কর-জিডিপি অনুপাতে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থা নাজুক। রাজস্ব আদায়ের বড় ক্ষেত্র থাকলেও তা প্রকৃতপক্ষে আদায় হচ্ছে সামান্যই।
অন্যদিকে দেশের মালিক সাধারণ মানুষের সব ধরনের আয়ের ওপরই দিতে হয় কর। ফলে কর দিতে নিরুৎসাহিত হয়েছে সাধারণ মানুষ। এবার আয়করের সেই বৈষম্য দূর করার উদ্যোগ নিয়েছে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার।
আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে এই পরিবর্তন আনার বিষয়ে নীতিগত অনুমোদন দিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।
বাজেটবিষয়ক বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা সবুজ সংকেত দিলেই তা অন্তর্ভুক্ত হবে বাজেটে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
এনবিআরের আয়কর বিভাগ এসআরও জারি করে মেয়াদহীনভাবে প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, মন্ত্রী, ডেপুটি স্পিকার, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী এবং মন্ত্রী পদমর্যাদার উপদেষ্টা ও সংসদ সদস্যদের মূল বেতন ছাড়া প্রাপ্ত উৎসব ভাতা, সকল প্রকার ভাতা ও অন্যান্য সুবিধাকে আয়কর অব্যাহতি দিয়েছে। আরেকটি এসআরওর মাধ্যমে একই ধরনের সুবিধা দেওয়া হয়েছে প্রধান বিচারপতি, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারকদের।
এ ছাড়া আয়কর আইন ২০২৩ অনুযায়ী সরকারি কর্মকর্তাদের পেনশন, আনুতোষিক, স্বীকৃত ভবিষ্যৎ তহবিল, বার্ধক্য তহবিল, স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণকালীন প্রাপ্ত যেকোনো অর্থ, পেনশনারস সেভিংস সার্টিফিকেট থেকে গৃহীত সুদ/মুনাফা ইত্যাদি আয়করমুক্ত। তাঁরা শুধু মূল বেতন ও উৎসব ভাতা বাবদ যে অর্থ পান তার ওপর কর দিতে হয়। অন্যদিকে বেসরকারি চাকরিজীবীদের যেকোনো আয়কে আয়করের আওতার মধ্যে রাখা হয়েছে।
বৈষম্যমূলক এই নীতি থেকে এবার সরে আসতে যাচ্ছে এনবিআর। এই বিশেষ সুবিধা বাতিল করলে প্রধানমন্ত্রীকেও আয়কর দিতে হবে সাধারণ নাগরিকের আদলেই।
বর্তমানে দেশে প্রধানমন্ত্রী না থাকলেও তাঁর পদমর্যাদায় থাকা প্রধান উপদেষ্টাও বিশেষ সুবিধা পাবেন না। তাঁকেও কর দিতে হবে সাধারণ নাগরিকের মতো করেই। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. মোহাম্মদ মহিউদ্দীন বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর পদমর্যাদা এবং সুযোগ-সুবিধা পুরোটাই পেয়ে থাকেন প্রধান উপদেষ্টা। কাজেই প্রধানমন্ত্রী পদের কোনো সুবিধা রহিত করা হলে তা প্রধান উপদেষ্টার জন্যও রহিত হয়ে যাবে। ’
অন্তর্বর্তী সরকারের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে দেশের সর্বস্তরের জনগণ। তারা বলেছে, সরকার পরিচালনার দায়িত্বরত ব্যক্তিরা জনগণের সেবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁদের এবং সরকারি কর্মকর্তাদের ব্যাপক পরিসরে করছাড় নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। দীর্ঘদিন ধরেই দেশে আয়কর খাতে বিরাট বৈষম্য ছিল। সেই বৈষম্য দূর করতে বিভিন্ন সময় সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলেও কোনো লাভ হয়নি। এবার ইউনূস সরকারের এই উদ্যোগ হবে যুগান্তকারী।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘আইন যখন কার্যকর হবে, তখন সবার জন্য সমানভাবেই তা কার্যকর হবে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আলাদাভাবে সুবিধা দেওয়ার পদ্ধতি চালু করেছিল আগের সরকার। আমার মনে হয়, এসব বাতিলের উদ্যোগ নেওয়ার এটা খুব উপযুক্ত সময়। এখনকার সরকারের এমন কোনো দায় নেই। এগুলো বাতিলের প্রস্তাব খুবই যুক্তিযুক্ত এবং এমন বৈষম্যমূলক প্রক্রিয়াগুলো থাকা উচিত না। ’
ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, কর সবারই দেওয়া উচিত এবং সবার জন্য একই রকম হওয়া উচিত। বেতন-ভাতাসহ সরকারের যেকোনো খরচ হচ্ছে জনগণের টাকায়। জনগণের টাকায় বেতন-ভাতা নিয়ে আয়কর রেয়াত নেওয়া ন্যায্যতার ভিত্তিতে ঠিক নয়। রাজনৈতিক নেতৃত্ব সব সময় নিজেদের জন্য একরকম আর সাধারণ জনগণের জন্য আরেকরকম করে থাকেন। সরকারি যেকোনো নীতিমালা যখন করা হয় তখন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, সরকারে যাঁরা রয়েছেন তাঁদের জন্য একরকম; আবার সাধারণ জনগণের জন্য আরেকরকম হলে সেটা বৈষম্যমূলক বটেই। এসবের পরিবর্তন দরকার। ’
ড. সৈয়দ আমিনুল করিম বলেন, ‘এক দেশে দুই আইন থাকতেই পারে না। এটা বৈষম্যমূলক এবং এটা এখনই সংশোধন করার সময়। এসব অসংগতি দূর করতে হবে। বেসরকারি চাকরিজীবীদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের ওপর একটা কর আছে, কিন্তু সরকারি কর্মচারীদের নেই। এটাও থাকতে পারে না। দুজনই যেহেতু রাষ্ট্রের নাগরিক, সেহেতু এটা থাকতে পারে না। ’
এনবিআর বর্তমানে বিনিয়োগ, জনকল্যাণ, ক্রীড়া, উন্নয়ন প্রকল্প, জনস্বাস্থ্য, শিক্ষা, মুক্তিযুদ্ধ, সাহিত্য, রাজনৈতিক, সাংবিধানিকসহ বেশ কিছু খাতে অনেক প্রতিষ্ঠানকে এসআরও জারি করে স্থায়ীভাবে আয়কর অব্যাহতি দিয়ে রেখেছে। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কিছু ক্ষেত্রে স্থায়ী সুবিধা অব্যাহত রেখে বাকি ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া যেতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে এ সুবিধা স্থায়ীভাবে বাতিল করা প্রয়োজন। এতে রাজস্ব আদায়েও গতি ফিরবে, অন্যদিকে সমান অধিকার নিশ্চিত হবে।
জানা গেছে, সাংবিধানিক পদে থাকা দায়িত্বশীলদের ও রাজনৈতিক দলের আয়ের ওপর স্থায়ীভাবে দেওয়া আয়কর অব্যাহতি তুলে দিতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে কাজ করেছিলেন তৎকালীন আয়কর নীতি শাখার দ্বিতীয় সচিব ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তৎকালীন চেয়ারম্যানও এই প্রস্তাবে একমত ছিলেন। তবে আমলাতন্ত্র, বিচার বিভাগকে তুষ্ট রাখতে এই প্রস্তাব বাতিল করে দেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সূত্র: কালেক কণ্ঠ