ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

দিল্লি, কলকাতা, আগরতলা

পশ্চিমবঙ্গে লোকসভা ভোটে তারকা চমক

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২১ ঘণ্টা, মার্চ ১৫, ২০১৪
পশ্চিমবঙ্গে লোকসভা ভোটে তারকা চমক

কলকাতাঃ ভারতের লোকসভা নির্বাচনে প্রায় সব রাজনৈতিক দলই তাদের প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করেছে। অবশ্য কোন দলের কিছু লোকসভা কেন্দ্রে প্রার্থী ঘোষণা বাকি থাকলেও আগামী কয়েক দিনের মধ্যে তাও সম্পূর্ণ হয়ে যাবে।



পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে এই নির্বাচনে প্রার্থী তলিকা একটি বিশেষ কারণে চর্চার মধ্যে উঠে এসেছে। সেই বিশেষ কারণটি হোল প্রার্থী তালিকায় তারকা চমক। সৌজন্যে রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস(টিএমসি) এবং ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)।

এই দুই দলের হয়ে প্রথম রাজনীতিতে পা রেখেই লোকসভা নির্বাচনে প্রতিদন্দ্বিতা করছেন টলিউডের নায়ক দেব, অভিনেত্রী মুনমুন সেন, অভিনেত্রী সন্ধ্যা রায়, গায়ক ইন্দ্রনীল সেন, জাদুকর পি সি সরকার, ভূমি ব্যান্ডের সৌমিত্র রায়, অভিনেতা জর্জ বেকার, নাট্যকার অর্পিতা ঘোষসহ বেশ কিছু তারকা।

তবে ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে তারকাদের নির্বাচনে লড়াই করাটা নতুন নয়। এর আগে নির্বাচনে লড়াই করেছিলেন অমিতাভ এবং জয়া বচ্চন। এছাড়াও দীর্ঘ তালিকায় আছেন শাবানা আজমি, ধর্মেন্দ্র, গোবিন্দ, জয়াপ্রদা, সঞ্জয় দত্ত, বিনোদ খান্না, শত্রুঘ্ন সিনহা প্রমুখ।

শুধু টলিউড বা বলিউড নয় হলিউডের আর্নল্ড সোয়ারজিনেকার, অস্কার বিজয়ী চিত্র পরিচালক  কিল্ট এস্টউডসহ বেশ কিছু পরিচালক, অভিনেতা- অভিনেত্রীর নাম করা যায় যারা চলচিত্ত থেকে সরাসরি নির্বাচনের ময়দানে হাজির হয়েছেন।

এই তারকা খচিত প্রার্থীদের ঘোষণা হবার  পরেই কলকাতার বিভিন্ন আড্ডায় একটা বহু পুরানো কিন্তু আজও অমীমাংসিত একটি বিতর্ক মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে।   আর সেই বিতর্কের মীমাংসা খুঁজতেই বাংলানিউজ২৪ তরফে কলকাতার বিভিন্ন আড্ডায় কিছু পরিচিত কিছু অপরিচিত মুখের মুখোমুখি হলাম। কান পাতলাম চলতি ট্রাম, বাস, মেট্রোতে, পথ চলতি মানুষের ভিড়ে।

শহর কলকাতার অবস্থানের নিরিখে চারটি লোকসভা কেন্দ্র খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উত্তর কলকাতা, দক্ষিণ কলকাতা, দমদম এবং যাদবপুর। সবকটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দলই এই কেন্দ্র গুলিতে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। কিন্তু লক্ষ্যণীয় বিষয় এটাই- কলকাতার এই চারটি কেন্দ্রেই সবকটি দল প্রার্থী করেছে অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদদের। এখানে জায়গা পাননি কোন অভিনেতা-অভিনেত্রী বা অন্য ক্ষেত্রের কোন তারকা প্রার্থী।

কলকাতার রাজনৈতিক ইতিহাসে কোনদিনই কলকাতার লোকসভার ভোটারদের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়েনি কোন তারকা। যদিও কলকাতার বিধান সভা ভোটে কিছু তারকাকে বিভিন্ন দলের হয়ে নির্বাচনে লড়াই করতে দেখা গেছে।

সদ্য রাজ্যসভায় গেছেন মিঠুন চক্রবর্তী। তবে রাজ্যের বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু নিজেই একজন প্রখ্যাত অভিনেতা। যদিও তার পূর্বের যথেষ্ট রাজনৈতিক যোগাযোগের ইতিহাস আছে।

