ঢাকা: আবার অস্থিরতা সবজির বাজারে। সরবরাহ ভালো থাকলেও নানা অজুহাতে রাজধানীসহ দেশের বাজারগুলোতে বেড়েই চলেছে সবজির দাম।
সবজির দামের এমন লাগামহীনতায় ক্ষুব্ধ ক্রেতারা। তারা মনে করছেন, বিগত সময়ের মতো আবার সক্রিয় হয়েছে অতি মুনাফাখোর সিন্ডিকেট। তারা নানা ছুতোয় দাম বাড়িয়ে পকেটে মুনাফা পুরছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারকে কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন ক্রেতাসহ ভোক্তা সংশ্লিষ্টরা।
কারওয়ান বাজারে সবজির দরদাম
ঢাকার সবচেয়ে বড় ও ব্যস্ততম কারওয়ান বাজার। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সবজি সাধারণত এখানেই বেশি আসে। এখান থেকে পাইকারি দরে কিনে ঢাকার অন্যান্য বাজারে নিয়ে যান বিক্রেতারা।
সরেজমিনে বাজারটি ঘুরে দেখা গেছে, এখানে প্রতি কেজি করলা বিক্রি হচ্ছে ৮০-১০০ টাকায়, শসা ৮০ টাকা, ঢেঁড়স ৭০-৮০ টাকা, টমেটো ১৬০-১৮০, পটল ৮০, বরবটি ১০০, ঝিঙা ৮০, কচুর লতি ৮০-১০০, ধুন্দল ৮০, কাঁকরোল ৭০-৮০, বেগুন (গোল) ১৪০, বেগুন (লম্বা) ৮০, পেঁপে ৩০, চিচিঙ্গা ৮০ এবং কচুমুখী প্রতি কেজি ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এই বাজারে লাউ প্রতি পিস বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকায় এবং কাঁচামরিচ প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ২২০-২৪০ টাকা।
মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট
ঢাকার আরেক জমজমাট বাজার মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট। সোমবার (২৫ আগস্ট) এখানকার বাজার ঘুরে দেখা যায়, সব ধরনের শাকসবজি বিক্রি হচ্ছে বাড়তি দামে।
এই বাজারে উস্তার কেজি ১০০ টাকা, করলা ১২০, পটল ১০০, বেগুন ১৪০-১৬০, শসা ৭০, কচুরমুখী ৫০-৬০, ঢেঁড়স ৯০, ক্যাপসিকাম ৫০০, চাল কুমড়া ৬০, বরবটি ১০০, মুলা ৮০, গাজর ১২০, মিষ্টি কুমড়া ৬০, পেঁপে ৩০-৩৫, কচুর লতি ১০০, নতুন শিম ২৪০-২৫০, পাকা টমেটো ১৬০, কাঁচা মরিচ ২০০, ২০০ গ্রাম ওজনের ফুলকপি ৬০ টাকা এবং বাঁধাকপি ১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া প্রতি আঁটি পুঁই শাকের দাম রাখা হচ্ছে ৪০ টাকা।
মিরপুর ১৪ নম্বর বাজার
মিরপুর ১৪ নম্বর ব্যাটালিয়ান বউ বাজারে ঢুকতেই চোখে পড়ে সারি সারি কাঁচা সবজি। দোকানিরা পসরা সাজিয়ে বসে আছেন। অনেকেই আবার হাতে বাজারের ব্যাগ নিয়ে একে একে দোকান ঘুরছেন এবং দাম যাচাই করছেন। কাঁচা তরকারির দাম হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ার কারণে হিসাব মিলাতে কষ্ট হচ্ছে তাদের।
এখানে টমেটোর কেজি ১৮০ টাকা, বেগুন (কালো) ২০০, বেগুন (সাদা) ১৪০, বেগুন (গোল) ১০০, পেঁপে ৩০, শিম ৩০০, কাকরোল ১০০, করলা ১২০, মিষ্টি কুমড়া ৬০, ঝিঙে ১০০, পটল ৮০-১২০, শসা ৬০-৮০, সজনে ডাঁটা ২০০, গাজর ১৪০, ঢেঁড়স ১০০-১২০, কচুর লতি ১০০, কচুরমুখী ৬০, মুলা ৮০, চিচিঙ্গা ৮০ এবং কাঁচা মরিচের কেজি ১৬০ টাকা ও ধনিয়া পাতা ৩০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া লাউ আকারভেদে প্রতি পিস ৮০ থেকে ১০০ টাকা, বাঁধাকপি পিস ১২০ টাকা, ফুলকপি পিস ৮০ থেকে ১০০ টাকা এবং চাল কুমড়া ৬০ থেকে ৭০ টাকায় মিলছে।
