ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

দিল্লি, কলকাতা, আগরতলা

‘বুদ্ধদেব তার কাকার স্মৃতি রক্ষা করলেন না’

রক্তিম দাশ, ব্যুরো চিফ, কলকাতা | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৩৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২, ২০১২
‘বুদ্ধদেব তার কাকার স্মৃতি রক্ষা করলেন না’

কলকাতা: সুকান্ত ভট্টাচার্য (১৬ আগস্ট, ১৯২৬-১৩ মে, ১৯৪৭) বাংলা সাহিত্যের মার্কসবাদী ভাবধারায় বিশ্বাসী এবং প্রগতিশীল চেতনার অধিকারী চিরতরুণ কবি। পিতা নিবারণ ভট্টাচার্য ও মা সুনীতি দেবী।

১৯২৬ সালের ১৬ আগস্ট মাতামহের ৪৩ মহিম হালদার স্ট্রিটের বাড়িতে তার জন্ম। তার পৈতৃক নিবাস ছিল ফরিদপুর জেলার (বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলা) কোটালীপাড়া থানার উনশিয়া গ্রামে।

কলকাতা শহরে তার স্মৃতি গত কয়েক দশকে অজ্ঞাত কারণে ধীরে ধীরে মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছে। যে আর্দশকে বুকে নিয়ে কবি সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেছিলেন, ঘোষণা করেছিলেন, “আমি কমিউনিস্ট। ” সেই কমিউনিস্ট সরকারের আমলেই ৩৪ বছরে তার স্মৃতি কতটুকু রক্ষা করার চেষ্টা হয়েছিল তা নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়েছেন বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমের কলকাতা ব্যুরো চিফ রক্তিম দাশ।

সময়টা ১৯৪৭, কলকাতা জুড়ে চলছে ভয়াবহ দাঙ্গা। ভারতের স্বাধীনতা আসন্ন। খণ্ডিত স্বাধীনতা স্বীকার না করে কমিউনিস্ট পার্টি মিছিলে স্লোগান উঠছে, “ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়। ” কিন্তু সেদিনে সেই মিছিলে তিনি নেই। এক কঠিন মারণ রোগ তার জীবনী শক্তিকে ধীরে ধীরে ক্ষয়িষ্ণু করছে।

১০৯ লাউডন স্ট্রিট কলকাতা, কমিউনিস্ট পার্টির হাসপাতাল রেড কিওর হোম (বর্তমানে এখানে আছে একটি পেট্রল প্যাম্প)। অসুস্থ সুকান্তকে ভর্তি করা হলো। এখানে কিছুদিন থাকার পর কবি বাড়ি ফিরে গেলেন। অসুখ ক্রমে জটিল আকার ধারণ করলে ১৯৪৭ সালে এপ্রিল মাসের ১/২ তারিখ তাকে যাদবপুর যক্ষা হাসপাতালে ভর্তি করা হলো।

কিন্তু বড় দেরি হয়ে গেছে, দিন-রাত পরিশ্রম আর বিশ্রামের অভাব, সঠিক সময়ে খাদ্য গ্রহণ না করার জন্য যক্ষার জীবাণু ততদিনে বুক থেকে তার পেটে সংক্রামিত হয়েছে।

১৯৪৭ সালের ১৩ মে (২৯ বৈশাখ) মঙ্গলবার সকালবেলা পৃথিবী থেকে চির বিদায় নিলেন কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য।

দীর্ঘ ৬৫ বছর পর এই শহরে অনেক উত্থান পতনের মধ্যেও আশা করেছিলাম কবির স্মৃতি চিহ্নগুলো হয়ত পাওয়া যাবে। আমার বাড়ির সামনেই যাদবপুর যক্ষা হাসপাতাল কোনো রকমে তার অস্তিত্ব টিকেয়ে রেখে আজও আছে। সেখান থেকেই আমার এই প্রতিবেদনের শুরু।

২০০৭ সাল পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী কবির ভাইপো বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তার সরকারের সঙ্গে চুক্তি করে পশ্চিমবাংলার রূপকার ডা. বিধানচন্দ্র রায় ও ডা. কিরণশঙ্কর রায়ের তৈরি কবি সুকান্তের স্মৃতি বিজড়িত সরকারি যাদবপুর যক্ষা হাসপাতালকে তুলে দেওয়া হলো কেপিসি নামে একটি বেসরকারি সংস্থার হাতে। এথানে তারা গড়ে তুলবেন রাজের প্রথম বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।

কাকা সুকান্তের স্মৃতি, অঞ্চলের মানুষের প্রতিবাদ কোনোটাই গ্রাহ্য করেননি বুদ্ধদেব। যাদবপুর যক্ষা হাসপাতালের সবটাই গ্রাস করে নিল কেপিসি হাসপাতালের নামে ভূমিদস্যুরা। তারা ভেঙে ফেলল সুকান্তের নামঙ্কিত লাইব্রেরি। সরানো হলো কবি মূর্তির সৌন্দয্য বাড়ানোর নামে।

