শিলিগুড়ি: জাতিগত সংঘর্ষের জেরে আসাম থেকে দলে দলে মানুষ পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার জেলায় এসে আশ্রয় নিয়েছে। সেই সঙ্গে রেল ও সড়কপথ বন্ধ থাকার কারণে আসামের বহু মানুষ আটকে পড়েছে রাজ্যের এ দু’টি জেলায়।
বুধবার বিকেল থেকে জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার জেলায় আটকে পড়া আসামগামী ট্রেনগুলোকে ফের চালু করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়েছে। সেনা পাহারায় একটি করে ট্রেন আসামের দিকে পাঠানোও শুরু হয়েছে। কিন্তু ধীর গতির কারণে সব ট্রেন এখনো গন্তব্যে পৌঁছতে পরেনি।
অন্যদিকে উত্তরপূর্ব সীমান্ত রেলের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, আসামে নতুন করে কোনো ট্রেন আপাতত চলাচল করবে না।
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে আশ্রয় নেওয়া এবং আটকে পড়া মানুষ প্রবল ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন আসাম সরকার এবং রেল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ত্রাণ শিবিরের ব্যবস্থা না করা হলেও বিপদের দিনে কোচবিহার ও জলপাইগুড়ি জেলার মানুষের কাছে আসামের এসব অসহায় মানুষ আত্মীয়সুলভ আচরণই পাচ্ছে বলে জানা গেছে।
বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকেও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
কোচবিহার ও জলপাইগুড়ি জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আসাম সীমান্তবর্তী এলাকাগুলিতে পুলিশের টহল ও নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এজন্য জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার জেলায় অতিরিক্ত পুলিশবাহিনীও আনা হয়েছে।
জলপাইগুড়ি জেলার কুমারগ্রাম ব্লকের বিভিন্ন এলাকা এবং কোচবিহারের তুফানগঞ্জ ও বক্সিরহাট ব্লক আসাম সীমানা সংলগ্ন। এই দু’টি এলাকার গ্রামগুলোতেই আসাম থেকে দলে দলে মানুষ গত কয়েক দিনের সংঘর্ষের জেরে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে। মানুষ এসেছে ট্রেকার, লরি, ট্রাকে চেপে এবং সঙ্কোশ নদী পার হয়ে পায়ে হেঁটে।
এদিকে আসামের যেসব গ্রাম এখনো জাতিগত সংঘর্ষে উত্তপ্ত তার লাগোয়া পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের গ্রামগুলোতে আতঙ্ক উত্তেজনা বিরাজ করছে।
জলপাইগুড়ি জেলার পুলিশ সুপার সুগত সেন জানিয়েছেন, অতিরিক্ত পুলিশবাহিনী এনে সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তার ব্যবস্থা ও নজরদারির ব্যবস্থা করা হয়েছে।
জলপাইগুড়ির জেলাশাসক স্মারকী মহাপাত্র জানিয়েছেন, জেলায় কোনো আশ্রয় শিবির খোলা হয়নি। তবে যারা আসছেন তাদের খাবার দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আসাম থেকে বহু মানুষ আসছেন তবে তারা এসে কোথায় থাকছে তার কোনো তথ্য সরকারিভাবে নেই বলে স্বীকার করেন তিনি।
কোচবিহারের পুলিশ সুপার প্রণব দাস জানিয়েছেন, তুফানগঞ্জ এবং বক্সিরহাটে এসে বহু মানুষ তাদের আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে।
তুফানগঞ্জের ভানুকুমারী ১ এবং ২নং গ্রাম পঞ্চায়েত আসামের সংঘর্ষ কবলিত কোঁকড়াঝাড় জেলার সংলগ্ন। আসামের ছোটগুমা, ছাগোলিয়া, কাইমামাটি, কামানডাঙা, কামারহাট, কাছারীগাঁও ইত্যাদি এলাকা থেকে বহু মানুষ ভানুকুমারীর এই দু’টি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় এসেছেন।
আসামের শ্রীরামপুর এবং পোকালাগি থেকে সঙ্কোশ পেরিয়ে বহু মানুষ এসে আশ্রয় নিয়েছেন বক্সিরহাটের রামপুর এবং বারোকোদালিতে। কোচবিহারের এই গ্রামগুলোর অদূরেই আসামের গ্রামগুলোতে আশ্রয়শিবিরে হাজার হাজার মানুষ ঠাঁই নিয়েছেন। কিন্তু সেখানে বাজার-হাট বন্ধ থাকায় সমস্যায় পড়ছেন মানুষ।
অনেকেই এপারের আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিচ্ছে। কিন্তু আসামে কবে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে আসবে আর কবে তারা ঘরে ফিরতে পারবে সেই আশঙ্কা সবার চোখেমুখে ।
