কলকাতা থেকে: কলকাতার আজকের দিনটা কেমন বিষাদে ভরা। বিশ্বকাপের শেষ দশে চার ম্যাচের চারটিতেই হেরে আসর থেকে বিদায় নিয়েছে বাংলাদেশ।
কষ্টটা অবশ্য শুরু হয়েছে গেল ২৩ মার্চ রাত থেকেই। সেদিন সন্ধ্যায় বেঙ্গালুরুর চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে স্বাগতিক ভারতের বিপক্ষে মাত্র ১ রানের অপ্রত্যাশিত হার মাঠে বসে চাক্ষুস করতে হরো। অফিসে নিউজ পাঠিয়ে মধ্যরাতে যখন হোটেল কক্ষে ফিরলাম, তখন থেকেই কেবল মনে হচ্ছিলো- কী যেন নেই! অনেক আপন, অনেক কাছের কেউ হারিয়ে গেলে যেমন হৃদয়ে বেদনার সুর বাজে, ঠিক তেমনই একটি অনুভুতি।
এমন ব্যথাতুর অনুভুতি নিয়ে ২৪ মার্চ সকাল ১১টায় বেঙ্গালুরু থেকে আমরা রওনা হয়েছি কলকাতার উদ্দেশ্যে। তার আগে সকাল ৯টায় চার্চস্ট্রিটের হোটেল থেকে জশোয়ান্তপুর রেলস্টেশনে আসতে ট্যাক্সিচালক আমাদের বলছিলেন, ‘তোমাদের দল মাত্র একটি রান করতে পারলো না!’ ঠিক ওই মুহূর্তে তার সে প্রশ্নের কোনো উত্তর আমাদের জানা ছিল না।
আধাঘণ্টা বাদে দুরন্ত এক্সপ্রেস রওনা হলো হাওড়ার উদ্দেশ্যে। লম্বা হুঁইসেলের পর ট্রেনটি যখন হেলেদুলে শহরতলী ছাড়িয়ে যাচ্ছিলো, তখন রেললাইনের দু’পাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা লাল রঙের পাথুরে অদ্ভুত সুন্দর পাহাড়গুলোকে কেমন অসুন্দর লাগছিল। কেবলই মনে হচ্ছিলো, পাহাড়গুলো আমাদের দেখে কেমন তাচ্ছিল্যের অট্টহাসিতে কাঁপিয়ে তুলছে পুরো ভারতবর্ষ।
সামনে এলো দক্ষিণ ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ অঞ্চলের বিস্তীর্ণ সবুজ ফসলের মাঠ। আশ্চর্যের বিষয়, অপরূপ মাঠগুলোও কেমন বিবর্ণ মনে হচ্ছিল। আমাদের দেখে দেখে কেমন মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছিলো ওরা। যেন ভারতের বিপক্ষে ৩ বলে ২ রান না নিতে পারায় বাংলাদেশ ভীষণ অন্যায় করে ফেলেছে। কপিল দেব, শচীন টেন্ডুলকার আর সৌরভ গাঙ্গুলির দেশ তাই যেন ভীষণভাবে হেয় করে দেখছে।
কী অদ্ভুত! ১৯ মার্চ কলকাতা থেকে বেঙ্গালুরু যাবার পথে যখন এই সবুজ মাঠ ও পাহাড়গুলোই আমাদের সমীহ করছিলো, অভ্যর্থনা জানাচ্ছিলো।
ট্রেনের ভেতর এক ভারতীয় যুবক হঠাৎ প্রশ্ন ছুড়ে দিল, ‘তোমরা এমন কেন খেললে বলো তো? দুইটা রান নিলে জিততে, সেটা না পারো একটা রান তো নিতে পারতে! তাহলেও তো খেলাটি টাই হতো। আসলে বুঝলে সবই টেকনিক। আমাদের ধোনির কাছে তোমাদের মাশরাফি মাইন্ড গেমে হেরে গেছে, তাই তোমরা জিততে পারো নি।
যুবকের মন্তব্য আমার কাছে শতভাগ সত্যি মনে হয়নি। তাই জবাবে বললাম, এটাই ক্রিকেটের সৌন্দর্য। সেট ব্যাটসম্যান উইকেটে থাকা সত্ত্বেও তিন বলে দুই রান হবে না, আবার টেল এন্ডাররা এক বলে ছয় মেরে ম্যাচ জিতিয়ে দিবেন। এজন্যই খেলাটার নাম ক্রিকেট। যেখানে নিশ্চয়তা বলে কিছু নেই।
প্রায় ৩২ ঘণ্টার ভ্রমন শেষে আমরা ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় এসে হাওড়া নামলাম। ট্যাক্সি নিয়ে আবার কলকাতার সেই গ্র্যান্ড স্ট্রিটের হোটেল। দীর্ঘ্যযাত্রার ক্লান্তিতে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম থেকে যখন উঠেছি তখন ২৬ মার্চ সকাল ৯টা। বিকেল ৩টায় ম্যাচ, তাই একটু হোমওয়ার্ক করতে বসে পড়লাম।
ঘণ্টা দু’এক হোমওর্য়্ক শেষে চলে গেলাম ইডেন গার্ডেনে। দুপুর ১টা নাগাদ সেখানকার প্রেসবক্সে আমি যখন প্রবেশ করেছি, তখন সাংবাদিকদের সংখ্যা খুবই কম ছিল। বাংলাদেশের মাত্র একজন আর ভারতীয় চারজন। ইডেন গার্ডেনে তখন নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচ শুরুর আগে টাইগারদের শেষ সময়ের অনুশীলন চলছে। তাই দেখে ভারতীয় সাংবাদিকরা বলছিল, ‘আরে ওরা শুধু শুধু প্র্যাকটিস করছে কেন? ওদের প্লেনের টিকিট ধরিয়ে দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দে। আরে, প্লেন না বাসে ছয়শ টাকা লাগে, বাসের টিকিট কেটে দে, নইলে শিয়ালদা থেকে ট্রেন ধরিয়ে দে, ব্যাস চলে যাবে। ’
গেল দু’দিনের ধারাবাহিকতায় ইডেন গার্ডেনের প্রেসবক্সে বাংলাদেশকে লক্ষ্য করে এমন দুয়োধ্বনি শুনে কেবলই মন বলছিলো, বাংলাদেশ যদি আজকের এই ম্যাচটি জিততে পারতো!
দু’চোখে এমন স্বপ্ন নিয়ই ম্যাচ দেখা শুরু করলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আবার বাংলাদেশের একটি হার এবং যথারীতি হারের গল্প লেখা।
বাংলাদেশ সময়: ০২০২ ঘণ্টা, ২৮ মার্চ, ২০১৬
আরএইচ