বাংলাদেশের ভাবমূর্তির সবচে বড় আয়না এখন ক্রিকেট। ২০১৫-র অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড ওয়ান-ডে বিশ্বকাপ থেকে হঠাৎই ‘ক্রিকেটিং মিনোস’ বা ‘পুচকেদের দল’ নামের তকমাটি চিরতরে ঝেড়ে ফেলেছে টিম টাইগার্স।
মাঝপথেই বাড়া ভাতে ছাই দিল আইসিসি। নেপথ্য কুশীলব শঠকুলশিরোমণি শ্রী নিবাসন। তার নোংরা তর্জনীনির্দেশে পক্ষপাতদুষ্ট আম্পায়ারিং, বাংলাদেশকে রিভিউয়ের সুযোগবঞ্চিত রাখা, ভারততোষণ, সভাপতি হিসেবে আ হ ম মোস্তফা কামালকে পুরস্কার বিতরণ করতে না দেওয়া। ষড়যন্ত্রের মাকড়জালে বাংলাদেশকে বেঁধে ফেলবার কতো যে তোড়জোর!
ঘটনাবহুল আর বড় অর্জনের সেই ওয়ানডে বিশ্বকাপ মিশন শেষে দেশের মাটিতে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টিতে পাকিস্তান, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে নাস্তানাবুদ করে রচিত হলো এক নব রূপকথা! টি-টোয়েন্টির এশিয়াকাপেও অদম্য জয়ের রথ। সব দলকে হারিয়ে হটিয়ে ভারতের সঙ্গে সমানে-সমানে লড়ে রানার্স আপ। আর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে আইসিসির নানা কাঁটা বিছানোর পরও ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার আত্মা কাঁপিয়ে অল্প ব্যবধানে পরাজয়।
শুরু থেকে শেষ অব্দি হ্যাং-ম্যানের ভূমিকায় ছিল এবার আইসিসি। শুরুটা তাসকিন আর সানির ডানা ছেঁটে, আর শেষটা স্লো ওভার-রেটের ধুয়া তুলে বাংলাদেশ দলকে জরিমানা করে, খেলোয়াড়দের ম্যাচ-ফি কেটে রেখে। অথচ জরিমানা করলে করার কথা ভারতকেই। বাংলাদেশ ফিল্ডিংয়ে সময় নিয়েছে ১০৪ মিনিট, ভারত নিয়েছে ১০৬ মিনিট। ভারতে এক সংবাদ সম্মেলনে বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের কণ্ঠেও তাই ক্ষোভ: “আমাদের এই বিরুদ্ধ পরিবেশেই খেলতে হবে। ’’ হ্যাঁ, এই হচ্ছে বাস্তবতা!
নিজেদের নেতিবাচকতাও কিন্তু কুঁরে খাচ্ছে আমাদের। প্রশ্ন উঠেছে বিশ্বকাপে খেলোয়াড় নির্বাচন নিয়ে। যোগ্যকে বঞ্চিত রেখে অপরীক্ষিতকে দিয়ে খেলানো। কর্তাদের স্বৈরতন্ত্রী আচরণ, অনির্ভরযোগ্য শুভাগত হো্ম আর মিঠুন আলীর টানা ব্যর্থতার পরও অলরাউন্ডার নাসিরকে বসিয়ে রাখা। ডার্করুমের পর্দা ভেদ করে এসব চলে এসেছে প্রকাশ্যে। এসবের মাসুল দিতে হয়েছে ভারতের সঙ্গে প্রায়-জিতে-যাওয়া ম্যাচ অবিশ্বাস্যভাবে হেরে।
এছাড়া মাশরাফির ক্যাপ্টেন থাকার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে কিছু মিডিয়ার জলঘোলা করা রিপোর্টিং তো আছেই। এসবই এখন জুতোর পেরেকের মতো খোঁচাচ্ছে পুরো দলকে।
গতস্য শোচনা নাস্তি! এখন এসব নিয়ে পড়ে থাকবার সময় নয়। এখনই তিন ধরনের ক্রিকেটের উন্নয়নে নেমে পড়াটা জরুরি। ক্রিকেট প্রশাসনকে ঢেলে সাজানো। ব্যবস্থাপনার মানোন্নয়ন। সবোর্পরি বিশ্বমানের ক্রিকেট অবকাঠামো গড়ে তোলা। ক্রিকেটকে যাবতীয় ব্যক্তিপ্রভাব ও স্বৈরতন্ত্রের বাইরে রাখাও জরুরি। অ্যামেচারিজমের জায়গায় চাই পেশাদারিত্ব। অ্যামেচারিজম হটিয়ে ১০০ ভাগ পেশাদারিত্ব চালুর কাজটা অনেক আগেই করেছে ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ড।
