বাংলাদেশ আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো খাতে, বিশেষ করে- রেল, বিদ্যুৎ, তথ্যপ্রযুক্তি, সড়ক পরিবহন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নৌ-পরিবহন, অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ নানা খাতের উন্নয়নে বাংলাদেশ এ অর্থ ব্যবহার করতে পারবে। তবে এসব কাজ বাস্তবায়নে যেসব প্রকল্প গ্রহণ করা হবে তাতে অন্তত ৭৫ শতাংশ পণ্য ও সেবা অবশ্যই ভারত থেকে আমদানি করতে হবে।
অথচ এর মধ্যেই শুরু হয়েছে ভারত থেকে তৃতীয় ধাপের এলওসি নেয়ার প্রস্তুতি। অর্থমন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)-সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
ইআরডি সূত্র জানায়, তৃতীয় এলওসি’র জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে প্রকল্প চাওয়া হচ্ছে। এর মধ্যেই ভারতের ঋণে বাস্তবায়নের আগ্রহ প্রকাশ করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ প্রায় ১৬টি প্রকল্প ইআরডি’তে জমা দিয়েছে। প্রতিনিয়তই তৃতীয় এলওসি’র জন্য ইআরডি’তে নতুন নতুন প্রকল্প জমা পড়ছে। আর এসব প্রকল্প যাচাই-বাছাই করছে ইআরডি। তবে সর্বশেষ ৮টি প্রকল্প চূড়ান্ত করা হবে বলে আভাস পাওয়া গেছে। এজন্য আনুমানিক ব্যয় ধরা হয়েছে ১১৭ কোটি ডলার। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী (বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী প্রতি ডলার ৭৮ টাকা হিসেবে) এর পরিমাণ বাংলাদেশী মুদ্রায় নয় হাজার ১২৬ কোটি টাকা।
নতুন ঋণের জন্য চূড়ান্ত তালিকায় থাকা প্রকল্পগুলো হলো, বুড়িগঙ্গা নদী পুনরুদ্ধার, আশুগঞ্জ নৌরুট খনন, পায়রা বন্দরের বহুমুখি টার্মিনাল নির্মাণ, বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জের শহীদ এম মনসুর আলী স্টেশন পর্যন্ত ডুয়েলগেজ রেলপথ নির্মাণ, স্থল বন্দরের শুল্ক স্টেশনের আধুনিকায়ন প্রকল্প।
ঈশ্বরদীতে অভ্যন্তরীণ কনটেইনার ডিপো (আইসিডি) নির্মাণ, মিরসরাইতে অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন প্রকল্প এ তালিকায় রয়েছে।
ভারত থেকে তৃতীয় দফায় ঋণ নিয়ে এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ চলছে। তবে এক বছর আগে ঋণ পাওয়া ১৪টি প্রকল্পের অগ্রগতি হতাশাব্যঞ্জক।
ইআরডি সূত্র জানায়, দ্বিতীয় ধাপে ৫০০টি ট্রাক কেনা প্রকল্প ২০ কোটি ৩৬ লাখ ও ডাবল ডেকার ও সিঙ্গেল ডেকার প্রকল্পে ৫৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকা ঋণ দেয় ভারত। এই দুটি প্রকল্পে একনেকের অনুমোদন পেলেও অগ্রগতি শূন্য। এক বছর আগে ঋণ নিলেও এখনও দরপত্র জমা দেয়া হয়নি। ফলে প্রকল্পের অগ্রগতি শূন্য। প্রকল্পের অগ্রগতি বলতে চলতি বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি ভারতীয় কর্তৃপক্ষের নিকট পাঠানো হয়েছে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) । তবে বাস্তব অগ্রগতি এখনও অধরায়।
‘প্রকিউরমেন্ট অব ইকুইপমেন্টস অ্যান্ড মেশিনারিজ ফর রোডস অ্যান্ড হাইওয়ে’ প্রকল্পে ৬০ কোটি টাকা ঋণ দেয় ভারত। প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন পেলেও অগ্রগতি নেই। আশুগঞ্জ নদীবন্দর হয়ে আখাউড়া পর্যন্ত ৫০ দশমিক ৮৭ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণে প্রকল্পে ২৮৩ কোটি টাকা ঋণ দেয় ভারত। অথচ প্রকল্পের ডিপিপি যথাযথভাবে প্রস্তুত করা হয়নি।
একই অবস্থা ভারতের ঋণ পাওয়া রেলপথ মন্ত্রণালয়ের তিনটি প্রকল্পেরও। খুলনা-দর্শনা (চুয়াডাঙ্গা) ডাবল লাইন রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে ৩১২ কোটি এবং সৈয়দপুরে রেলওয়ে ওয়ার্কশপ নির্মাণ প্রকল্পের জন্য ৭০ কোটি ২৮ লাখ টাকা ঋণ দেয় ভারত। পার্বতীপুর-কাউনিয়া সেকশনে ডাবল গেজ রেললাইন নির্মাণে ১২০ কোটি টাকা ঋণ দেয় ভারত।