রাজনীতিতে যদি অন্য পেশার মানুষদের আসা নিয়ে প্রশ্ন না ওঠে তবে অভিনেতা অভিনেত্রীদের আসা নিয়ে কি সমস্যা থাকতে পারে। উত্তর দিলেন দমদমের এক প্রবীণ নাগরিক। তিনি জানালেন পেশাগত কারণে কোন আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু একজন লোকসভার সদস্যের তার নিজের এলাকা নিয়ে খুঁটিনাটি সমস্ত জ্ঞান থাকাটা দরকার।

এছাড়াও দেশের আইন, সংবিধান সামাজিক পরিস্থিতি এবং অর্থনীতি নিয়ে একটা সম্যক ধারনা থাকা দরকার। সেটা না থাকলে তার নির্বাচক মণ্ডলীর আশা পূরণ হয় না।

সমস্যাটাকে একটু অন্যভাবে বলেন উত্তর কলকাতার এক কলেজ ছাত্রী। তার বক্তব্য ভারত একটি উন্নয়নশীল দেশ। এই দেশের বিপুল জনসংখ্যার সমস্যা জানতে হলে তাদের সঙ্গে মিশতে হবে। কিন্তু এই তারকাদের সেই সময় বা সুযোগ কোথায়। তাই প্রশ্নটা যখন নাগরিকদের উন্নতির তখন এমন কোন মানুষকে নির্বাচিত করা উচিৎ- যিনি এই বিরাট অংশের মানুষদের দুঃখ-দুর্দশার কথা জানেন।

আমারা বসেছিলাম উওর কলকাতা মনিন্দ্র নাথ কলেজের সামনের একটি চায়ের দোকানে। পাশে বসা আপর এক ছাত্রী এই বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করল। নায়ক দেব-এর দারুণ ফ্যান এই ছাত্রীটি জানাল- তার বাড়ি কলকাতায় হওয়ায় সে খুব দুঃখিত । মেদিনীপুরের ঘাটালে হলে সে অবশ্যই দেবকে ভোট দিত।

দক্ষিণ কলকাতার এক আড্ডায় জানতে চাইলাম। কলকাতার ভোটাররা কেন পায়না এই তারকাদের? আড্ডায় হাজির রাষ্ট্র বিজ্ঞানের এক ছাত্র ব্যাখ্যা করলেন তার মত করে।

হুবহু সেটাই তুলে ধরা হল- হিসাব করলে দেখা যাবে কমবেশি পশ্চিমবঙ্গের আটটি মফস্বল বা শহরতলিতে তারকা প্রার্থীকে ভোটের ময়দানে নামানো হয়েছে। এর মধ্যে ঘাটাল, মালদা, মেদিনীপুর, কলকাতার পাশে বারাসাত, বহরমপুর, বালুরঘাট, হাওড়া অন্যতম।

হয়তো প্রথম সারির রাজনৈতিক দল গুলি মনে করে কলকাতার মানুষের মনে এই ধরনের নায়ক, গায়ক বা জাদুকরদের দেখে প্রশ্ন জাগতে পারে, তাদের ভোট দেব কেন? এরা আমার সমস্যা গুলিকে সমাধান করতে আদৌ কি সক্ষম হবে? আর এই মনস্তত্ত্বের আঁচ পেয়েই বোধ হয় প্রথম সারির রাজনৈতিক দল গুলি তারকাদের কলকাতায় প্রার্থী করে না। বিশেষ করে লোকসভা নির্বাচনে।

কথাটার সমর্থন পাওয়া গেল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিনেও। প্রশ্ন উঠল কোন কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ হয়ে ভোট দেব চোখে রঙ্গিন চশমা, গালে বিদেশি মেকআপ, আর মুখে সুপার হিট চলচিত্তের ডায়লগ আর ‘আমি রাজনীতির মানুষ নই, তাই রাজনীতি নয় মানুষের কাজ করতে চাই’ মার্কা হাসি-হসি মুখের বক্তব্য শুনে।  

এই তারকারা কতটা জানে নাগরিক পরিসেবা, শিল্পোন্নয়ন, বেকারিত্ত বা পরিকাঠামোর উন্নয়নের জন্য কি কি করা দরকার তার বিষয়ে।

ফুটকেটে এক ছাত্র বললেন, উন্নত চেতনা সম্পন্ন রাজনীতি, মানসিকতা এই সবের দোহাই দিয়ে কলকাতাতে  দুঁদে রাজনীতিবিদদের আর যখন সময় আসে মনোরঞ্জনের তখন মফস্বল! এটা মোটেই ঠিক নয়। তার মুখে ফিচেল হাসি। তবে কি শহর আর মফস্বলের মনন, রাজনৈতিক চেতনার ফারাক আছে ভেবেই দল গুলির এই পরিকল্পনা। নাকি প্রশ্নটা নীতিগত!