অন্যদিকে রেল ও সড়কপথে আসামের শান্ত অঞ্চলে ফিরে যাওয়ার জন্য যারা যাত্রা করেছিলেন তারাও আটকে পড়েছেন আলিপুরদুয়ার জংশন, নিউ আলিপুরদুয়ার, নিউকোচবিহার, ঘোকসাডাঙা, ফালাকাটা প্রভৃতি স্টেশনে। এসব স্টেশনে যাত্রীরা রেল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে উপযুক্ত ব্যবস্থা না পেয়ে ক্ষুব্ধ হয়েছে।
অনেকেই সড়কপথে কোচবিহারে চলে এসেছিলেন বাসে করে গুয়াহাটি বা আসামের অন্যত্র ফিরে যাবেন বলে। কিন্তু কোচবিহার থেকে আসামগামী বাস পরিসেবাও এখন বন্ধ। কারণ গুয়াহাটি বা ধুবড়ি, বরপেটা বা বিলাসীপাড়া সব জায়গার বাসই কোঁকড়াঝাড়ের ওপর দিয়ে যেতে হয়। ফলে কোচবিহারেও বহু যাত্রী আটকে পড়ে সমস্যায় পড়েছেন।
এদিকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের চাপে শেষ পর্যন্ত আটকে পড়া ট্রেনগুলো চালু করেছে রেলকর্তৃপক্ষ। গুয়াহাটিগামী রাজধানী এক্সপ্রেসে হামলার পরে ট্রেন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিলো। স্টেশনগুলোতেও আটকে পড়া যাত্রীদের জন্য কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি।
বুধবার বিকেলে কোচবিহার ও আলিপুরদুয়ার থেকে ট্রেনগুলো সেনাবাহিনীর পাহারায় চালু করা হয়।
রেলসূত্রে জানা গেছে, আসামের ভেতর ৫৪ কিলোমিটার পথকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। ওইসব অঞ্চলে সতর্কভাবে সেনা পাহারা দিয়ে ট্রেন পার করা হবে। তবে নতুন করে আসামে কোনো ট্রেন চলাচল আপাতত বন্ধ রাখা হবে।
এদিকে নিউ কোচবিহার স্টেশনে এদিন আটকে পড়া যাত্রীদের দুপুরের খাবার এবং শিশুদের দুধ বণ্টন করেছেন সিআইটিইউ-র রেলওয়ে হকার্স ইউনিয়ন, রেলওয়ে কন্ট্রাক্টরস লেবার ইউনিয়ন এবং রেলওয়ে এফসিআই মজদুর ইউনিয়নের কর্মীরা।
নিউ আলিপুরদুয়ার ও আলিপুরদুয়ার জংশনে আটকে পড়া যাত্রীদেরও সাহায্য করেন ডিওয়াইএফআই, এসএফআই এবং আরসিএলইউ-র কর্মীরা।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় নিউ আলিপুরদুয়ার স্টেশনে অবোধ আসাম ও নর্থ ইস্ট এক্সপ্রেসের যাত্রীদের শুকনো খাবার, শিশুখাদ্য ও পানীয় জল দেওয়া হয়। বুধবারও তারা যাত্রীদের খাবার ও পানীয় জল দিয়ে সাহায্য করেন। আলিপুরদুয়ার জংশনে সম্পর্ক কান্তি এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রীদেরকেও খাবার দেওয়া হয়।
আসাম থেকে আলিপুরদুয়ার মহকুমায় আশ্রয় নেওয়া মানুষদের সাহায্য করতে ডিওয়াইএফআই’র পক্ষ থেকে শুকনো খাবার দেওয়া হয়েছে। আলিপুরদুয়ার ২নং পঞ্চায়েত সমিতির পক্ষ থেকে এসব বিপন্ন মানুষদের বর্ষায় মাথা গোঁজার জন্য ত্রিপল, চাল, ডাল দেওয়া হয়েছে।
গত ১৯ জুলাই থেকে ভারতের আসাম রাজ্যের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে স্থানীয় বড়ো আদিবাসী এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সহিংসতা অব্যাহত রয়েছে। সহিংসতায় এ পর্যন্ত উভয়পক্ষে কমপক্ষে ৪১ জন প্রাণ হারিয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে সেনা বাহিনীর টহল জোরদার করা হয়েছে।
আসামের এ এলাকায় বড়ো আদিবাসী এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া মুসলমানদের মধ্যে জমি নিয়ে বিরোধ অনেক পুরনো। ধারণা করা হচ্ছে, এ বিরোধ থেকেই সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়েছে।
অবশ্য অনেকে বলছেন, এ এলাকায় সম্প্রতি মুসলিম বিরোধী মনোভাব মাথা চাড়া দিয়েছে। স্থানীয় হিন্দু এবং খ্রিস্টান আদিবাসীরা অভিবাসন বিরোধী এবং বাংলাদেশি মুসলিম সেটলারদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে।
পুলিশের তথ্য মতে, সর্বশেষ সহিংতা শুরু হয় গত শুক্রবার রাতে বড়ো উপজাতী অধ্যুষিত কোঁকড়াঝড় জেলায় চার তরূণ নিহত হওয়ার পর। তবে কারা এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তা জানা যায়নি।
এর প্রতিক্রিয়ায় বড়ো আদিবাসীরা প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে উঠে এবং সশস্ত্র লোকেরা স্থানীয় মুসলমানদের ওপর হামলা করলে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে অন্য এলাকায়।
বাংলাদেশ সময়: ২০৫৫ ঘণ্টা, জুলাই ২৬, ২০১২
আরডি/সম্পাদনা: জাহাঙ্গীর আলম, নিউজরুম এডিটর