মিরপুরের কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া ও পীরেরবাগ বাজার
মিরপুরের কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া ও পীরেরবাগ বাজার এবং সংলগ্ন বাজারেও শাকসবজি বিক্রি হচ্ছে বাড়তি দামে। ৩০ থেকে ৬০ টাকা কেজিতে মিলছে কেবল চার ধরনের সবজি। বাকিগুলো বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ১২০ টাকা কেজি দরে।
এসব বাজারে পেঁপে ৩০ টাকা, মিষ্টি কুমড়া ৫০ টাকা এবং কচুরমুখী ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। একই সঙ্গে লেবুর হালি ১৫ থেকে ৩০ টাকা, কাঁচকলার হালি ৪০ টাকা এবং চাল কুমড়া ৬০ টাকা পিস করে বিক্রি হচ্ছে।
এসব বাজারে বেশির ভাগ সবজি বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ১২০ টাকা দরে। এর মধ্যে বেগুন প্রকারভেদে ৮০ থেকে ১২০ টাকা, বরবটি ১০০ টাকা, পটল ৮০-১০০, ধুন্দল ৮০, চিচিঙ্গা ৮০, কচুর লতি ৮০, ঢেঁড়স ৮০, কাকরোল ১২০, করলা ১০০-১২০, ঝিঙে ১০০, মুলা ৮০, শসা (দেশি) ১০০ টাকা এবং শসা (হাইব্রিড) ৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এসব বাজারে লাউ প্রতি পিস মিলছে ৮০ টাকা দরে।
অন্যদিকে ভারতীয় গাজর ১৪০ টাকা, টমেটো ১৮০ টাকা, সজনে ডাঁটা ২০০ টাকা, কাঁচামরিচ ১৬০ থেকে ২০০ টাকা, শীতকালীন সবজি শিম ২৪০ টাকা, ধনেপাতা ৪০০ টাকা এবং ক্যাপসিকাম ৪০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
১৫ থেকে ৪০ টাকা আঁটিতে বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের শাক। এর মধ্যে কলমি শাক ১৫ টাকা, ডাটা শাক ২০ টাকা, লাল শাক ২৫ টাকা, পুঁই শাক ৪০ টাকা এবং লাউ শাক ৫০ টাকা আঁটি বিক্রি হচ্ছে।
খুলনা
খুলনা নগরের নিরালা কাঁচা বাজারে প্রতি কেজি করলা ১০০ টাকা, শসা ৬০, ঢেঁড়স ৮০, টমেটো ১৬০, পটল ৮০ টাকা, বরবটি ৭০ এবং ঝিঙে প্রতি কেজি ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এছাড়া প্রতি কেজি ধুন্দল ৫০ টাকায়, কাঁকরোল ৮০, বেগুন (গোল) ১২০, বেগুন (লম্বা) ৮০, কচু ৮০, পেঁপে ৪০, চিচিঙ্গা ৮০ এবং কাঁচামরিচের কেজি ২০০ টাকায় মিলছে। এছাড়া লাউ প্রতি পিস ৫০-৬০ টাকা, আমড়া প্রতি কেজি ৩৫ টাকা, লাল শাক প্রতি কেজি ৪০ টাকা ও লাউ শাক প্রতি কেজি ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বরিশাল
বরিশালের সিটি মার্কেট ও পেঁয়াজ পট্টির পাইকারি বাজারে বেগুন ৮০ টাকা কেজি, করলা ৫০ টাকা, ঝিঙে ৩০, পটল ৫০, রবটি ৬০, গাটি কচু ১০ টাকা, কাঁচামরিচ ১০০ এবং শসা ৪০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। প্রতি পিস মিষ্টি কুমড়া ৪০ টাকা, লাউ ৩০ টাকা এবং চাল কুমড়া মিলছে ২৫-৩০ টাকায়।
