কলকাতা: তৃণমূলের সরকার যে ভাবে চলছে তা সংসদীয় রাজনীতিতে ভয়ঙ্কর বিপদের সূচনা বলে মনে করছে সিপিএম। বুধবার থেকে শুরু হওয়া সিপিআইএম’র রাজ্য সম্মেলনের সাংগঠনিক প্রতিবেদনে এ মন্তব্য করা হয়েছে।
এ সাংগঠনিক প্রতিবেদন পেশের আগে উদ্বোধনী অধিবেশনের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গে ২৩তম রাজ্য সম্মেলনের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করেছে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি মার্কসবাদী (সিপিএম)। বুধবার স্থানীয় সময় সকাল এগারোটায় শুরু হয়েছে ৫ দিনের এ রাজ্য সম্মেলনের কর্মসূচি। অধিবেশনের শুরুতে সম্মেলনের উদ্বোধন করেন পার্টির সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাত। এছাড়াও সম্মেলনে উপস্থিত রয়েছেন পার্টি’র পলিটব্যুরো সদস্য সীতারাম ইয়েচুরি, বৃন্দা কারাত, এস আর পিল্লাই, কে বরদারাজন প্রমুখ।
প্রায় সাড়ে তিন দশক পর ফের রাজ্যে বিরোধী আসনে সিপিএম। এ পরিস্থিতিতে সরকার বিরোধী আন্দোলনের দিশা কী হবে তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে সিপিএমের রাজ্য সম্মেলনের সাংগঠনিক প্রতিবেদনে।
একই সঙ্গে কর্মীদের সতর্ক করে বলা হয়েছে, বিরোধী দল হিসেবে তৃণমূল কংগ্রেস যে ভূমিকা নিয়েছিল তাকে অনুসরন করার ঝোঁক থেকে সতর্ক থাকতে হবে।
সেই সঙ্গে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, আত্মসমালোচনার নামে বামফ্রন্ট বিরোধী সমালোচনার ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের সঙ্গে সুর মিলিয়ে ফেলছেন কিছু সদস্য। এই প্রবণতাকে এড়িয়ে চলার কথা বলা হয়েছে ওই রিপোর্টে। বিরোধী দলের ভূমিকা কী হবে সে প্রসঙ্গে রিপোর্টে বলা হয়েছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বিরোধী হিসেবে বামেদের কাছে কী চাইছে, সেটাই মূল মাপকাঠি হওয়া বাঞ্ছনীয়।
কেন্দ্রে এবং রাজ্যে কংগ্রেস এবং তৃণমূল জোট গড়ে সরকার চালাচ্ছে। কিন্তু দু’দলের মধ্যে সম্পর্কের ফাটলও অনেকটাই প্রকাশ্যে। সিপিএমের রাজ্য সম্মেলনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে সেই প্রসঙ্গও। সিপিএম’র মতে, ভোটের আগে এই জোট মানুষের বিশ্বাসযোগ্যতা পেলেও এখন টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। তবে এই পরিস্থিতি সম্পর্কে পার্টি সদস্যদের সতর্ক করা হয়েছে রিপোর্টে।
বলা হয়েছে, নিজেদের সাংগঠনিক শক্তি না বাড়ালে পরিস্থিতি আপনা আপনি বামেদের অনূকুলে আসবে একথা মনে করা আত্মহত্যার সামিল। সাধারণ মানুষের ক্ষোভ-বিক্ষোভকে হাতিয়ার করে আন্দোলনে মধ্য দিয়েই পরিস্থিতি নিজেদের অনূকুলে আনতে হবে বলে মনে করছে সিপিএম। এমনকি বেশি মানুষকে সামিল করার স্বার্থে প্রয়োজনে দলীয় পতাকা দূরে সরিয়ে রেখে সাধারণ কর্মসূচি নেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে রিপোর্টে। সামনেই রাজ্যে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচন। সিপিএম নেতৃত্ব মনে করছে, নতুন গাইডলাইন কতোটা কার্যকর হবে তার ওপরই নির্ভর করবে পঞ্চায়েত ভোটে বামেদের ফলাফল।
প্রয়াত জ্যোতি বসুর স্মরণে এবার সম্মেলনস্থলের নাম রাখা হয়েছে কমরেড জ্যোতি বসু নগর। আর প্রয়াত হরকিষান সিং সুরজিতের স্মরণে সম্মেলন মঞ্চের নাম রাখা হয়েছে কমরেড হরকিষান সিং সুরজিত মঞ্চ। আর এ সম্মেলনকে কেন্দ্র করে লাল পতাকায় সেজে উঠেছে কমরেড জ্যোতি বসু নগর আর কমরেড হরকিষান সিং মঞ্চ।
কলকাতার প্রমোদ দাশগুপ্ত ভবনের অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এ সম্মেলন। আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রোডের এই অঞ্চল তাই লাল পতাকা-তোরণে সেজে উঠেছে। রাস্তার ডিভাইডারে উড়ছে লাল পতাকা। রাস্তার ধারে প্রয়াত নেতাদের ছবি।
