বরিশাল: বরিশাল-পটুয়াখালী-কুয়াকাটা মহাসড়ককে ইতোমধ্যে পায়রা নদীর ওপর দিয়ে সংযোগ ঘটিয়েছে লেবুখালীর ‘পায়রা সেতু’। যেটি এখন উদ্বোধনের অপেক্ষায় রয়েছে, উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে সেতুটি দিয়ে যান চলাচলও শুরু হবে।
সেতুর নির্মাণ প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দক্ষিণাঞ্চলে নিরবচ্ছিন্ন সড়ক ব্যবস্থায় কুয়াকাটা পর্যন্ত নিরাপদে পৌঁছানোর লক্ষ্যে সরকারের মহান উদ্যোগ এটি। এ ব্রিজটি দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করবে। এটির মাধ্যমে এখানকার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, পর্যটন শিল্পের বিকাশ এবং সর্বোপরি আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটবে। সেসঙ্গে ব্রিজটি চালুর মাধ্যমে এ অঞ্চলের মানুষের স্বপ্ন ফেরিবিহীন নির্ঝঞ্জাট যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে বলে মনে করছেন দক্ষিণাঞ্চলের সাধারণ মানুষ।
তারা বলছেন, বরিশাল অঞ্চলে এ যাবতকালে নির্মিত সর্ববৃহৎ এ সেতুটি দিয়ে যান চলাচল শুরু হলে পটুয়াখালী-বরগুনা জেলাসহ উপকূলীয় ১০ উপজেলার অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থায় সৃষ্টি হবে অভূতপূর্ব উন্নয়ন। এদিকে সেতুটি আগামী অক্টোবরে যেকোনো সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করবেন বলে জানিয়েছে বরিশালের বিভাগীয় প্রশাসন।
সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, কর্ণফুলি সেতুর আদলে নির্মিত এ সেতুটি ইতোমধ্যে অবকাঠামোগত নির্মাণ শেষ করে, এখন চলছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, রংকরণসহ শেষ মুহূর্তের কিছু কাজ। তবে নদী শাসনের কাজ এখনো কিছুটা বাকি রয়েছে। আর এ কাজ শেষ হতে আরো ২/১ মাস সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
পায়রাসেতু নির্মাণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. আবদুল হালিম বাংলানিউজকে জানান, এক্সট্রা ডোজ ক্যাবল স্টেট পদ্ধতিতে করা ১ হাজার ৪শ ৭০ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ১৯ দশমিক ৭৬ মিটার প্রস্থের এই সেতুটি বাংলাদেশে দ্বিতীয়।
তিনি বলেন, এই সেতুর কিছু বিশেষত্বর মধ্যে একটি হলো সব থেকে ‘ডিপেস্ট ফাউন্ডেশন’। ১শ ৩০ মিটার পাইল বিশিষ্ট সেতু এটি, যা পদ্মাসেতুর ক্ষেত্রেও করা হয়েছে। তবে পদ্মাসেতুর আগে আমাদের এটা হয়েছে। এছাড়া প্রথবারের মতো এই সেতুতে আমরা ‘ব্রিজ হেলথ মনিটরিং সিস্টেম’ চালু করেছি। বিভিন্ন দুর্যোগ বা ওভারলোডেড গাড়ি চলাচলের ফলে ব্রিজের যাতে কোনো ধরনের ক্ষতি না হয়, তার (ক্ষতির) পূর্বাভাস দেবে এই হেলথ মনিটরিং সিস্টেমটা। এটা বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো কোনো সেতুতে সংযোজন করা হয়েছে।
অপরদিকে চট্টগ্রামের কর্নফুলি সেতুর মতো এখানেও ২শ মিটারের লং লেন্থ স্প্যান রয়েছে। এ দুটোর মতো আর কোনো সেতুতে এত দীর্ঘ স্প্যান বসেনি।
এদিকে এ সেতুটি পরিদর্শন শেষে বরিশালের বিভাগীয় কমিশনার মো. সাইফুল হাসান বাদল বাংলানিউজকে বলেন, দক্ষিণ বাংলার মানুষের আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নের সেতু পায়রাসেতু। আমরা আশা করছি, প্রধানমন্ত্রী আগামী মাসে সুবিধাজনক সময়ে আমাদের আকাঙ্ক্ষার এ সেতুটি উদ্বোধন করবেন।
বরিশাল বিভাগীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, ব্রিজটি অত্যন্ত নান্দনিক নকশায় তৈরি করা হয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি এটি নির্মাণের মাধ্যমে দক্ষিণাঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থার যুগান্তকারী উন্নতি সাধিত হয়েছে। এ সেতুটি এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। এদিকে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব মো. নজরুল ইসলাম পায়রা সেতু এলাকা পরিদর্শন শেষে বলেন, সবকিছু পরিকল্পনা মাফিক এগিয়ে চলছে। প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরলেই যেকোনো দিন দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের স্বপ্নের পায়রাসেতু উদ্বোধন করতে পারেন তিনি। সেতুটি এ অঞ্চলসহ দেশের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগের পথ খুলে দেবে। পায়রা ও পদ্মাসেতু চালু হলে বিশেষ করে পর্যটনকেন্দ্র কুয়াকাটার সঙ্গে দেশের ফেরিবিহীন যোগাযোগ শুরু হবে। জনগণের ফেরি পারাপারে তখন আর কোনো ভোগান্তি থাকবে না।
