপ পুঁতেও নিজের জমিতে পানি পাইনি। শেষে কিছুটা দূরে একটি জমিতে পাইপ পুঁতে পানি পেয়েছি। সাবমার্সিবল পাম্পের সাহায্যে পানি তুলে পাইপের মাধ্যমে বাগানে নিয়ে যাই।

একই গ্রামের আরেক কৃষক হারুনুর রশিদ বলেন, বছর দশেক আগেও কুয়া ও টিউবওয়েলের পানি দিয়ে মানুষ দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতেন। পানির স্তর নেমে যাওয়ায় এখন কূপ ও টিউবওয়েলে পানি নেই। পানির জন্য হাহাকার পড়ে যাচ্ছে এলাকায় এলাকায়। খরা মৌসুমে এ সংকট আরও চরম হচ্ছে।

পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় কয়েকবছর আগে সল্লাপাড়া গ্রামের সবকটি হাতে চাপা টিউবওয়েল অকেজো হয়ে পড়েছে। দুই বছর আগে গ্রামের সবাই টাকা তুলে একটি সাবমার্সিবল পাম্প বসিয়েছেন। সেই পাম্পের সাহায্যে সবার বাড়ি বাড়ি পাইপের সাহায্যে পানি পৌঁছে দেওয়া হয়।  

এ গ্রামের কৃষক রফিকুল ইসলাম বলেন, সাবমার্সিবল পাম্প চালাতে প্রত্যেক পরিবারকে প্রতিমাসে চাঁদা দিতে হয়। বাড়িগুলো থেকে মাথাপিছু পানির টাকা দিতে হয়। কোনও সমস্যা হলে নিজেরাই মেরামত করি।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. চৌধুরী সারওয়ার জাহান ২০১৪ সাল থেকে বরেন্দ্রে অঞ্চলের ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি সরকারের পানি বিষয়ক টাস্কফোর্সের সদস্য হিসেবে দায়িত্বপালন করছেন।  

তিনি তিনি বাংলানিউজকে বলেন, দিন দিন পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে, কারণ ভূগর্ভস্থ পানিতে সব মানুষের অধিকার থাকলেও অল্প কিছু লোক তা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে তুলে নিচ্ছে। ধান চাষের জন্য কেবল ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার এই উঁচু ও শুকনো অঞ্চলে পানীয় জল দুষ্প্রাপ্য করে তুলতে পারে।

তিনি আরও বলেন, বরেন্দ্র অঞ্চলকে বাঁচাতে হলে পানির কোনও বিকল্প না। কারণ পানির স্তর নিচে নেমে গেলে নিচে বালু, পাথর ফাঁকা হয়ে পড়বে। তখন সামান্য ভূমিকম্প হলেই দেবে যেতে পারে বিশাল এলাকা। ভূ-গর্ভস্থ পানি সেচ কাজে ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। বৃষ্টির পানি বেশি বেশি রিচার্জ করতে হবে। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে পুকুর-খাড়ি বেশি করে খনন করতে হবে। বাসা বাড়ির ছাদের পানি মাটির নিচে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থাকে এগিয়ে আসতে হবে।

বরেন্দ্র অঞ্চলের রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁয় সরকারের পানি সম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা (ওয়ারপো) কাজ শুরু করতে যাচ্ছে। ‘অপারেশনালাইজিং ইন্টিগ্রেটেড ওয়াটার রিসোর্সেস ম্যানেজমেন্ট’ শীর্ষক একটি প্রকল্প নিয়ে কাজ করবে ওয়ারপো। প্রকল্পের কাজ শুরু করতে গত ১৯ মার্চ ওয়ারপো রাজশাহীতে তাঁদের একটি অফিস চালু করেছে। এছাড়া রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার সরদহ ইউনিয়নে একটি পানি মডেলিং প্রকল্প চালু করা হয়েছে। ২০২৩ সালের জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।

ওয়ারপো’র মহাপরিচালক দেলোয়ার হোসেন জানান, এই প্রকল্পের আওতায় ওয়ারপো ভূগর্ভস্থ ও ভূউপরিস্থ পানিসম্পদের মানচিত্র তৈরি করবে, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে পানির প্রাপ্যতা এবং পর্যাপ্ততা পরিমাপ করবে এবং এগুলো সুরক্ষিত করবে। এটি ব্যক্তিগত, কৃষি ও শিল্প খাতে পানির চাহিদা নির্ধারণ করবে এবং ভূগর্ভস্থ পানির নিরাপদ উত্তোলন সীমা চিহ্নিত করবে এবং এইভাবে পানির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করবে।

বাংলাদেশ সময়: ১০২৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০২১
এসএস/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।