তিনবিঘা করিডোর থেকেঃ পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ অংশে যখন প্রবল ঝড় এবং বৃষ্টিপাত তখন কোচবিহার জেলায় ঝকঝকে রোদ।
প্রকৃতিও যেন ছিটমহলের মানুষদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছে।
গ্রামে সংবাদ মাধ্যমের ভিড়। অচেনা অজানা লোকরা ক্যামেরা নিয়ে ছবি তুলছে।
সাংবাদিকদের মুখোমুখি হচ্ছেন প্রবীণরা, ছিট মহল হস্তান্তরের আন্দোলনের নেতারা। এই চূড়ান্ত ব্যস্ততায় বাড়ির শিশুদের দিকে বাড়ির বড়দের নজর কিছুটা কম। আগামী দিনে একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হতে চলা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ক্যামেরার লেন্সের বাইরে। তারা অবাক চোখে দেখছে বড়রা কেমন ক্যামেরার সামনে কথা বলছে ছবি তুলছে।
কোনো কোনো শিশু বড়দের পেছনে গিয়ে ক্যামেরায় মুখ দেখাতে চেষ্টা করছে। বকুনি, ধমক খেয়ে ফিরেও আসছে তারা। কতোটা তফাত একটি স্বাধীন দেশে জন্মানো শিশুর সঙ্গে একটি নাগরিকত্বহীন ছিটমহলে জন্মানো শিশুর।
কি ভাবছে এই শিশুদের মন। বড়দের কাছে যখন সাংবাদিকদের ভিড় তখন একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা একটি শিশুর কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। নতুন মানুষ দেখে কিছুটা আড়ষ্ট। একটা দুটো কথা বলে আসার পথে কেনা কয়েকটা লজেন্স ব্যাগ থেকে বার করে তার হাতে দিলাম।
মুখ তুলে তাকাল শিশুটি। আদুল গা, পরনে কালো একটি হাফ প্যান্ট। দুই কানে দুটি রুপোর দুল।
“কি নাম তোমার?” প্রশ্ন করলাম। চুপ। কোন উত্তর নেই। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে শিশুটি। অচেনা মানুষের সঙ্গে কথা বলার স্বাভাবিক জড়তার শিকার সে। একটা লজেন্সও তখন মুখে দেয়নি।
“ছবি তুলবে? আমার মোবাইলে ছবি তোলা যায়”। একটা ছবি তুলে শিশুটিকে দেখালাম। ঝুঁকে পড়ে ছবিটা দেখলো সে।
আবার প্রশ্ন করলাম “জানো আজ কেন এতো লোক এসেছে তোমার গ্রামে?”
এবার মাথাও তুলল না শিশুটি। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। একটু একটু করে আড়ষ্টতা কাটছে। কিন্তু তখনও মুখ তুলে তাকাচ্ছে না সে। ডান পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে মাটি খুঁড়ে যাচ্ছে।
আবার প্রশ্ন করলাম, “জানো তোমার গ্রামে একটা বিপ্লব হয়ে গেছে। যেটা দেখতে সারা পৃথিবী থেকে মানুষ আসছে। তুমি কি কিছু বুঝতে পারছ?”
“বিপ্লব!” প্রথম কথা বলল শিশুটি। তবে কি সে ‘বিপ্লব’ কথার অর্থ বুঝতে পেরেছে? বেশ কিছুটা অবাক লাগলো। তারপরই সে আরও অবাক করে তার ডান হাতটি তুলে কিছুটা দূরে খেলতে থাকা কয়েকটি ছোট ছেলের মধ্যে একজনের দিকে দেখিয়ে বলল
“ঐ তো বিপ্লব.......”
বিপ্লব নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা অনেক শুনেছি। সাংবাদিকরা আলোচনা করছেন, ছিটমহলের আন্দোলন কে কি বিপ্লব বলা যায়, নাকি যায় না। আলোচনা হচ্ছে, তর্কও হচ্ছে। নানাভাবে নানা জন বুঝিয়ে বলছেন তাদের যুক্তি। কিন্তু এই শিশুটির মত সহজভাবে কেউ বোঝাতে পারেনি কোনো দিন। কত সহজেই বিপ্লবকে দেখিয়ে দিলো স্বাধীন হতে চলা ছিটমহলের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। কলকাতা থেকে এক রাতের রেলযাত্রার ক্লান্তি, তারপর ভাঙ্গাচোরা রাস্তায় একাধিক বাস, টেম্পোর ধকল এক মুহূর্তে মিলিয়ে গেল।
এই বিপ্লবরাই আগামী প্রজন্মের এই অঞ্চলের মানুষদের ভালো মন্দের দায়িত্ব নিতে চলেছে। শিশুটির মাথায় হাত বোলাতে বলাতে মনে মনে বললাম, বিপ্লব, তুমি এবং তোমার মত অসংখ্য বিপ্লব, তোমারা বেঁচে থাক, তোমরা দীর্ঘজীবী হও, দীর্ঘজীবী হোক এই সুন্দর পৃথিবী, দীর্ঘজীবী হোক মানব সভ্যতা। তোমাদের হাতেই রইল আগামীর গুরুভার।
বাংলাদেশ সময়: ১২১৩ ঘণ্টা, আগস্ট ০১, ২০১৫
ভিএস/জেডএম
** বিজয় উৎসবে কম নন ভারতে যুক্ত হওয়া ছিটবাসীরাও
** আনন্দাশ্রুতে সিক্ত ছিটমহলের মাটি
** গোতামারীতে লাল-সবুজের পতাকা
** বিজয় উৎসবে কম নন ভারতে যুক্ত হওয়া ছিটবাসীরাও
** বাংলাদেশে যুক্ত হওয়া ৩৬ ভূখণ্ডে একযোগে পতাকা উড়লো
** অবসান হলো বঞ্চনার
** অন্ধকার থেকে মঙ্গল আলোয়