কমরেড বিনয় চৌধুরী এবং কমরেড সরোজ মুখার্জির জন্মশতবর্ষ ছিলো এ বছর। তাদের স্মরণে তোরণ সাজানো হয়েছে এখানে। পাশেই রয়েছে কমরেড প্রমোদ দাশগুপ্তের স্মরণে তোরণ। এইভাবেই সম্মেলনে শ্রদ্ধায় স্মরণ করা হচ্ছে প্রয়াত নেতৃবৃন্দকে।
প্রমোদ দাশগুপ্ত ভবনে ঢোকার গেট সাজানো হয়েছে বিশাল তোরণ দিয়ে। সেখানে পার্টির প্রতীকের সঙ্গে রয়েছে কমরেড জ্যোতি বসুর ছবি।
গেট দিয়ে ঢুকে অডিটোরিয়ামে প্রবেশের পথের দু’ধারে রয়েছে প্রয়াত নেতা এম কে পান্ধে, সুভাষ চক্রবর্তী, মধু বাগ, শান্তিময় ভট্টাচার্য, প্রমুখের ছবি সহ বেদী। আরেকটু এগোনোর পরে শহীদ বেদী। এখানেই পার্টি’র পতাকা উত্তোলনের পর বুধবার সকালে মাল্যদান করে শ্রদ্ধা জানান নেতারা।
সকাল এগারোটায় রাজ্য সম্মেলনস্থলে যখন পতাকা উত্তোলন করা হয়, ঠিক তখনই কলকাতার সব পার্টি দপ্তরে পতাকা উত্তোলন করা হয়।
সম্মেলন মঞ্চের সুবিশাল ব্যাকড্রপের মাঝখানে পার্টির ২৩তম রাজ্য সম্মেলনের কথা লেখা রয়েছে কাস্তে-হাতুড়ি প্রতীকের তলায়। আর দু’পাশে রয়েছে দুই কমিউনিস্ট নেতা জ্যোতি বসু ও হরকিষান সিং সুরজিতের ছবি।
পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় অতিউৎপাদনের জেরে কীভাবে অর্থনৈতিক সঙ্কট নেমে আসে তার ঘোষণা করেছিলেন কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস কমিউনিস্ট ইশতেহারে।
আজকের বিশ্ব অর্থনৈতিক সঙ্কটের পরিপ্রেক্ষিতেও যা অনিবার্যভাবে প্রাসঙ্গিক। সেই ঘোষণা বড়ো বড়ো করে টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে সম্মেলনস্থলে। রয়েছে লেনিন, স্টালিন, মাও জে দঙ, মুজফফর আহমদ প্রমুখ নেতাদের উদ্ধৃতিও।
সম্মেলনে রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে সব মিলিয়ে প্রায় আটশ’ প্রতিনিধি ও পর্যবেক্ষক অংশগ্রহণ করছেন। সম্মেলন চলবে শনিবার পর্যন্ত। তারপর রোববার রাজ্য সম্মেলনের প্রকাশ্য সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে।
এদিকে, ব্রিগেডের সমাবেশে ব্যাপক মানুষের অংশগ্রহণ ঘটাতে কলকাতার সর্বত্র সিপিএম প্রচার চালাচ্ছে। পথসভা, মিছিল ইত্যাদি হচ্ছে।
মঙ্গলবার সিপিএম’র উত্তর পূর্ব কলকাতা জোনাল কমিটির ডাকে খান্না সিনেমা হলের সামনে এরকমই একটি প্রচার সভায় পার্টির রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য শ্যামল চক্রবর্তী বলেন, সিপিএম অন্য দলের মতো কোনো নেতার একার ইচ্ছায় চলে না, এখানে পার্টি পরিচালিত হয় গণতান্ত্রিকভাবে। এ কারণেই পার্টির সম্মেলনগুলোর মাধ্যমে প্রতিনিধি ও নেতৃত্ব নির্বাচিত হয়।
বর্তমান রাজ্য সরকারের জনবিরোধী কার্যকলাপের উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকারের নীতির কারণে কৃষকরা ফসলের দাম না পেয়ে আত্মহত্যা করছেন, অনাহারে চা বাগানের শ্রমিক মারা যাচ্ছেন, আর রাজ্য সরকার উৎসব করছে। শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-পেনশন দিচ্ছে না, অথচ উৎসবের জন্য টাকা খরচ করছে।
তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে পরাজিত হলেও মানুষের স্বার্থে আমরা লড়াই করে চলেছি। মানুষের ওপরে যে আক্রমণ নামিয়ে আনা হয়েছে, তার প্রতিবাদে লড়াইয়ে আমরা মানুষের সাথী হতে চাই। সে কারণেই আমরা সর্বত্র আক্রান্ত হচ্ছি। কিন্তু আক্রান্ত হলেও মানুষের স্বার্থে লড়াই থেকে আমরা কোনোভাবেই পিছিয়ে আসবো না। এই লড়াই গড়ে তোলার জন্যই আমাদের সম্মেলনের কর্মসূচি এবং তার সমাপ্তিতে আগামী ১৯ ফেব্রুয়ারি ব্রিগেডের সমাবেশ। সেদিন কলকাতার সব রাস্তাকে ব্রিগেডমুখী করে তোলার জন্য মানুষের কাছে আমরা আবেদন করছি। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৩০৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১২