ওয়ানডে ফরম্যাট বাদ দিলে টেস্ট ও টি-টোয়েন্টিতে টাইগারবাহিনি এখনও ধুঁকছে। টি-টোয়েন্টিতে নজরকাড়া উন্নতি করলেও টেস্ট ফরম্যাটে আমরা এখনও হাঁটি-হাঁটি পা-পা।
আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেট অবকাঠামো বড়ই দুর্বল। আছে ক্রনিক অব্যবস্থাপনা, প্রকট অপেশাদারিত্ব ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাব। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট নিয়েই সব দৌড়ঝাঁপ; সে তুলনায় ঘরোয়া ক্রিকেট যেন হেলাফেলার সতীনপুত্র! অথচ ঘরোয়া ক্রিকেটই হচ্ছে পায়ের তলার মাটি।
উন্নতির পূর্বশর্ত ঘরোয়া ক্রিকেটের উন্নতি। টেস্ট ফরম্যাটে ভালো করার পূর্বশর্ত ঘরোয়া লীগে তিন/ চার বা পাঁচদিনের লংগার ভার্সন চালু করা। টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের লীগও চালু করা চাই। অনূর্ধ্ব ১৯ দলের প্রতিশ্রুতিশীল মেধাবীদের মূল দলে তুলে আনা যেতে পারে। ভিন্ন ভিন্ন ফরম্যাটে এক ঝাঁক স্পেশালিস্ট ক্রিকেটার তৈরির কথাও ভাবা দরকার। ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ড এদিকটায় ঢের এগিয়ে। ভবিষ্যতে এদের সঙ্গে সমানতালে যুঝতে হলে, ওদের ক্রিকেট বুঝতে হবে।
বিভাগ ও জেলা পর্যায়ের অবকাঠামোগত সুবিধা আরো বিস্তৃত করা প্রয়োজন। নিখরচায় ব্যাট, বল, পোশাক ও উপকরণ প্রাপ্তির সুযোগও নিশ্চিত করতে হবে। স্কুলক্রিকেট কার্যক্রমকেও জোরেসোরে চালু করতে হবে। সেইসঙ্গে সারাদেশে চাই নিবিড়, নিরবচ্ছিন্ন উন্নত প্রশিক্ষণ।
আরো বেশি-বেশি ট্যালেন্ট হান্ট কার্যক্রম চালু করাটাও সময়ের দাবি। বিকেএসপির মতো একাধিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, জিমন্যাসিয়াম গড়ে তোলা, স্পোর্টস মেডিসিনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা, ফিজিও নিয়োগ ইত্যাদির মতো ক্রিকেট মাঠের সংখ্যা বাড়ানোসহ কতো কাজ যে এখনো বাকি!
বোলারদের অ্যাকশন ত্রটিমুক্ত রাখার কাজটাও এখন অবশ্যকর্তব্য। বোলিং অ্যাকশনের নিয়মিত পরীক্ষার ব্যবস্থা চালু না করলে আইসিসির ফাঁদে বারবার আটকা পড়তে হবে। অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের মতো নিজস্ব একটা বায়ো মেকানিক্যাল ল্যাব আশু গড়ে তোলঅ দরকার। অর্থের সমস্যা আর যেখানেই থাক বা না থাক, ক্রিকেটে অন্তত নেই! অভাব কেবল পেশাদারিত্বের আর দীর্ঘমেয়াদি রোডম্যাপের। এখন অব্দি ক্রিকেট যেভাবে চলছে তার পুরোটাই স্বল্পমেয়াদি আর ‘দো-দিনকা মামলা’। এভাবে বেশিদূর এগোনো যাবে না।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ক্রিকেট কেবল মাঠে নয়, অন্যত্রও খেলতে হয়। সেজন্য জোরালো ক্রিকেট ডিপ্লোম্যাসির বিকল্প নেই। এদিকটায় আমরা বরাবরই পিছিয়ে। এজন্য আলাদা বিশেষজ্ঞ প্যানেল গড়ে তোলার কথা ভাবতে হবে আমাদের। এসব নিরঙ্কুশ পেশাদারিত্বের সঙ্গে করা গেলে অচিরকালেই বাংলাদেশের ক্রিকেট উঠে যাবে নতুন উচ্চতায়। এখন কেবল নিজেদের ছাড়িয়ে যাবার লড়াই।
বাংলাদেশ সময়: ১২৪৮ ঘণ্টা, মার্চ ২৯, ২০১৬
জেএম/