ঢাকা, রবিবার, ২১ আশ্বিন ১৪৩১, ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ০২ রবিউস সানি ১৪৪৬

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

আমি এখনও ভাত খেতে পারি না: রাফি

মিনহাজুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২১৯ ঘণ্টা, আগস্ট ২৯, ২০২৪
আমি এখনও ভাত খেতে পারি না: রাফি ...

চট্টগ্রাম: ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনের অবসান হয়েছে। গণ-অভ্যুত্থান শুরু হয়েছিল কোটা সংস্কারের দাবিকে কেন্দ্র করে।

এই আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সমন্বয়ক ও চবি’র সমন্বয়ক খান তালাত মাহমুদ রাফি।

তিনি নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলার মো. তরিকুল ইসলাম চন্দনের ছেলে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের ২০২২-২০২৩ সেশনের শিক্ষার্থী।

কথা বলেছেন বাংলানিউজের সঙ্গে চট্টগ্রামে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে।  

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে কিভাবে যুক্ত হলেন?

রাফি: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে চট্টগ্রামে প্রথম দিকে কোন ধরনের সাড়া পাচ্ছিলাম না। আন্দোলনের শুরুর দিকে একদিন রাত একটার দিকে হল থেকে বের হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের জিরো পয়েন্টে যাই। সেখানে একটি ট্রাক পেয়েছিলাম, সেটাতে উঠে হাটহাজারী গেলাম। তখন রাত দেড়টা। সেখান থেকে একটি সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় গেইটে আসি। তখন পকেটে ২০ টাকা ছিল, সেটাই ভাড়া হিসেবে দিয়েছিলাম। বিকাশে ৫শ টাকা ছিল। আরেকটা ট্রাক দেখি, হাত তুলে থামিয়ে বিস্তারিত বলার পর নগরের দামপাড়া পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারবে বলে চালক জানায়। ট্রাকে চড়ে নগরের দামপাড়া এসেছিলাম। বাস ভাড়া না থাকায় ট্রেনে ঢাকা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। অটোরিকশায় টাইগারপাস ঘুরে রেল স্টেশন। সমবয়সী চালক ভাড়া নেয়নি। সকালের ট্রেনে ঢাকা চলে গেলাম।

ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রামে আন্দোলন কর্মসূচি কিভাবে সমন্বয় করলেন?

রাফি: বাংলাদেশ রেলওয়ের অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে আন্দোলন করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মহিউদ্দিন রনি আমার পূর্ব পরিচিত। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল। রনি ভাইকে জানালাম, আমি ঢাকায় যাচ্ছি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত হতে। তিনি বললেন, মন চাইলে চলে আয়। এই আন্দোলনে শুরু থেকে যুক্ত ছিলেন হাসিবুল ইসলাম। তাঁর সঙ্গে ফেসবুকে অনেক আগে থেকেই যুক্ত ছিলাম। তাঁকে ফেসবুকে নক দিলাম। তিনি বললেন, আমরা এখনও ক্যাম্পাসের বাইরে কাউকে বলছি না, নিজেরাই সংগঠিত হয়ে ক্যাম্পাসে আন্দোলন করছি।  

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ে অনশন কর্মসূচি পালন করে আলোচনায় থাকা হাসনাত আব্দুল্লাহ ভাইয়ের সঙ্গেও আমার যোগাযোগ ছিল। ঢাকায় গিয়ে তাঁকে পেয়ে যাই। এছাড়া হাসিব ভাইয়ের সঙ্গেও আগে থেকেই পরিচয় ছিল। তাঁদের সঙ্গে আমি সেদিন মিছিলে যোগ দেই ঢাকার রাজপথে, ছিলাম সামনের কাতারে। আমি যেটা করি, সেটা ভালোভাবেই করি। পরে চট্টগ্রামে চলে আসি। ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে অনেকের সমর্থন পেয়েছি, তাদেরকে নিয়ে মিটিং করেছি। সেখানে রাসেল ভাইসহ আরও অনেকে ছিল। প্রথমে সংখ্যায় আমরা অনেক কম ছিলাম। ঈদের আগে সম্ভবত ১৩ জুন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করি, সেখানে ৩০ দিনের মধ্যে দাবি মেনে নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। সারাদেশের মতো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩ জুলাই অবরোধ কর্মসূচিও পালন করা হয়।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে ছিল? আপনি কিভাবে হলে সিট পেয়েছিলেন?