পায়রাসেতুর অবস্থান:
বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার শেষ ও পটুয়াখালীর দুমকি উপজেলার লেবুখালী ইউনিয়নের শুরুর অংশে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত পায়রা নদীর ওপর সেতুটির অবস্থান। বরিশালের প্রান্তে সেতুটির পশ্চিম দিকে শেখ হাসিনা সেনানিবাসের অবস্থান। পদ্মাসেতুর টোল প্লাজা থেকে এ সেতুটি ১শ ৩৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। বরিশাল নগরের রুপাতলী থেকে ২৯ কিলোমিটার, পটুয়াখালী শহর থেকে ১১ কিলোমিটার এবং সাগরকন্যা কুয়াকাটার বাস টার্মিনাল থেকে ৭৯ কিলোমিটার দূরে এ সেতুর অবস্থান। সেতুরে উত্তর দিকে ওজন স্কেল এবং দক্ষিণ দিকে ইলেকট্রনিক্স টোল প্লাজা নির্মাণ করা হয়েছে। শুরু থেকে এ পর্যন্ত:
২০১২ সালের মে মাসে একনেকে সরকারের অনুমোদন লাভ পায়রা সেতু নির্মাণ প্রকল্পটি। ২০১৩ সালের ১৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পটুয়াখালী সফরে এসে ফোরলেন বিশিষ্ট পায়রাসেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এরপর ২০১৬ সালের জুলাইয়ের দিকে শুরু হয় সেতুর ভৌত কাজের। নকশাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বৈশ্বিক মহামারি করোনার কারণে কাজে কিছুটা বিলম্ব হয়। এসব কারণে কয়েক দফায় বেড়ে সর্বশেষ এ সেতু প্রকল্পের ব্যয় ১ হাজার ৪শ ৪৭ কোটি টাকায় গিয়ে দাঁড়ায়। যা শুরুর দিকের আনুমানিক মূল ব্যয়ের সাড়ে ৩ গুণেরও বেশি, শুরুর দিকে ব্যয় ধরা হয়েছিলো ৪শ ১৩ কোটি ২৯ লাখ টাকা। কুয়েত ফান্ড ফর আরব ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট, ওপেক ফান্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এবং বাংলাদেশ সরকারের যৌথ বিনিয়োগে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘লনজিয়ান রোড অ্যান্ড ব্রিজ কনস্ট্রাকশন’ সেতুর নির্মাণের কাজ করছে। এখন সেতুর কাঠামো নির্মাণের পুরোপুরি শেষের দিকে, তবে রং করাসহ শেষ মুহূর্তের কাজ চলছে। নদী শাসন প্রকল্পের কাজ শেষ হতে আরো কিছুটা সময় লাগবে। সেতুর বিশেষত্ব:
এক হাজার ৪শ ৭০ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ১৯ দশমিক ৭৬ মিটার প্রস্থের এই চারলেনের সেতুটি কর্ণফুলি সেতুর আদলে এক্সট্রা ডোজ ক্যাবল স্টেট পদ্বতিতে তৈরি। ফলে নদীর মাঝ খানে একটি মাত্র পিলার ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়া ১৭ এবং ১৮ নম্বর পিলারের পাইল ১৩০ মিটার দৈর্ঘ্য যা দেশের সর্বোচ্চ গভীরতম পাইল। নদীর মধ্যে এবং পাশে থাকা পিলারে যাতে কোন নৌযান ধাক্কা দিতে না পারে। সেজন্য পিলারের পাশে নিরাপত্তা পিলার স্থাপন করা হয়েছে। পদ্মার থেকেও বড় স্প্যান অর্থাৎ ২শ মিটার দৈর্ঘ্যের দুটি স্পান বসানো হয়েছে এ সেতুতে। সেতুটি নদীর জলতল থেকে ১৮ দশমিক ৩০ মিটার উঁচু, ফলে নদীতে নৌযান চলাচলে কোনো ধরনের অসুবিধা হবে না। এছাড়া রাতের বেলা সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে আলোকিত হবে সেতুটি। সেতুটিতে রয়েছে আকাশ ও নৌপথের জন্য সিগন্যাল বাতি। এছাড়া সেতুটিতে ‘ব্রিজ হেলথ মনিটরিং সিস্টেম’ চালু রাখা হয়েছে। ফলে যেকোনো ত্রুটির আগাম সতর্কবার্তা পাওয়া যাবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৮১৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২২, ২০২১
এমএস/এএটি