ঢাকা, শনিবার, ২৮ আষাঢ় ১৪৩২, ১২ জুলাই ২০২৫, ১৬ মহররম ১৪৪৭

শিক্ষা

জিপিএ ও পাসের হার কম কেন?

ইসমাইল হোসাইন ও ফাহিম হোসেন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০:৪৩, জুলাই ১০, ২০২৫
জিপিএ ও পাসের হার কম কেন?

জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পরের কয়েকমাস শিক্ষার্থীরা ছিল ট্রমায়। এরমধ্যেই সিলেবাস শেষ করে পড়ার টেবিলে বসা ও পরীক্ষা দেওয়া ছিল আরও বড় চ্যালেঞ্জ।

এসব চ্যালেঞ্জ নিয়ে অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ বসেছিল মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) এবং সমমানের (দাখিল ও কারিগরি) পরীক্ষায়।

বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই) ২০২৫ সালের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। এ ফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত ১৫ বছরে তুলনায় এ বছরের এসএসসি পরীক্ষার ফল সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে। এর আগে সর্বশেষ ২০০৯ সালে সবচেয়ে কম পাস দেখা গিয়েছিল। সে বছর পাস করেছিল ৫৭.৩৭ শতাংশ শিক্ষার্থী। এরপর পাসের হার কখনো ৭৭.৭৭ এর নিচে নামেনি। এরপর ২০২১ সালে রেকর্ড পরিমাণ শিক্ষার্থী পাস করে। সেবছর ৯৩.৫৮ শতাংশ শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়।

২০২৪ সালের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন ৮৩.০৪ শতাংশ শিক্ষার্থী। সেটি ১৪.৪৯ শতাংশ কমে এবার ৬৮.৪৫ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে।
 
গত ৫ বছরের তুলনায় এ বছর জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যাও কমেছে। সর্বশেষ ২০২০ সালে এক লাখ ৩৫ হাজার ৮৯৮ জন শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পায়। পরের বছর ১ লাখ ৮৩ হাজার ৩৪০ জন জিপিএ-৫ পায়। ২০২২ সালে জিপিএ-৫ পায় ২ লাখ ৬৯ হাজার ৬০২ জনও। সর্বশেষ ২০২৪ সালে জিপিএ-৫ পায় ১ লাখ ৮২ হাজার ১২৯ জন। এ বছর ৪৩ হাজার ৯৭ জন শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছে।  
 
পাসের হার ও জিপিএ-৫ কেন এত কমলো, জানতে চাইলে বাংলাদেশ আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি ড. খন্দোকার এহসানুল কবির জানান, এ বছর কোনো ওভারমার্কিং বা আন্ডারমার্কিং করা হয়নি। নম্বর বেশি বা কম দেওয়ার কোনো নির্দেশনা ছিল না। যার যা প্রাপ্য, তাকে তাই দেওয়া হয়েছে। ফলাফলে এর প্রভাব পড়তে পারে।

অবশ্য শিক্ষাবিদরা বলছেন, জুলাই-গণঅভ্যুত্থানে শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অংশগ্রহণের প্রভাব এবারের ফলাফলে পড়েছে। এছাড়া অভ্যুত্থান পরবর্তী প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার পরিবেশ, শিক্ষার্থীদের মধ্যে মনস্তাস্তিক ট্রমা এবং আগের মতো রাজনৈতিক কারণে ‘ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে’ ফল না দেখানোর প্রভাব এবারের এসএসসির ফলে পড়েছে।

জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান এবং পরবর্তী প্রেক্ষাপটে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা এবং ফলাফলে প্রভাব রয়েছে বলে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ।
 
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আমরা দেখেছি গতবারের তুলনায় পাসের হার ও জিপিএ-৫ প্রাপ্তি কমেছে। এর পেছনে জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে শিক্ষার্থী-অভিভাবক-শিক্ষকদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অংশগ্রহণের প্রভাব আছে। বিপ্লব পরবর্তী সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় শিক্ষার স্বাভাবিক পরিস্থিতি ও শৃঙ্খলা ফিরে আসতে, পড়াশোনার পরিবেশ তৈরি হতে সময় লেগেছে। শিক্ষকদের জন্য সময়মত সিলেবাস শেষ করাও চ্যালেঞ্জ ছিল।
 