বরিশালের খুচরো বাজারে প্রতি কেজি বেগুন ১৬০ টাকা, করলা ৮০ টাকা, মিষ্টি কুমড়া ৬০, ঝিঙে ৬০, পটল ৬০, কাঁচামরিচ ২০০, শসা ৬০, চাল কুমড়া ৪০, বরবটি ১০০, গাটি কচু ৫০, গাজর ১২০ এবং কাকরোল ৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। লাউ প্রতি পিস বিক্রি হচ্ছে ৬০-১০০ টাকায়।
সিলেট
দেশের অন্যান্য বাজারগুলোর মতো সিলেটে কাঁচাবাজারগুলোতেও বেড়েছে শাক-সবজির দাম। এক সপ্তাহের ব্যবধানেই প্রতিটি শাক-সবজিতে ১০ থেকে ৪০ টাকা পর্যন্ত দাম বৃদ্ধি পেয়েছে।
সিলেট নগরীর বন্দরবাজার, আম্বরখানা ও মদিনা মার্কেট ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিকেজি পটল ৮০ টাকা, ঢেঁড়স ৭০-৮০ টাকা, পেঁপে ৪০, কচুরমুখী ৮০, শসা ৮০-১০০, ঝিঙে ১০০, কাঁকরোল ৯০, করলা ৮০, চিচিঙ্গা ৮০-১০০, কাঁচা মরিচ ২৮০-৩০০ টাকা, গাজর ১৬০ টাকা ও টমেটোর কেজি ১৪০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। বাজারে জালি কুমড়ো প্রতি পিস ৮০-১০০ টাকা, লাউ ১২০ টাকা এবং পুঁইশাক প্রতিকেজি মিলছে ৩০ টাকা দরে।
গত সপ্তাহে বাজারে প্রতি কেজি পটল ৬০ টাকা, চিচিঙ্গা ৬০, কাঁকরোল ৬০, করলা ৮০, লুবিয়া ৮০, ঝিঙে ৭০, গাজর ১৫০, কচুরমুখী ৪০, পেঁপে ৪০, এবং কুমড়ো প্রতিপিস ৬০-৭০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে।
চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজার
ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য বাজারের সঙ্গে অবশ্য বিশাল ফারাক চট্টগ্রামের বাজারদরের। এখানকার রিয়াজউদ্দিন বাজারের পাইকারি সবজি বাজারে বরবটির কেজি ৪০ টাকা, চিচিঙ্গা ২০ থেকে ২৫ টাকা, পাকা মিষ্টি কুমড়া (ঠাকুরগাঁও) ৩০ থেকে ৩২, চট্টগ্রামের দোহাজারী-সাতকানিয়ার কাঁচা সবুজ মিষ্টি কুমড়া ২০ টাকা, কাটিলাল আলু ১৩ টাকা, ডায়মন্ড আলু ১৪ টাকা, গুটি আলু (ধোয়া) ২৫ টাকা, গুটি আলু (আধোয়া) ১৬ টাকা, মেহেরপুরের ছড়া কচু ১৮-২০ টাকা, কচুরমুখী (মোথা/মূল) ৫-৬ টাকা, পেঁপে ১০-১৩ টাকা, পটল ৪৫ টাকা, সীতাকুণ্ডের বড় বেগুন ৯০ টাকা, নোয়াখালীর সুবর্ণচরের শসা ১৫ টাকা (ছোট), বড় আকারের শসা ২৮ টাকা, চালকুমড়া ১৫ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া ঝিঙে ৩০-৩৫ টাকা, ঢেঁড়স ৪০-৪৫, ধুন্দল ২৮-৩০, বরবটি ৪০, কাঁকরোল ৪০-৫৫, তিতা করলা ৩০-৩৫ টাকা কেজি এবং প্রতি পিস লাউ ১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বিক্রেতারা যা বলছেন
ব্যবসায়ী ও খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, মৌসুম বদল, পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি আর পাইকারি বাজারে সরবরাহ কমে যাওয়াই সবজির দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ার কারণ। তারপর কিছু এলাকায় বন্যা চলছে, বৃষ্টিতে কৃষক ঠিকমতো ফসল তুলতে পারেন না। পানি শুকিয়ে গেলে বৃষ্টি কমে গেলে আবার দাম কমে যাবে।
কারওয়ান বাজারের খুচরা সবজি বিক্রেতা ফরিদ মিঞা বলেন, বাজারের সব ধরনের সবজি সরবরাহ অনেক কম। বেশিরভাগ সবজির মৌসুম শেষ হওয়ার কারণে মূলত সরবরাহ কম হচ্ছে। এর সঙ্গে দেশের বিভিন্ন এলাকায় নিয়মিত বৃষ্টি হচ্ছে, সেজন্য সবজি নষ্টও হচ্ছে। নতুনভাবে সবজি বাজারে উঠতে শুরু করলে দাম কমে আসবে।