এখন ৬ খানা বিল্ডিং নিয়ে কোনো রকমে টিকে আছে যাদবপুর যক্ষা হাসপাতাল কেপিসি হাসপাতালে মধ্যে। কবি সুকান্ত ভর্তি হন প্রথমে যে ওর্য়াডটিতে তাকে ভেঙে বানানো হয়েছে লন্ড্রি।

কেপিসি বড় বড় বিল্ডিংয়ের ভেতর দিয়ে অবশেষে খুঁজে পেলাম কবির প্রয়াণ কক্ষটি। এর নাম ছিল আগে এলএমএইচ ওর্য়াড। দোতলা ভগ্নপ্রায় এই ভবনটি এখন কেপিসির নার্সদের হস্টেল। নিরাপত্তা রক্ষী পথ আটকালো। মেয়েদের হস্টেল বলে কথা। প্রয়োজনীয় অনুমতি মেলার পর ভেতরে ঢুকলাম। ডানদিকের বারান্দার শেষ কক্ষ। দরজা বন্ধ।

ডানদিকে ময়লা চাদর ঢাকা বালিশ দেওয়া একটি বেড। হলুদ রঙচটা দেওয়াল, বেডে পরম সুখে শুয়ে থাকা একটি বেড়াল কিছুটা বিরক্ত হয়ে আমার দিকে তাকাল। কক্ষটির ভেতরে একটা স্যাঁতসেঁতে গন্ধ। ওপরে দেওয়াল থেকে পলেস্তরা খসে পড়ছে মেঝেতে। বেডের ওপরে কবির হাস্যমুখের ছবি যেন আমাকে উপহাস করছে। অনেকদিনের শুকনো মালায় মাকড়সার জাল। একটি কাঠের চেয়ার। এই তার শেষ দিনগুলোর স্মৃতি, যা আর কয়েকদিন পর হয়তো থাকবে না।

“কী দেখছেন?” পিনপতন নীরবতার মধ্যে কে যেন আমায় ডাকলো। তাকিয়ে দেখি, একজন প্রবীণ লোক। পরিচয় দিলেন, হরিশ কর্মকার। এই হাসপাতালের সবচেয়ে প্রবীণ কর্মী। অবসর নিয়েছেন। কবিকে কাছ থেকে দেখেছেন।

তিনি বললেন, “সবসময় কাগজ কলম নিয়ে লিখতেন। তখন জানতুম না উনি এতবড় কবি। খুব ভালো ব্যবহার করতেন আমাদের সঙ্গে। রোগা পাতলা চেহারা, উজ্জ্বল দুটি চোখ। প্রথমে এনএইচ ওর্য়াডে ভর্তি হন। পেন বেডে তখন ভাড়া ছিল ১৪ টাকা, পাঁচ টাকা ইলেকট্রিক চার্জ, সারভেন্ট ১০ টাকা। উনার ওই ওর্য়াডে থাকতে অসুবিধা হচ্ছিল বলে লেডি হার্বাড ওর্য়াডের এক নম্বর রুমে নিয়ে আসা হয়। ওখানেই প্রয়াত হন। ”

তিনি আরও বলেন, “খুব কষ্ট পাচ্ছিলেন। তখন টিবির চিকিৎসা সেরকম ছিল না। ভয়ে তার কাছে বাইরের কেউ আসতো না। সেই সময় সুপার ডা. নরেন সেন খুব চেষ্টা করেছিলেন। এক মঙ্গলবার সকালে কাশির সঙ্গে রক্ত উঠে মারা গেলেন। আমরা সবাই খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। কারণ উনি ছিলেন হাসপাতালে সবচেয়ে কমবয়েসী রোগী। ”

যাদবপুর যক্ষা হাসপাতালের বর্তমান সুপার ডা. বিনয় কুমার প্রধান বাংলানিউজকে আক্ষেপ করে বললেন, “কিছুই রক্ষা করতে পারলাম না। আমার হাসপাতালই তো অবৈধ। প্রতিদিন একটু একটু করে ওরা (কেপিসি) আমাদের গ্রাস করছে। এর জন্য দায়ী তো আগের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তিনি তো তার কাকার স্মৃতি রক্ষা করলেন না। আমি চেষ্টা করে মুর্তিটা সরিয়ে এনেছি। আর বই গুলো যা ছিল, ওরা দয়া করে একটা ছোট লাইব্রেরি বানিয়ে দিয়েছে তাতে আছে। ”

বিগত বাম আমলে কিছু হয়নি তা ঠিক নয়, হয়েছে কবির নামে বেলেঘাটায় সুকান্ত সরণি, সুকান্ত মঞ্চ, সুকান্ত সেতু আর গোটা কয়েক মূর্তি কলকাতা শহরে।

বাংলাদেশ সময়: ১০২৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০২, ২০১২
আরডি/সম্পাদনা: রানা রায়হান, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।