ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৬ বৈশাখ ১৪৩২, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ০১ জিলকদ ১৪৪৬

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

বিজ্ঞপ্তির অস্পষ্টতায় সমাবর্তন বঞ্চিত হচ্ছেন স্বর্ণপদক বিজয়ী শিক্ষার্থী

মোহাম্মদ আজহার, ইউনিভার্সিটি করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০:৩৯, এপ্রিল ২৯, ২০২৫
বিজ্ঞপ্তির অস্পষ্টতায় সমাবর্তন বঞ্চিত হচ্ছেন স্বর্ণপদক বিজয়ী শিক্ষার্থী ...

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়: বিভ্রান্তির শুরুটা বিজ্ঞপ্তির অস্পষ্টতা থেকে। ধোঁয়াশা কাটাতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে যা করেছেন, আদতে সবটাই ভুল।

যার ফলে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে চ্যান্সেলর স্বর্ণপদক বিজয়ী এক শিক্ষার্থীর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) সমাবর্তনে অংশগ্রহণের সুযোগ।

দীর্ঘ ৯ বছর পর আগামী ১৪ মে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে চবির ৫ম সমাবর্তন।

সাড়ে ২২ হাজারের বেশি গ্র্যাজুয়েটকে নিয়ে আয়োজিত সমাবর্তনটিকে দেশের সর্ববৃহৎ সমাবর্তনই বলা হচ্ছে। যেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে থাকবেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং চবির অর্থনীতি বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।  

সমাবর্তন ঘিরে ব্যস্ত সময় পার করছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। অপরদিকে বহুল প্রতীক্ষিত চবির ৫ম সমাবর্তন নিয়ে উচ্ছ্বসিত প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা। কেউ কেউ ১০-১৫ বছর পর এ উপলক্ষে আসবেন ক্যাম্পাসে। বিভাগের পুরোনো গ্রুপগুলো আবারও নিশ্চয়ই সরব হয়ে উঠেছে সমাবর্তনের আলোচনায়। বন্ধুদের সঙ্গে করছেন পরিকল্পনা। আর ভালো রেজাল্টধারীদের সমাবর্তনে অংশগ্রহণের আনন্দটাও একটু বেশি থাকে।  

তেমনই একজন চবির যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ২০১৫-১৬ সেশনের শিক্ষার্থী সুমন আহমেদ। স্নাতকের ফলাফলে যার অবস্থান প্রথম শ্রেণিতে ২য়। এছাড়া ২০১৬ সালে প্রথমবর্ষেই 'চ্যান্সেলর রচনা স্বর্ণপদক প্রতিযোগিতায়' অংশ নিয়েই প্রথমস্থান অর্জন করে পেয়েছেন গোল্ড মেডেল। তাই অনার্স, মাস্টার্সের সনদের বাইরেও তার আরেকটি বড় অর্জন এই স্বর্ণপদক।  

মূলত প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে স্বর্ণপদকের প্রতিযোগিতাটি অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে প্রথমস্থান অর্জনকারীকে স্বর্ণপদক ও সনদ এবং দ্বিতীয় স্থান অর্জনকারীকে আর্থিক পুরস্কার ও সনদ দেওয়া হয়। ২০১৬ সালে এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে প্রথম স্থান অর্জন করেছিলেন সুমন আহমেদ।

চবির ৫ম সমাবর্তনের বিজ্ঞপ্তিতে সমাবর্তনে অংশগ্রহণের নিয়ম ও শর্তাবলীর (খ) তে উল্লেখ করা হয়, 'চ্যান্সেলর স্বর্ণ পদক বিজয়ীদের কোনো 'ফি' প্রদান করতে হবে না, তবে সমাবর্তনে যোগদানের জন্য অনলাইনে আবেদন করতে হবে। ' এছাড়া প্রযোজ্য ডিগ্রিসমূহের স্থানে উল্লেখ করা হয়, ২০১৪ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত চ্যান্সেলর স্বর্ণপদক বিজয়ীরা সমাবর্তনে অংশ নিতে পারবেন।  

জানা গেছে, ২০১৭ সালে বিগত বেশ কয়েক বছরের স্বর্ণপদক বিজয়ীদের নিয়ে একটি আয়োজন করে পুরস্কার ও সনদ তুলে দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। যেখানে ১৭ জন বিজয়ী অংশ নিয়েছিলেন। অর্থাৎ সে বছরই ২০১৬ সাল পর্যন্ত চ্যান্সেলর স্বর্ণপদক বিজয়ীরা সনদ পেয়েছিলেন। কিন্তু বিজ্ঞপ্তিতে ২০১৪ সাল থেকে স্বর্ণপদক বিজয়ীদের সমাবর্তনের অংশগ্রহণের কথা উল্লেখ করায় সৃষ্টি হয় বিভ্রান্তি।  

