এই অবস্থায় কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারের কাজ শেষ করার জন্যও সময় বাড়ানো হয়েছে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত। ক্রোমিয়াম শোধনাগারের মেশিনপত্র পড়ে আছে খোলা আকাশের নিচেই।
অন্যদিকে এ চামড়া শিল্পপল্লীর বেশির ভাগ প্লটেই চলছে নির্মাণযজ্ঞ। সরকারি হিসেবে ১৫৫টি প্লটের মধ্যে ৩৫টি ট্যানারি গত কোরবানির ঈদের পর থেকেই চামড়া ওয়েট ব্লু’র কাজ শুরু করেছে। বাকি বেশির ভাগ প্লটেই এখন চলছে নির্মাণকাজ। আবার বড় বড় প্লটের বরাদ্দপ্রাপ্তরা এখনো শুরুই করেননি তাদের কারখানার নির্মাণকাজ।
এদিকে কেন্দ্রীয় শোধনাগারের কাজও শেষ করতে পারেনি সরকার। সিইটিপির পানি শোধনাগারের চার ইউনিটের দুইটি কাজ চালানোর মতো শুরু করলেও পুরো নির্মাণযজ্ঞ শেষ হতে আরো বছর খানেক লাগতে পারে বলে বাংলানিউজকে জানিয়েছেন নির্মাণসংশ্লিষ্টরা। বাকি দুটোর অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শেষ হলেও চীনা ঠিকাদারেরা যন্ত্রপাতি সংযোজনের কাজ শেষ করতে পারেনি।
সিইটিপির অবকাঠামো নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান জাকির এন্টারপ্রাইজের সাইট ম্যানেজার বেলাল হোসেন এ বিষয়ে বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমরা আমাদের কাজ শেষ করে এনেছি। এখন বাকি আছে চীনা প্রকৌশলী ও ঠিকাদারদের কাজ। তারা এখনো তাদের সব যন্ত্রপাতি আনতে পারেনি। যতটুকু এসেছে, নানা জটিলতায় তাও সংযোজন করছে না। ’
সরেজমিনে দেখা গেছে, সিইটিপি থেকে পানি ছাড়ার পাইপ নামানো হয়েছে ধলেশ্বরী নদীতে। সেখান দিয়ে দিনের বেলায় শোধন করা পানি ছাড়া হয় বলে দাবি করেছে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সে পানি পুরোপুরি শোধিত নয় বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। স্থানীয়দের অভিযোগ, দিনের বেলা শোধন করা কম দূষিত পানি নদীতে ফেললেও রাতের অন্ধকারে দুষিত পানিই ফেলা হচ্ছে নদীতে। এতে নদীর মাছ প্রায়ই মরে ভেসে ওঠার ঘটনা ঘটছে। কেমিকেলমিশ্রিত পানি নদীতে ফেলায় নদীর পানি পচে কালো রং ধারণ করেছে এবং ব্যবহারের অনুপোযোগী হয়ে পড়ছে। এরই মধ্যে এই পানি ব্যবহারে নানা রোগ বালাইয়ের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে।
অন্যদিকে সলিড ওয়াস্ট ম্যানেজমেন্ট ইয়ার্ডের কাজ শুরুই করেনি প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুঠিরশিল্প কর্পোরেশন(বিসিক)। প্রকল্পের পশ্চিম পাশে এজন্য রাখা নির্ধারিত স্থানে খোলা অবস্থাতেই চামড়ার বাড়তি অংশ জমা করছেন উৎপাদনে যাওয়া ট্যানারি মালিকরা। এই বর্জ্যের পচা গন্ধে এলাকার পরিবেশ ভারী হয়ে উঠেছে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইয়ার্ড নির্মাণের কাজ শেষ হলে এই পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে। কংক্রিটের এই ইয়ার্ডে জমানো বর্জ্য বিশেষ ব্যবস্থায় জৈব সারে রূপান্তর করা হবে। তবে কবে নাগাদ এই প্রক্রিয়া শুরু হবে তা বলতে পারেননি কেউই। এখনো এই ইয়ার্ডের নির্মাণকাজের দরপত্রই আহবান করেনি বিসিক।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব লেদার অ্যান্ড টেকনোলজি’র ডিপার্টমেন্ট অব ফুটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান অমল কান্তি দেব বাংলানিউজকে বলেন, একটি চামড়ার ৮০ ভাগই সলিড ওয়াস্ট। খোলা অবস্থায় এই ওয়াস্ট মাটিতে রাখলে তা পচে যেভাবে বাতাস ও পরিবেশ নষ্ট হয়, তেমনি এই বর্জ্যে থাকা কেমিকেল, ক্রোমিয়াম ও লবণ ভূগর্ভের মাটি ও পানিকে দুষিত করবে। এতে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সরানোর সুফল পাওয়া যাবে না। বরং নতুন একটি এলাকাকে দূষণের মধ্যে ঠেলে দেওয়া হবে।
