ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

দিল্লি, কলকাতা, আগরতলা

‘কবি সুকান্তর স্মৃতি রক্ষা করতে চায় না পশ্চিমবঙ্গ সরকার’

রক্তিম দাশ, ব্যুরো চিফ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৪১ ঘণ্টা, আগস্ট ২২, ২০১২
‘কবি সুকান্তর স্মৃতি রক্ষা করতে চায় না পশ্চিমবঙ্গ সরকার’

কলকাতা: সুকান্ত ভট্টাচার্য (১৬ আগস্ট, ১৯২৬ - ১৩ মে, ১৯৪৭) বাংলা সাহিত্যের মার্কসবাদী ভাবধারায় বিশ্বাসী এবং প্রগতিশীল চেতনার অধিকারী চিরতরুণ কবি। পিতা নিবারণ ভট্টাচার্য ও মা সুনীতি দেবী।

১৯২৬ সালের ১৬ আগস্ট মাতামহের ৪৩ মহিম হালদার স্ট্রিটের বাড়িতে তার জন্ম। । তার পৈতৃক নিবাস ছিল ফরিদপুর জেলার (বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া থানার উনশিয়া গ্রামে)।

কবির জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছিল কলকাতার বেলেঘাটার ৩৪ হরমোহন ঘোষ লেনের বাড়িতে। সেই বাড়িটি এখনো অক্ষত আছে। পাশের বাড়িটিতে এখনো বসবাস করেন সুকান্তের একমাত্র জীবিত ছোট ভাই বিভাস ভট্টাচার্য। তাকে খুঁজে বার করে তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমের কলকাতা ব্যুরো চিফ রক্তিম দাশ।

৫৮/বি হরমোহন ঘোষ লেন, বেলেঘাটা,কলকাতা বর্তমানের এই ঠিকানায় সুকান্তের স্মৃতিকে আকঁড়ে ধরে  রয়েছেন ৭৫ বছরের প্রবীণ কবি সুকান্তের ভাই বিভাস ভট্টাচার্য খবরটা পেয়ে বাংলানিউজের পক্ষ থেকে ঈদের বিকালে চলে গেলাম তার বাসায়। সঙ্গী হলেন কবির তৈরি শিশু-কিশোরদের সংগঠন কিশোর বাহিনীর মুখ্য সংগঠক পীযূষ ধর ও দীপক রায়।

বাসার দরজা খুলে আমাদের অপেক্ষা করতে বলে ভেতরে গেলেন বিভাস ভট্টাচার্য ও তার স্ত্রী আরতী ভট্টাচার্য। কয়েক মিনিট পরে লাঠিতে ভর দিয়ে আমাদের সামনে এলেন তিনি। বার্ধক্যজনিত রোগ ইত্যাদি কারণে তিনি প্রায় চলশক্তি রহিত। কানেও ঠিক শুনতে পান না। কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম, বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম থেকে এসেছি। আবেগে আমার হাতদুটো জড়িয়ে ধরলেন প্রবীণ মানুষটি। বললাম, আপনার সাক্ষাৎকার নিতে চাই।

বললেন, এর আগে তো কেউ আসেনি বাংলাদেশ থেকে। বলুন কী জানতে চান?

বললাম, আপনি আপনার মতো করে বলুন। সুকান্তর সঙ্গে আপনার স্মৃতি।

ভারতের স্বাধীনতার পরের দিন ১৬ আগস্ট ওর জন্ম। অনেকে জন্মদিন ১৫ আগস্ট পালন করে। এটা নিয়ে কোনো বির্তকে আমি যাব না। বাংলাদেশে প্রতিবছর দিনটা পালন হয়, এতে ভালো লাগছে। আনন্দ হচ্ছে, আমি তো আর যেতে পারবো না।

এই পাড়াতে ওর বেড়ে ওঠা। এই বাড়িতে নয়, ৩৪ নম্বর আর ৩৮ নম্বর হরমোহন ঘোষ লেনের বাড়িতে। বুদ্ধর বাড়ি (পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী) আর আমাদের বাড়ি। একই সঙ্গে ছিল। জয়েন্ট ফ্যামিলি। ৩৮ ছিল টোল বাড়ি। ওখানে সংস্কৃত টোল ছিল। পড়াশোনা হত। আর ৩৪ নম্বর পাকা বাড়িটা ছিল আমাদের বসত বাড়ি। জ্যাঠামশাই, জ্যাঠতুতো ভাই সবাই আমরা একসাথে থাকতাম। বুদ্ধর তখন জন্ম হয়নি।