স্বর্ণপদক বিজয়ী সুমন আহমেদ অস্পষ্টতা কাটাতে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখিত ফোন নম্বরে যোগাযোগ করেন। ফোনের অপরপ্রান্তে থাকা পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দফতরের ফলাফল শাখার উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মিছবাহুল মোকর রবীনের পরামর্শে ওই শিক্ষার্থী অনার্স-মাস্টার্সের সনদের পরিবর্তে কেবল স্বর্ণপদকের সনদের জন্যই আবেদন করে সমাবর্তনের রেজিষ্ট্রেশন সম্পন্ন করেন।  

সম্প্রতি সুমন আহমেদকে ফোনকলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ থেকে জানানো হয়, তিনি সমাবর্তনে অংশে নিতে পারবেন না। কেননা তিনি ইতিপূর্বে স্বর্ণপদকের সনদ পেয়েছেন এবং স্নাতক বা স্নাতকোত্তরের সনদের জন্য আবেদন করেননি। বিষয়টি জানার পর পুনরায় প্রথমবার যোগাযোগ হওয়া সেই কর্মকর্তাকে মুঠোফোনে জানালে তিনি বলেন, স্বর্ণপদকের সনদ উত্তোলনের বিষয়টি না জানায় এমন পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি। আর তাই এখন আর সুমন আহমেদের সমাবর্তনে অংশগ্রহণের কোনো সুযোগ নেই।

যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী সুমন আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, আমি ২০১৬ সালে চ্যান্সেলর স্বর্ণপদক অর্জন করি। বিজ্ঞপ্তিতে মোটাদাগে লিখা আছে, ২০১৪-২৪ সালের মধ্যে স্বর্ণপদক বিজয়ীরা অংশ নিতে পারবেন। কিন্তু 'যারা ইতিমধ্যে স্বর্ণপদক ও সনদপত্র গ্রহণ করেছে তারা সমাবর্তনে অংশ নিতে পারবে না', এমন কোনো কথা উল্লেখ নেই সেখানে। তবুও আমার সন্দেহ হয় যে, আসলেই আমি আবেদন করতে পারবো কি-না? তাই বিজ্ঞপ্তিতে দেওয়া প্রথম নম্বরটিতে (01716125720) গত ২৪ মার্চ কল দিয়ে সবকিছু খুলে বলি এবং বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে আবেদন করি।

সুমন আহমেদ আরও বলেন, ওই কর্মকর্তাই আমাকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের জন্য আবেদন না করলেও চলবে- এমন পরামর্শ দেন, কেননা আমি স্বর্ণপদকের সনদের জন্য আবেদন করেই সমাবর্তনে অংশ নিতে পারবো। আমার কাছে সেই কথোপকথনের রেকর্ড আছে। গত ২০ এপ্রিল উনার সঙ্গে পুনরায় কথা হয় আমার। এখন তিনি বিষয়টি অস্বীকার করছেন। অথচ আমার আবেদনটি ওয়েবসাইটে গৃহীতও হয়েছে। এর পিডিএফ ফাইলটিও সংগ্রহ করেছি আমি। আমার ভুলে তো এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। তাই আমাকে সমাবর্তনে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হোক। আমি পুরো টাকাসহ আবেদনের সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে রাজি আছি।

এদিকে দুটো কথোপকথনের রেকর্ডিংয়েও ভুক্তভোগীর অভিযোগের সঙ্গে মিল রয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মিছবাহুল মোকর রবীন বাংলানিউজকে বলেন, এখানে একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। সে যে স্বর্ণপদকের সনদ গ্রহণ করেছে, সেটা তো বলেনি আমাকে। তাই আমি বলেছিলাম স্নাতক বা স্নাতকোত্তরের জন্য আবেদন করে টাকা নষ্ট করার দরকার নেই, শুধু স্বর্ণপদকের সনদের জন্য আবেদন করলেই হবে। তার কথাতেও অস্পষ্টতা ছিলো। আমার মনে হয় না এখন আর নতুন করে আবেদনের সুযোগ আছে।

