ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

দিল্লি, কলকাতা, আগরতলা

সাজ সাজ রব কলকাতার কুমারটুলি প্রতিমাপাড়ায়

ভাস্কর সরদার, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৫৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৬, ২০১৪
সাজ সাজ রব কলকাতার কুমারটুলি প্রতিমাপাড়ায় ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

কলকাতা: জানেন যেদিন সারা শহরে আলো জ্বলে ওঠে, ঘরে ঘরে আনন্দের বার্তা, যখন শারদ উৎসবে বাড়িতে কন্যার আগমনে আকাশে বাতাসে বাজে আগমনীর সুর তখন বড় ফাঁকা লাগে। হু হু করে ওঠে বুকটা।

দীর্ঘ ছয় মাস ধরে তিলে তিলে গড়ে তোলা হিমালয় কন্যা উমা ঘর ফাঁকা করে বিদায় নেয় কুমারটুলি থেকে।

স্টুডিওর বাইরে একটা মাদুরের উপর বসে জানালেন কলকাতার  কুমারটুলির এক অশীতিপর মৃৎ শিল্পী।

সামনে পূজো। তাই বিশেষ পরিকল্পনা নিযে রওনা দিয়েছিল‍াম পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে বড় মৃৎ শিল্পীদের পাড়ায়। কলকাতার কুমারটুলিতে। সেখানে গিয়েই শারদ উৎসবের একদম অন্য একটি দিক দেখা গেলো।

দুর্গা পূজা আসতে আর এক মাসও বাকি নেই। কলকাতায় মাঝে মধ্যে বৃষ্টি হলেও আকাশে দেখা যাচ্ছে শিমুলতুলা শারদ মেঘ। সেই মেঘ পিয়নের ঝোলার খবর- শারদ উৎসব হাজির বাঙালির ঘরে।

যারা মফঃস্বল কিংবা গ্রামে থাকেন তারা এতদিনে দেখে নিয়েছেন কাশফুলের ঢেউ। শহুরে মানুষের সীমানা এখনো আকাশ।

শারদ উৎসবের মূল বিষয় যে দুর্গা প্রতিমা তার বেশ বড় একটি অংশ তৈরি হয় কলকাতার কুমারটুলিতে। বৈশাখ মাস থেকেই কাঠের পাটাতনের উপর বাঁশের কাঠামো বানানো হয়। তারপর খড় দিয়ে বেঁধে তাকে দেওয়া হয় প্রতিমার আদল। সবশেষে পড়ে মাটির প্রলেপ।

বৈশাখে মূর্তি তৈরি শুরু করেন পশ্চিমবঙ্গের শিল্পীরা। বাংলাদেশ থেকে স্বাধীনতার আগে বা পরে কলকাতায় এসেছেন এমন পরিবারের শিল্পীরা কাজ শুরু করেন ফাল্গুন মাসেই। এটাই চিরাচরিত প্রথা।

কুমারটুলির প্রায় প্রতিটি গলির মধ্যেই দু’একটি করে ‘স্টুডিও’। স্টুডিও বলতে যে ছবিটা চট করে আমাদের চোখে ভেসে ওঠে, তার সঙ্গে মেলালে ভুল করবেন। সরু গলির ভিতর টিন অথবা প্লাস্টিকের ছাউনি দিয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে একের পর এক মূর্তি। সামনে রাখা কাদার তাল। সেই কাদার তাল দিয়েই তৈরি হচ্ছে দুর্গা প্রতিমা। রোদে শুকিয়ে, আগুনে পুড়িয়ে তাকে সম্পূর্ণ করার দিকে নিয়ে যাচ্ছেন শিল্পীরা।

বৃষ্টির জন্য কিছুটা সমস্যা হলেও, কাজ থেমে নেই। দরকার মতো গ্যাস বার্নার  জ্বালিয়ে মূর্তি শুকিয়ে নিচ্ছেন শিল্পীরা।

বাজার কেমন? প্রশ্ন করতেই বেশ কিছুটা ঝাঁঝের সঙ্গেই উত্তর দিলেন এক তরুণ মৃৎ শিল্পী। তার বক্তব্য, পূজার সব অংশে প্রচুর খরচ করলেও মূর্তি কেনার সময় পূজা কমিটিগুলির কর্তারা ব্যাপক দরদাম করেন।

প্রতিমার গায়ে মাটি লেপতে লেপতে আপর এক শিল্পী জানালেন, পশ্চিমবঙ্গের সারদা কেলেঙ্কারির ছায়া পড়েছে শারদ উৎসবের বাজেটে। বিগত তিন চার বছরে চিটফান্ডের বাড়বাড়ন্তে পূজার জৌলুস অনেকখানি বেড়েছিল। এই চিটফান্ডগুলি বর্তমান বাজারে নেই, তাই বিজ্ঞাপনের পালে ভাটা। আর সেই ভাটার টান পড়েছে কুমারটুলির অর্থনীতিতেও।

যে অসুর দলনী দেবী দুর্গার বিরাট মাপের প্রতিমা গুলি আমারা দেখতে পাই, কীভাবে রূপ পায় সেগুলি। মূর্তি গড়ার ধাপগুলি নিয়ে কথা হচ্ছিল প্রবীণ শিল্পী তপন পালের সঙ্গে। তিনি জানালেন, প্রথমে নিচের কাঠের তক্তা দিয়ে কাজ শুরু হয়। তারপরের অংশটিকে বলে ‘খিলোন’ করা। এই অংশে বাঁশ আর খড় দিয়ে কাঠামোর রূপ দেওয়া হয়। তারপর তার উপর দেওয়া হয় মাটির প্রলেপ।