তিনি বলেন, দাম বাড়ার পর থেকে সবজি বিক্রি অনেক কমে গেছে। মানুষ এখন কম পরিমাণে সবজি কিনছে। আগে এক কেজি সবজি কিনলে এখন আধা কেজি কিনছে। সবমিলিয়ে সবজির দাম বাড়ার কারণে আমাদের ব্যবসাও কমে গেছে।
বিভিন্ন হাতবদল হয়ে ক্রেতার হাতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দাম বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে এই বাজারের ব্যবসায়ী আসলাম রহমান বলেন, সবজি নিয়ে আসার পর ট্রাকে থাকা অবস্থাতেই বিক্রি হয়। আরেকজন কিনে নেন। এভাবে হাতবদলে দাম বাড়ে। কারওয়ান বাজারে রাতে পাইকারিভাবে যে দামে সবজি বিক্রি হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি দরে বিক্রি হয় খুচরা পর্যায়ে। হাত বদলায় আর দাম বাড়ে। এছাড়া এই সময় আবহাওয়ার কারণে জমিতে সবজি চাষ কম হয়, ফলে সরবরাহও কমে যায়। এ কারণে বর্তমানে বাজারে সবজির দাম বেশি।
মিরপুর ১৪ নম্বরের বউবাজারের সবজি বিক্রেতা শফিকুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, গত কয়েকদিন যাবত কাঁচা তরকারির দাম হু হু করে বেড়ে গেছে। এর কারণ যতটা বুঝতে পারলাম, অনেক জেলায় বন্যা ও বৃষ্টির কারণে এমনটি ঘটছে। তারপরও যারা বড় ব্যবসায়ী আছে, তারা আবার সিন্ডিকেট করছেন। কাঁচামরিচসহ বিভিন্ন পণ্য মজুত রেখে দাম বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। আমরা যারা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী তারা মালামাল কিনতে এসে ঝামেলায় পড়ি। কারণ আমাদের এক কেজি আধা কেজি করে বিক্রি করতে হয়, দাম বেশি চাইলে ক্রেতারা অনেক সময় রেগে যান।
খুলনার নিরালা বাজারের সবজি ব্যবসায়ী অয়ন শেখ মঙ্গলবার বিকেলে বাংলানিউজকে বলেন, বৃষ্টির কারণে বাজারে সবজির সরবরাহ কম হওয়ায় থাকায় দাম বেশি। গত ১৫ দিনের ব্যবধানে প্রতিটি শাক-সবজির ১০-৩০ টাকা পর্যন্ত কেজিতে দাম বেড়েছে।
সিলেটের রিকাবীবাজারের সবজি বিক্রেতা আনোয়ার হোসেন বলেন, এখন বৃষ্টির মৌসুম, যে কারণে সবজির দাম একটু বেশি। বৃষ্টি হওয়ায় কিছু সবজির দাম ওঠানামা করছে। অবশ্য বৃষ্টি হলে কিছু কিছু সবজি কেনা দামের চেয়েও কম দরে বিক্রি করতে হচ্ছে। কারণ এগুলো পচে যাওয়ার চেয়ে কম দামে ছেড়ে দেওয়া ভালো।
তিনি আরও বলেন, আড়তেই সবজির দাম বেশি। সিলেটের স্থানীয় কোনো সবজি বাজারে নেই। সবই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ব্যবসায়ীদের আনতে হচ্ছে। এতে খরচ বেড়ে যাচ্ছে বহুগুণে। আরও তিন চার মাসের আগে দাম কমার কোনো সুযোগ নেই।