রাফি: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকতে হলে রাজনৈতিকভাবে উঠতে হয়। আমি আলাওল হলে থাকতাম। আমাদের বিভাগের ছাত্রদের হল হচ্ছে- সোহরাওয়ার্দী। এলাকার এক বড় ভাইয়ের মাধ্যমে আমি হলে উঠেছিলাম। আমার সঙ্গে হলে আরও অনেক বন্ধু উঠেছিল। ক্যাম্পাসে আন্দোলন করতে গিয়ে অনেকে আমাকে সাপোর্ট করেছিল। যেদিন আমি অবরোধ কর্মসূচিতে যাই, সেদিন থেকে আমার ওপর চাপ আসতে শুরু করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নম্বর রোড অবরোধ করেছিলাম। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান নওফেল ফোন করে ছাত্রলীগ নেতাদের বলেছিলেন- সে হলে থাকে, কিভাবে আন্দোলন করার সাহস পায়? বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নওফেল গ্রুপ আন্দোলন বন্ধ করতে আমাকে নানাভাবে চাপ দিতে থাকে। হত্যাসহ নানান হুমকি দিয়েছে। আমি ঘোষণা দিয়েছিলাম, আন্দোলন থেকে সরে যাবো না।

শাটল ট্রেনে আপনার সঙ্গে কি ঘটেছিল?

রাফি: আমি আন্দোলনে যোগ দিতে এক দুপুরে চট্টগ্রাম শহরে যাওয়ার জন্য শাটলে উঠেছিলাম। সেদিন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আমাকে মারধর করেছিল। শাটলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছিল নিরব দর্শক। প্রক্টর অফিসে নিয়ে যাওয়ার সময় আরেক দফা মারধর করা হয়। ওই সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকরা আমাকে অনেক সহযোগিতা করেছেন। তারা ছিলেন বলেই ছাত্রলীগের হামলা থেকে রক্ষা পাই। প্রক্টর অফিসে ছাত্রলীগ আমাকে ক্যাম্পাস ছাড়া করা, বহিষ্কার করাসহ নানান দাবি তুলেছিল। আমি দেশদ্রোহী ও রাজাকারসহ অনেক অপবাদ দিয়েছিল। আমার কাছে থাকা জাতীয় পতাকা কেড়ে নিয়ে প্রক্টর স্যারকে দিয়েছিল। প্রক্টর স্যারের উপস্থিতিতে ছাত্রলীগ আমাকে মারধর করতে চেয়েছিল, কিন্তু আমাদের ভাই-বোনরা উপস্থিত থাকায় মারধর করতে পারেনি।

মুক্তিযোদ্ধা কোটায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করলেন কেন?

রাফি: আমি বীর মুক্তিযোদ্ধার নাতি, সেটা সবাই জানতো। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ভর্তি হয়েছি। কিন্তু মানুষের একেক বয়সে একেক ধরনের ভাবনা আসে। স্কুল জীবনে ভাবনা ছিল এক ধরনের, কলেজ জীবনে আরেক ধরনের। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে বাস্তবতা অনুধাবন করেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ভর্তি হয়েছি বলে আমি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন করতে পারবো না? আন্দোলন হয়েছে সার্বিক কোটা সংস্কারের বিরুদ্ধে। তাই আমি সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করেছি।  

শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সাধারণ মানুষকে কিভাবে সম্পৃক্ত করলেন?