এই মাটির সঙ্গে মেশান থাকে ধানের তুষ। এই তুষ মেশানো মাটির প্রলেপকে কুমারটুলির ভাষায় বলে ‘একমেটে’। ‘একমেটে’–এর পর গঙ্গার পলিমাটি দিয়ে হয় পরের প্রলেপ। এই প্রলেপকে বলে ‘দোমেটে”।

‘দোমেটে’ করার আগেই বানিয়ে নেওয়া হয় প্রতিমার মুখ। একে একে আলাদা করে বানানো হয় প্রতিমার হাত ও পায়ের পাতা। সেগুলি লাগিয়ে দেওয়া হয় মূর্তির সঙ্গে। তারপর সুতি কাপড় কাদায় ভিজিয়ে প্রতিমার ফাটলগুলি সারিয়ে ফেলা হয়। এরপর তার উপর খড়ি দিয়ে সাদা রং করা হয়। তারপর করা হয় প্রতিমার রং। সবশেষে চোখ আঁকেন শিল্পী। তবে যত সহজে লিখে ফেলা গেল কাজটি মোটেই তত সহজ নয়।

এক স্টুডিওর সামনের ছোট্ট উঠানে বসে কথা বলতে বলতে আমাদের পশে এসে দাঁড়িয়েছেন বছর ৪০-এর এক সুঠাম চেহারার পুরুষ। নিঁখুত করে দাঁড়ি কামানো মুখে একখানা পাটের মোটা গোঁফ বসিয়ে দিলে সহজেই মাটির অসুরদের চেহারার সাথে পাল্লা দিতে পারেন।

ইনি কুমারটুলির কুলিদের সর্দার। যাদের কুমারটুলিতে পূজা শুরুর ঠিক আগে হাজির থাকার অভিজ্ঞতা আছে তারা জানেন কীভাবে রাস্তার একধারে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকে লরি।

কুমারটুলির প্রতিমাশিল্পী সমিতির অফিস থেকে এক নাগাড়ে ঘোষণা চলতে থাকে অমুক পূজা সমিতি তার লরি নিয়ে এগিয়ে আসুন, তমুক কুলি সর্দার এত নম্বর গাড়িতে প্রতিমা তোলার জন্য চলে আসুন ইত্যাদি। পুলিশ, পূজা কমিটির কর্মকর্তার ভিড়, কুলিদের চিৎকার, গাড়ির চালকদের হাঁক ডাকে এক বিচিত্র পরিবেশ সৃষ্টি হয় কুমারটুলিতে। তবে ষষ্ঠীর পর ধূ ধূ ফাঁকা হয়ে যায় এই পাড়ার সব কটি গলি।

সেই গলি ধরেই কিছুটা এগোলাম। জমা মাটির তালের সামনে বসে পুতুল বানাচ্ছিল একটি ছোট্ট মেয়ে। পাশে তার বাবা দ্রুত হাতে প্রতিমার গায়ে মাটির প্রলেপ দিচ্ছিলেন। তাকে প্রশ্ন করলাম, মন খারাপ লাগে না যখন ফাঁকা হয়ে যায় কুমারটুলি। একবারের জন্য মুখ তুলে তাকালেন। কাঁচাপাকা না কামান মুখে খেলে গেল এক টুকরো নিরুত্তাপ সৌজন্যের হাসি। কাজ করতে করতেই বললেন, আগে লাগত জানেন, খুব মন খারাপ লাগত। তবে এখন আর লাগে না। এটাই তো আমাদের ব্যবসা। শুরু গলি মাথায় প্লাস্টিকের ছাউনি, ভিতরে অন্ধকার। সেই অন্ধকারেই যেন মিলেইয়ে গেল সেই হাসিটুকুও।

কথায় কথায় উঠে এলো, পরের প্রজন্মের অনেকেই চলে যাচ্ছেন অন্য পেশায়। আবার কেউ কেউ বাবা-পিতামহের ব্যবসা আঁকড়ে পড়ে থাকছেন। থিমের পূজায় যারা প্রতিমা বানান তারা কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে এই কাজে আসেন। তারা শিল্পীর মর্যাদা পান, কিন্তু কুমারটুলির প্রতিমার কারিগররা সেই মর্যাদা পান না।
কে খেয়াল রাখে মূর্তির নীচে ছোট্ট কাগজে লেখা এই শিল্পীদের নামগুলি। ভক্তদের ফুল মালার চাপে সেগুলি আর দেখাই যায় না। এই আক্ষেপটা আছে অনেকেরই।

সেই অক্ষেপ বুকে নিয়েই বছরের পর বছর ধরে প্রতিমা বানিয়ে চলেছেন ওরা। সঙ্গে আছে বাড়য়ারি পূজার উদ্যোগক্তাদের দরাদরি, ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের বোঝা, মহাজনের ধার, সাজ-সজ্জার চড়া দাম, দালালদের উৎপাত সহ আরও নানা রকম সমস্যা।

আর আছে আধুনিকতার আগ্রাসন। তবে এই সমস্ত বাঁধার সঙ্গে লড়াই করেও কুমারটুলির শিল্পীরা ধরে রেখেছেন তাদের ঐতিহ্য। আর এটাই এদের একমাত্র অহংকার।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৫৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৬, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।