সুকান্ত প্রায় অসুস্থ হয়ে পড়তেন। কমিউনিস্ট পার্টির একটি সাপ্তাহিক আর মাসিক পত্রিকার বেশ কয়েকটি কপি এলাকায় ঘুরে ঘুরে বিলি করতেন তিনি। ওনি বেশি অসুস্থ হলে আমি ওনার হয়ে বিলি করতাম। তখন ওর বয়স ১৯/২০ হবে। আমি ছিলাম ওর অনুগত সৈনিক।

এই রাস্তার ধার দিয়ে অনমনস্ক হয়ে হাঁটতেন। পায়ে হেঁটে শিয়ালদার পার্টি অফিসে যেতেন। সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। কাজের চাপে ঠিক সময় খাওয়া-দাওয়া করতেন না। বাড়ির থেকে ৫ টাকা নিয়ে বের হয়ে পার্টি তহবিলে চাঁদা দিয়ে, সারাদিন ঘুরে না খেয়ে, বাসে করে না ফিরে পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরতেন।

রাতের বেলায় লিখতেন। অল্প সময় লিখতেন। আর কবিতা, একবারেই লিখতেন। বারে বারে নয়। তাই তার কবিতায় কোনো কাটাকুটি ছিল না। আমি তার কবিতা নিয়ে যেতাম প্রকাশকের কাছে। তার রাজনৈতিক সচেতনতা ছিল প্রখর। আমাকে ওই পার্টি সদস্য করে তোলে। কিশোর বাহিনীরও সদস্য করে।

এর আগে আমাদের বাড়িতে কেউ কমিনিউস্ট পার্টি করতেন না। আমাদের বাড়িতে ধর্মীয় প্রভাব থাকলেও আধুনিকতার চর্চা ছিল। মহাযুদ্ধের সময় গরীব মানুষের দুঃখ-কষ্ট তাকে কমিউনিস্ট পার্টির দিকে আকৃষ্ট করে।

সেই সময় এই পাড়ার একটি পরিত্যক্ত বাড়ির একটা ঘরে রিলিফ সেন্টার শুরু করলেন। এই সময় তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসেন। বামপন্থী ভাবধারার সঙ্গে পরিচিত হলেন। এর ফলে তার মনের মধ্যে যে ভাববাদ আর বস্তুবাদের যে দ্বন্দ্ব ছিল তা কেটে গেছিল কমিউনিস্ট পার্টিতে যুক্ত হবার পর। এটা না হলে আমরা হয়তো কবি সুকান্তকে পেতাম না।

যখন ওর মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে। ভর্তি হলেন যাদবপুর টিবি হাসপাতালে। কলকাতা জুড়ে দাঙ্গা চলছে। আমি প্রতিদিন খুব কষ্ট করে ওর কাছে যেতাম। তখন যাদবপুর গ্রাম। আজকের কলকাতা নয়। অনেক দূরত্ব। যা এখন ভাবা যায় না। ওই সময় তিনি আর কোনো লেখা লিখতে পারেননি।

এখন সুকান্ত চর্চা বা স্মৃতি রক্ষা যা হচ্ছে সবটাই ব্যক্তিগত উদ্যোগে। সরকারি উদ্যোগে কিছুই হয়নি। তার বসতবাড়ি সরকার চাইলে অধিগ্রহণ করতে পারতো তা হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশে আমাদের পৈত্রিক ভিটে সরকার লাইব্রেরি করলো, হল করলো।

এবার তার জন্মদিন পালনে বাধা দেওয়াটা স্বাভাবিক। ওনি তো সরকারের কবি নন। একমাত্র কবি বাংলায় যিনি সোচ্চারে ঘোষণা করছিলেন আমি কমিউনিস্ট। সেই কারণেই হয়নি।

রাজ্যের উচ্চ মাধ্যমিকের পাঠ্যসূচিতে তাকে বাদ দিতে চেয়েছিল। এটা ঠিক ছিল। কারণ যারা এখন রাজত্বে তারা সুকান্তকে চায় না। তিনি জনমানসের কবি। তাদের চাওয়া, না চাওয়ায় কিছু যায় আসে না। সুকান্ত তার দ্রোহ নিয়ে বেঁচে থাকবেন বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের মুক্তির লড়াইয়ে।

আপনার কাছে শুনলাম, বাংলাদেশে সুকান্ত চর্চা হচ্ছে ব্যাপক অর্থে। সেখানেই সুকান্ত ভালো আছেন। এটাই আনন্দের। আমাদের বাড়ি সংরক্ষণ করে তাকে বর্তমান প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্য পরিবারের পক্ষ থেকে শেখ হাসিনা সরকার, বাংলাদেশের জনগণ আর উনশিয়া গ্রামবাসীদের কৃতজ্ঞতা জানাই।

বাংলাদেশ সময়: ০৯২৪ ঘণ্টা, আগস্ট ২২, ২০১২
আরডি/সম্পাদনা: রানা রায়হান, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।