অথচ তিনটি প্রকল্পের জন্য প্রাথমিক যে কাজ ডিপিপি, তার দুটি এখনও প্রস্তুত হয়নি। ফলে এই প্রকল্পেরও সামগ্রিক অগ্রগতি শূন্য। এমনকি বাংলাদেশ রেলওয়ে থেকে ডিপিপি এখনও রেলপথ মন্ত্রণালয়ে আসেনি। ফলে প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতিও অধরায়।
বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মোঃ আমজাদ হোসেন এসব প্রকল্পের বিষয়ে বাংলানিউজকে বলেন, নানা কারণে প্রকল্পের ডিপিপি তৈরি করতে দেরি হয়েছে। এর আগে প্রকল্পের অর্থের সোর্স জানতে পারিনি। একারণে আমাদের ডিপিপি তৈরি করতে দেরি হয়েছে। তবে একটি ডিপিপি প্রস্তুত হয়েছে। বাকি দুটি অচিরেই হয়ে যাবে। এর পরে আমরা রেলপথ মন্ত্রণালয়ে ডিপিপি তিনটি দিতে পারবো। ’
‘বড়পুকুরিয়া-বগুড়া ও কালিয়াকৈরে ৪০০ কেভি বিদ্যুৎ লাইন স্থাপন’ প্রকল্পে ২১১ কোটি টাকা ঋণ দেয় ভারত। প্রকল্পের সম্ভাব্যতা জরিপ (ফিজিবিলিটি স্টাডি) এখনও সম্পূর্ণ হয়নি। ফলে ডিপিপি তৈরি করতে এখনও ৬ থেকে ৭ মাস সময় লাগবে।
‘জেলা পর্যায়ে ১২টি হাইটেক পার্ক নির্মাণে ১৯৩ কোটি টাকা এবং ৪৯টি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ও দু’টি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের উন্নয়নে ২৮১ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে ভারত। এই দুটি প্রকল্পেরও কোনো অগ্রগতি নেই।
‘চারটি মেডিকেল কলেজ ও একটি বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি হাসপাতালের স্থাপন’ প্রকল্পে ২৫০ কোটি টাকা ঋণ দেয় ভারত। অথচ প্রকল্পের প্রাথমকি কাজ এখনও শুরুই করতে পারেনি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়।
‘এস্টাবলিশমেন্ট অব ইন্ডিয়ান ইকোনোমিক জোন ইন কেরানিগঞ্জ অ্যান্ড মিরেরসরাই’ প্রকল্পে ৯০ কোটি এবং এস্টাবলিশমেন্ট অব ইন্ডিয়ান ইকোনোমিক জোন ইন মংলা, বাগেরহাট, ভেড়ামারা’ প্রকল্পে ৮৮ কোটি টাকা ঋণ দেয় ভারত। এই প্রকল্প দু’টির ডিপিপিও এখনও তৈরি হয়নি। ফলে এই প্রকল্পেরও কোনো অগ্রগতি নেই।
অন্যদিকে কারিগরি শিক্ষাকেন্দ্রের সুবিধা বাড়াতে ২৮১ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে ভারত। এই প্রকল্পেরও দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই।
তবে ইআরডি বলছে, দ্বিতীয় এলওসিভূক্ত প্রকল্পের অগগ্রতি শূন্য হলেও তৃতীয় ধাপে প্রকল্প গ্রহণে কোনো সমস্যা নেই। এমনকি এক্ষেত্রে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) ভারপ্রাপ্ত সচিব কাজী শফিকুল আযম বাংলানউজকে বলেন, ‘দ্বিতীয় এলওসি’র আওতায় ১৪টি প্রকল্পের মধ্যে মাত্র পাঁচটি প্রকল্প একনেকে অনুমোদন পেয়েছে। একনেকে অনুমোদন না পেলে বাস্তবায়ন আসবে কোথা থেকে। তবে দ্বিতীয় ধাপের ঋণে প্রকল্প বাস্তবায়ন ধীরগতি হলেও তৃতীয় ধাপে এলওসি ঋণের কাজে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। আমরা তৃতীয় ধাপে এলওসি নেওয়ার কাজ শুরু করে দিয়েছি। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে প্রকল্প আসছে। আমরা প্রকল্পগুলো যাচাই করছি। ’
প্রসঙ্গত, এসব প্রকল্পে ভারতের দেয়া এই সহজ শর্তের ঋণ ২০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশকে পরিশোধ করতে হবে। এতে ১ শতাংশ হারে সুদ দিতে হবে। তবে প্রথম পাঁচ বছর গ্রেস পিরিয়ড হিসেবে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে কোনো কিস্তি পরিশোধ করতে হবে না।
বাংলাদেশ সময়: ০৬৩৯ ঘণ্টা, মার্চ ১৪, ২০১৭
এমআইএস/জেএম