এদিকে চামড়া শিল্পপল্লীর ড্রেনেজ ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ট্যানারি মালিকরা। এদেরই একজন জনতা ট্যানারির চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, ‘চামড়া শিল্পপল্লীর কেন্দ্রীয় ড্রেনেজ লাইন মাত্র ১৮ ইঞ্চি পাইপের মাধ্যমে করা হয়েছে। এরই মধ্যে যে ৩৫টি ট্যানারি ওয়েট ব্লুর কাজ শুরু করেছে তা এই লাইন নিতে পারছে না। ফলে ওভার ফ্লো-র সমস্যা দেখা দিয়েছে। ’তিনি বলেন, ‘বড় ট্যানারিগুলো নিজেরাই ১৮ ইঞ্চি পাইপের মাধ্যমে পানি ড্রেনেজের ব্যবস্থা করেছে। যখন সবগুলো ট্যানারি একই সঙ্গে লাখ লাখ লিটার কেমিকেল মিশ্রিত পানি লাইনে ছাড়বে, তখন এই অঞ্চলে বিভীষিকায় অবস্থা দেখা যাবে। ’
সরেজমিনেও এ দাবির সত্যতা মিলেছে। আহসান হাবীব অ্যান্ড ব্রাদ্রার্স ট্যানারির পাশের রাস্তাটি ট্যানারির পচা পানিতে সয়লাব হয়ে গেছে। তবে প্রকল্প বাস্তবায়নকারীদের একজন নাম না প্রকাশ করার শর্তে বাংলানিউজকে বলেন, ‘সবগুলো কারখানা চালু হলে, মূল ড্রেন থেকে ২৪ ঘন্টাই পানি পাম্প করে সিইটিপিতে আনা হবে। তাই লাইন ওভার ফ্লো হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ’
সরেজমিনে দেখা গেছে, ১৫৫ প্লটের ১০০টিরও বেশি প্লটে চলছে কারখানা নির্মাণকাজ। কিছু বড় প্লটের কাজই ধরেননি মালিকরা। কিছু প্লটে হয়নি পাইলিংয়ের কাজও।
এ বিষয়ে ইকবাল ব্রাদার্সের ইকবাল হোসেন বলেন, ট্যানারির মূল উপাদান গ্যাসেরই সংযোগ দিতে পারেনি সরকার। ওয়েট ব্লুর পর তাই চামড়া আবার হাজারীবাগেই পাঠাতে হচ্ছে। এতে খরচ বাড়ছে। জমির মূল্য পরিশোধের পরও দেওয়া হয়নি জমির দলিল। ফলে লোন নিতে পারেননি অনেক মালিক। বলতে গেলে টাকার অভাবেই কারখানার কাজ শেষ করতে পারেননি বেশিরভাগ মালিক।
এদিকে হাজারীবাগ থেকে সাভারে সরিয়ে না নেওয়া ট্যানারি অবিলম্বে বন্ধ এবং কারখানাগুলোর বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে হাইকোর্টের দেওয়া আদেশ বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ। রোববার (১২ মার্চ) সকালে ট্যানারি মালিকদের করা আবেদন খারিজ করে দেন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে তিন বিচারপতির বেঞ্চ। গত ০৬ মার্চ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) এক আবেদনের শুনানি নিয়ে বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ও বিচারপতি মো. সেলিমের হাইকোর্ট বেঞ্চ হাজারীবাগে থাকা ট্যানারি বন্ধের আদেশ দেন। এ আদেশে স্থগিতাদেশ চেয়ে আপিল বিভাগে আবেদন করেন বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার সমিতির চেয়ারম্যান। আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। রিট আবেদনকারীর পক্ষে ছিলেন আইনজীবী ফিদা এম কামাল। সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
শুনানিতে তাপস বলেন, এখনও আমাদের ক্ষতিপূরণের সব টাকা দেওয়া হয়নি। এখানে অনেক মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িত। অন্তত জুন মাস পর্যন্ত সময় দেন। আদালত ‘উই আর সরি’ বলে আবেদনটি খারিজ করে দেন।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৫৭ ঘণ্টা, মার্চ ১৩, ২০১৭
আরএম/জেএম