রাফি: শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ বুঝেছিল- আমাদের আন্দোলন ন্যায্য অধিকারের জন্য। সেজন্য শিক্ষার্থী ও জনগণ প্রত্যেকে আমাদের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেছিল। মানুষ যখন বুঝতে পেরেছে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা হচ্ছে, তখন তাদের অংশগ্রহণ বেড়ে যায়। আমি একজন সাধারণ ছাত্র হিসেবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলেছিলাম।

আন্দোলন চলাকালে কোথায় থাকতেন, খাবারের সংস্থান কিভাবে হয়েছিল? 

রাফি: আন্দোলনে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ নিজ নিজ অবস্থান থেকে সহযোগিতা করেছে। কেউ খাবার দিয়েছে, কেউ পরিবহন খরচ দিয়েছে। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার হাত থেকে গ্রেপ্তার এড়িয়ে থাকার জন্য সবসময় আমরা চেষ্টা করেছি। আমার কাছে একটি মোবাইলের চার্জার রাখতাম। শরীরে যে পোশাক ছিল, সেটা নিয়ে অনেকটা সময় আমি আর রাসেল ভাই চট্টগ্রাম শহরে একজনের বাসায় ছিলাম। আমাদের খাবারের অভাব হয়নি, যে যেখান থেকে পেরেছে আমাদের জন্য খাবার পাঠিয়েছে। কিন্তু সেই খাবার আমি খেতে পারিনি। আমি এখনও ভাত খেতে পারি না। পানি আর নাস্তা খেয়ে থাকি। ভাত খাওয়ার জন্য বসলে আমার ভাই-বোনের কথা মনে পড়ে যায়। যার কারণে আর খাওয়া হয়ে ওঠে না। শিক্ষার্থীরা সবসময় বলতেন- ‘আমি যেন সবসময় নিরাপদে থাকি, আমরা আছি তোমার সাথে’।  

পুলিশের সামনে বুক পেতে দিয়ে কেন দাঁড়িয়েছিলেন?

রাফি: আমি প্রথম যেদিন আন্দোলনে এসেছিলাম, সেদিন বলেছিলাম- যতদিন আন্দোলন হবে, ততদিন রাজপথে থাকবো। আমার মৃত্যু হলে রাজপথেই হবে। ‘যদি আমি শহিদ হই, তবে আমার নিথর দেহটা রাজপথে ফেলে রাখবেন। ছাত্র সমাজ যখন বিজয় মিছিল নিয়ে রুমে ফিরবে, তখন আমাকেও বিজয়ী ঘোষণা করে দাফন করবেন। একজন পরাজিতের লাশ কখনও তার মা-বাবা গ্রহণ করবে না’। ১৫ জুলাই আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। শিক্ষার্থীরা দৌড়াদৌড়ি করছিল, আমিও টাইগারপাস থেকে দৌড়ে দুই নম্বর গেইট এলাকায় এসেছি। একপর্যায়ে পুলিশের হামলার মুখে তাদের সামনে বুক পেতে দিয়ে দাঁড়িয়ে যাই। এরপর জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। সড়কে জাতীয় পতাকা মুড়িয়ে আমাকে শুইয়ে রেখে সহযোদ্ধারা আবারও বিক্ষোভ করে। সবদিকে ছড়িয়ে পড়ে আমার মৃত্যুর গুজব। সবাই আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। জ্ঞান ফিরে এলে শুনলাম- বিশ্ববিদ্যালয়ে সড়ক অবরোধ করে রেখেছে শিক্ষার্থীরা। রাতের শাটলে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে দেখি- আমার জন্য হাজার হাজার শিক্ষার্থী ভাই-বোন অপেক্ষা করছে। আমি কল্পনাও করিনি- ওরা আমার অপেক্ষায় থাকবে।

কেমন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় দেখতে চান?

রাফি: লেজুরবৃত্তির ছাত্র রাজনীতি চলবে না। আমরা ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছি, প্রত্যেক কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য ছাত্র সংসদ চালু করতে হবে। আমরা এমন একটি বাংলাদেশ চাই, যেখানে কোনও বৈষম্য থাকবে না, থাকবে না কোনও অনিয়ম।  

বাংলাদেশ সময়: ১২০০ ঘণ্টা, আগস্ট ২৯, ২০২৪
এমআই/এসি/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।