চবির ৫ম সমাবর্তন কমিটির সদস্য সচিব ও ভারপ্রাপ্ত পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক ড. মো. এনায়েত উল্যা পাটওয়ারী বাংলানিউজকে বলেন, ওই শিক্ষার্থীকে হয়তো সরাসরি সমাবর্তনে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া সম্ভব হবে না। তবে আমরা দেখি এর বাইরে অন্যকোনোভাবে তাকে সংযুক্ত করতে পারি কি-না। তিনি একটি আবেদনপত্র জমা দিতে পারেন। আমি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিষয়টি আলোচনা করে দেখবো।

৫ম সমাবর্তন ঘিরে যেসব সমালোচনা:

প্রায় ১৩ কোটি টাকা বাজেট রাখা হয়েছে এবারের সমাবর্তনটির জন্য। ২২ হাজার ৫৯৭ জন গ্র্যাজুয়েট এতে অংশ নেবেন। এ আয়োজনকে নিয়ে শিক্ষার্থীরা যেমন উচ্ছ্বসিত, তেমনি বেশকিছু বিষয়ে ইতোমধ্যে  সমালোচনাও সৃষ্টি হয়েছে।  

রেজিষ্ট্রেশন ফি 

সমাবর্তনের রেজিষ্ট্রেশন ফি নিয়ে প্রথম থেকেই তীব্র সমালোচনা দেখা যায়। এবার সমাবর্তনে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর একেকটি সনদের জন্য ৩ হাজার টাকা ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের জন্য একটি মোবাইল ওয়ালেট, কোটপিন, ব্যাগ, কলম, গাউন ও ক্যাপ, দুপুরের লাঞ্চের ব্যবস্থা থাকবে। তবে একই ব্যক্তি দুটো সার্টিফিকেটের জন্য রেজিষ্ট্রেশন করলে সব সুযোগ সুবিধা সমান থাকলেও কেবল দ্বিতীয় সনদটির জন্য একজন শিক্ষার্থীকে অতিরিক্ত গুনতে হয়েছে ৩ হাজার টাকা। সাধারণত একটি সনদ তুলতে খরচ হয় ৮০০ টাকা। ইমার্জেন্সি তুললে ১২০০ টাকা। সেই হিসেবে দ্বিতীয় সনদটির জন্য ১২০০-১৫০০ টাকা রাখার পক্ষে ছিলেন শিক্ষার্থীরা।

সনদ উত্তোলনকারীদের অংশগ্রহণ

দ্বিতীয় যে সমালোচনাটি তীব্রতর হয়ে ওঠে, তা হলো- যারা ইতোপূর্বে সনদ উত্তোলন করেছেন, তারা সমাবর্তনে অংশ নিতে পারবেন না। বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হওয়ায় দ্রুত বিকল্প সমাধান বের করে প্রশংসিত হয় কর্তৃপক্ষ। পরবর্তীতে সনদ উত্তোলনকারীদের জন্য আলাদা রেজিষ্ট্রেশনের সময় নির্ধারণ করে তাদেরকে সমাবর্তনে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়।

সমাবর্তনের লোগো নিয়ে হাস্যরস

সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয়েছে চবির ৫ম সমাবর্তনের লোগোর ডিজাইন। চবির চারুকলা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক উত্তম কুমার বড়ুয়া লোগোটির ডিজাইন করেন। জানা গেছে এর আগেও তিনি চবির সমাবর্তনের লোগো ডিজাইন করেছিলেন।  

এদিকে কর্তৃপক্ষ সমাবর্তনের লোগোর থিম নিয়ে ব্যাখ্যা দিলেও লোগোটির ডিজাইনকে শিক্ষার্থীরা সেকেলে বা ব্যাকডেটেড বলেই আখ্যায়িত করেছেন। পরবর্তীতে শিক্ষার্থীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপ ও পেজ থেকে একাধিক লোগোর ডিজাইন আইডিয়া শেয়ার করলেও লোগো পরিবর্তন না করার সিদ্ধান্ত নেয় কর্তৃপক্ষ। এতে করে সমাবর্তনের লোগো নিয়ে হাস্যরত করতে দেখা গেছে অনেককে।  

শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ এমন মন্তব্য করেছেন, 'লোগো পরিবর্তন না হলে সমাবর্তনেই অংশ নিবো না'। বিপরীতে 'শিক্ষার্থীরা সমালোচনা করুক, আমি লোগো পরিবর্তন করবো না' বলে মন্তব্য করেছিলেন চবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার। তাই বলা চলে সমাবর্তনের লোগোটি অপরিবর্তিতই থাকছে।

বাংলাদেশ সময়: ১০৩৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৯, ২০২৫
এমএ/পিডি/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।