সিপিএম-এর রাজ্য সদর দপ্তরে প্রার্থী পদ ঘোষণার পরেই বাংলানিউজ২৪-এর তরফে বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসুকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনাদের তালিকায় কোন তারকা নেই কেন? তিনি জানিয়েছিলেন যারা দীর্ঘ দিন ধরে রাজনীতিতে আছেন এবং মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছেন তাদেরকেই প্রার্থী করা হয়েছে।

একই প্রশ্ন করা হয়েছিল কংগ্রেস নেতা রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরীকে- তিনি উত্তর দিয়েছেন কিছুটা আক্রমণাত্মক ভঙ্গীতে। তিনি সরাসরি বলেন, মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী নিজেই একজন তারকা। বিগত আড়াই বছরে তিনি অনেক নাটক করেছেন, সেটা শুধু পশ্চিমবঙ্গের মানুষ নয় বাংলাদেশের মানুষও জানেন। তাই তিনি তারকাদের এত বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।

তবে কি ভুল করলেন এই সব রাজনৈতিক দলের নেতা নেত্রীরা। না বিষয়টা একদমই সেই রকম নয়।

তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হাতের তালুর মতন চেনেন পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল স্তরের মানুষকে। তিনি বোঝেন তাদের আবেগ, তাদের চিন্তা, চেতনাকে। তিনি জানেন এই অভিনেতা-অভিনেত্রীদের টানেই মফস্বলে হাজার হাজার লোক ভিড় জমায় যাত্রা দেখতে। কিন্তু শত চেষ্টা করলেও কলকাতায় এদের করিশমায় অর্ধেক ব্রিগেডও ভরবে না। তাই ভোটে জেতার লক্ষে তিনি মোক্ষম চালটি দিয়েছেন।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বিজেপি নেতৃত্ব জানেন তার দলের একনিষ্ঠ ভোটার ছাড়াও বেশ কিছু বাড়তি ভোট টেনে আনবে এই তারকারা। আর ভোটে জেতার পরে এদের বকলমে কাজ করবে রাজনৈতিক নেতারা আর দল।

এমনটাই কলকাতার অদূরে রায়দিঘি অঞ্চলের এক জনসভায় জানিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সঙ্গে ছিলেন টলিউডের নায়িকা তথা পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার সদস্য দেবশ্রী রায়। যিনি ঐ এলাকা থেকে বিধান সভায় নির্বাচিত হয়েছেন।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেখানে দেবশ্রী রায়কে দলের ‘অতিথি’ বলে সম্বোধন করেছেন। আসলে ভোটের মুখ বা অভিমুখ যে শুধুমাত্র “দিদি” এটা ভালো জানেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী।  

ঠিক তেমনটাই জানে বিজেপি । তারা ভোটারদের কাছে হাজির করছে সেই একটাই মুখ “নরেন্দ্র মোদি”। আর সেই সুযোগেই কলকাতার অদূরে বারাসাত লোকসভা কেন্দ্রের ভোটাররা পেলেন বিশ্ব বিখ্যাত জাদুকর প্রার্থীকে।

কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারেন কলকাতার বালিগঞ্জ প্লেসের বাড়ি থেকে মহানায়িকা সুচিত্রা নন্দিনী মুনমুন সেন ১৭৩ কিলোমিটার দূরে বাঁকুড়াতে বা বালিগঞ্জের ‘ইন্দ্রজাল’র মালিক বারাসাতে নিয়মিত হাজির হবেন কি?

তার উত্তর দিতে পারবে ভবিষ্যৎ তবে একথা ঠিক সে বারাসাত হোক বা বাঁকুড়া কিংবা ঘাটাল অথবা মালদহের মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে কবে থেকে প্রচারে আসবেন তারকা প্রার্থীরা। কারণ তারা জানেন ভোট মিটে গেলে ব্যস্ত তারকারা হয়তো বেশি সময় দিতে পারবেন না।

বাংলাদেশ সময়: ১৬১৬  ঘণ্টা, মার্চ ১৫, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।