তবে দেশের অন্যান্য বাজারের সঙ্গে চট্টগ্রামের সবজির দামের পার্থক্য প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম ফ্রেশ ফ্রুটস অ্যান্ড ভেজিট্যাবলস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মাহবুব রানা বাংলানিউজকে বলেন, চট্টগ্রামের দোহাজারী, সীতাকুণ্ড, মীরসরাই, রাঙ্গুনিয়া ও তিন পার্বত্য জেলায় প্রচুর সবজি উৎপাদিত হওয়ায় ঢাকার তুলনায় দাম কম। এখানে আলু, পেঁয়াজসহ কয়েক পদের সবজি বেশি আসে মুন্সীগঞ্জ, ফরিদপুর, পাবনা, নোয়াখালীসহ দূর-দূরান্ত থেকে। বাকিগুলো চট্টগ্রাম জেলা ও তিন পার্বত্যজেলায় প্রচুর চাষ হচ্ছে। এসব এলাকার সবজি দ্রুততম সময়ের মধ্যে পাইকারি বাজারে পৌঁছে যাওয়ায় গুণগতমান ভালো থাকে। আমরা ভালো মানের সবজি সংগ্রহ করে আমিরাতে রপ্তানি করছি, সেখানে চট্টগ্রামের প্রচুর মানুষ থাকায় এসব সবজির চাহিদাও বেশি।
বাজারে মনিটরিং বাড়ানোর তাগিদ ভোক্তাদের
হঠাৎ সবজির বাজার অস্থির হয়ে যাওয়ায় চাপে পড়েছেন নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষেরা। তারা নিত্যপণ্যের দাম আগুন হয়ে যাওয়ার পেছনে মনিটরিং ব্যবস্থার দুর্বলতাকে দায়ী করছেন। তাদের মতে, বাজারে সরকারের মনিটরিং নেই। এই অবস্থা চলতে থাকলে নিম্ন আয়ের মানুষের জীবন-যাপন দুর্বিসহ হয়ে উঠবে। এতে করে দেশে চুরি, ছিনতাই ও অরাজকতা বাড়বে বলে মনে করছেন তারা।
গত জুলাই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ। আগস্টে এটা আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এজন্য ক্রেতারা মনে করেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ রাখাই সরকারের মূল চ্যালেঞ্জ।
মিরপুরের কাজীপাড়ায় বাজার করতে আসা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী শওকত ওসমান বাংলানিউজকে বলেন, এভাবে দ্রব্যমূল্য বাড়তে থাকলে আমাদের মত মানুষের জীবন চলা কষ্টকর হয়ে যাবে। নিজ ব্যবসায় চলছে মন্দা, অথচ প্রতিনিয়ত বাজারে এলে অস্বস্তিতে পড়তে হয়। কোনো কিছুই স্থিতিশীল নয়। বাজারে সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। যে যার মত করে নানা অজুহাতে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। এতে আমাদের মত নিম্নবিত্ত মানুষের জীবন ধারণ করা কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে।
শেওড়াপাড়ার অলি মিয়ারটেক বাজারের ক্রেতা ইসমাইল হোসেন বলেন, মাঝেমধ্যে খবর দেখি সরকার বাজার তদারকি করছে। কিন্তু যারা কারসাজি করছে তাদের জরিমানা এতই সামান্য করা হচ্ছে যে, সে আবারও অপরাধ করার সুযোগ পাচ্ছে। তাই আইনের সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে সরকারের মনিটরিং বাড়ানো প্রয়োজন।
ইব্রাহিমপুরের সৈয়দ ওবায়দুল হক বলেন, কাঁচামালের দাম যে কখন বাড়ে কখন কমে আসলে বুঝে ওঠার কোনো উপায় নেই। এভাবে যদি চলতে থাকে তাহলে আমাদের মতো মধ্য আয়ের মানুষের সংসার চালানো খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে।
মিরপুর ১৪ নম্বর এসপি পাড়া থেকে বাজার করতে এসেছেন গৃহিণী রুবিনা আক্তার। প্রত্যেকটা কাচা তরকারির দাম জিজ্ঞেস করছেন আর দাম শুনেই বারবার মাথা নাড়ছেন তিনি।
রুবিনা ক্ষোভ ঝেড়ে বলেন, একটা ছোট সংসার, তাও এখন বাজার করতে গেলে বাজেট ভেঙে যাচ্ছে। আগে যেখানে তিন দিনের বাজার ৫০০ টাকায় হতো, এখন ১০০০ টাকাও কম পড়ে।
পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন রিকশাচালক হাবিবুর রহমান। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, সারাদিন রোদে খেটে আয় করি গড়ে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। বাজার করতে এলে মাথায় হাত উঠে যায়। কী করবো, সংসারে ৪-৫ জন খাবার লোক, মাছ-গোশত তো বহুদূরের কথা, কাচা তরকারিও কিনতে পারছি না। আমরা তো ভাতের সঙ্গে শাক-সবজি দিয়েই চলে যাই। কিন্তু এখন শাকসবজির দাম এত বেশি, সবকিছুই যেন আমাদের নাগালের বাইরে।
প্রবীণ সুভাষ দাস দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, দেশে ফসল আছে, কৃষক ফলাচ্ছে। তারপরও আমরা কেন ন্যায্যমূল্যে কিনতে পারছি না, সেটা আমাদের কারও বোধগম্য নয়। কিন্তু আমরা মনে করি মূল ঝামেলা মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য আর বাজারে কার্যকর মনিটরিংয়ের অভাব।
বাজার নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত উদ্যোগ দরকার: ভোক্তা অধিকার কর্মকর্তা
বাজার পরিস্থিতি নিয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগের উপ-পরিচালক বিকাশ চন্দ্র দাস জানান, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে তাদের বাজার তদারকি চলমান। গতকাল (২৪ আগস্ট) রাতেও কারওয়ান বাজার সবজির বাজারে এবং তেজগাঁওয়ে ডিমের আড়তে তারা অভিযান চালিয়েছেন।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আমরা ডিমের আড়তে ৬০ হাজার টাকা জরিমানা করেছি। কারওয়ান বাজারে ১০ হাজার টাকা, মোহাম্মদপুর টাউন হলে সবজির বাজারে ১৭ হাজার টাকা এবং শান্তিনগর বাজারে ১৫ হাজার টাকা নানা অনিয়মের কারণে জরিমানা করা হয়েছে। আমাদের কাজ চলমান রয়েছে, আমরা আমাদের কাজ করে যাচ্ছি। বাজার নিয়ন্ত্রণে আরও কয়েকটি উইং রয়েছে। এক্ষেত্রে সবার সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।
নিয়ন্ত্রক সংস্থার অভিযান কমায় বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন মনে করেন, সারাদেশে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে যে অভিযান পরিচালিত হতো সেটা অনেকটাই কমে গেছে। আইনের শক্ত প্রয়োগ না থাকার কারণে বাজার নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সময় নিয়ন্ত্রক সংস্থার অভিযান কমেছে। গত বছর ৫ আগস্টের পরে অসাধু ব্যবসায়ীদের মনে ভয় ছিল, কিন্তু এখন সেটা নেই, তারা আইনকে তোয়াক্কা করছে না। বরং তারা অসাধুভাবে ব্যবসা করতে উৎসাহিত হচ্ছে। এতে বাজার লাগামহীন হয়ে গেছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ আইনের শক্ত প্রয়োগ। আইনের কঠোর প্রয়োগ হলেই নিত্যপণ্যের দাম কমে আসবে।
(প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট এস এম এ কালাম, জাফর আহমদ, তানভীর আহমেদ, মাহবুবুর রহমান মুন্না, জিএম মুজিবুর, নাসির উদ্দিন, আল রাহমান ও স্টাফ করেসপন্ডেন্ট মুশফিক সৌরভ)
এইচএ/