গুণগত শিক্ষার জন্য শিক্ষার পরিবেশ এবং চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার ওপর গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে আমরা যে প্রচলিত শিক্ষা পাচ্ছি সেখানে আমাদের কি কি সীমাবদ্ধতা আছে সেগুলোরও প্রভাব আছে। প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, সুযোগ-সুবিধা, অবকাঠামো, শিক্ষার পরিবেশ— এগুলো শিক্ষার্থীদের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে প্রান্তিক পর্যায়ে প্রভাব বেশি। এজন্য শিক্ষার পরিবেশ ঠিক রাখার পাশাপাশি শিক্ষক স্বল্পতা পূরণ এবং অন্যান্য জায়গায় যে চ্যালেঞ্জ আছে, সেগুলো মোকাবিলা করতে হবে।
 
তিনি বলেন, আমরা যে ‘জেন-জি’ বলছি তাদের সঙ্গে যেন সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারি। শিক্ষার্থীরা একটা ট্রমার মধ্যে ছিল, তাদের ট্রমা কাটিয়ে তুলতে হবে। গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করলে ফলাফল এমনিতেই বেড়ে যাবে।
 
এবারের পাসের হার এবং জিপিএ-৫ কম হলেও সেটি গুণগত শিক্ষার জন্য ইতিবাচক বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক আব্দুস সালাম। তিনি বলেন, পূর্বে যে রাজনৈতিক প্রেশার ছিল, সেটা আমাদের ফলের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতো। রাজনৈতিক বক্তব্য দেওয়ার কারণে শতভাগ পাসের একটা উৎসব এবং প্রশ্ন ফাঁসের একটা বিষয় যুক্ত থাকার কারণে তখন ফলাফল অনেক ভালো হতো। কিন্তু শিক্ষার গুণগত মান তখন বাড়েনি।
 
এবার কোনো রাজনৈতিক প্রেশার নেই। এখানে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো উৎসব, প্রধানমন্ত্রীর কাছে ফলাফল জমা দিতে হবে, এ ধরনের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। ফলে শিক্ষক এবং প্রতিষ্ঠানের ওপর আগের মতো যে চাপ থাকতো, এবার সেটা ছিল না। অনেকটা নিরপেক্ষ পরীক্ষা ব্যবস্থাপনা ও মূল্যায়ন হয়েছে। ফলে ফলাফল কিছুটা শতাংশের হার কমলেও গুণগত দিক থেকে মান বাড়ানোর জন্য ইতিবাচকভাবেই দেখি।
 
তিনি আরও বলেন, আন্দোলনের প্রভাবে শিক্ষার্থী-অভিভাবক-শিক্ষক সবার মধ্যে একটা অস্থিরতা ছিল। শিক্ষার্থীরা কিছুটা পাঠ বিমুখও বটে। যেহেতু অটো পাস তারা আগে দেখেছে। সব মিলিয়ে ফলাফল শতাংশের হিসেবে কিছুটা কমেছে কিন্তু গুণগত শিক্ষার জন্য এটা কোনো ব্যাপার না। বরং অভিভাবক এবং শিক্ষার্থীদের শিক্ষার গুণগত মান বাড়ানোর জন্য ভবিষ্যতে গুরুত্বারোপ করা উচিত।
 
সাদামাটা ফল প্রকাশ
রাজনৈতিক সরকারের সময়ে প্রতিবছর ঘটা করে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হতো। কেন্দ্রীয়ভাবে শিক্ষামন্ত্রী ফলাফলের সার-সংক্ষেপ তুলে ধরতেন। কিন্তু এবার তা হয়নি। কেন্দ্রীয়ভাবে আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তা বোর্ডে ফলাফল প্রকাশ করেছেন।
 
বেলা ২টায় ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সম্মেলন কক্ষে সংবাদ সম্মেলনে সব বোর্ডের ফলাফলের সব তথ্য তুলে ধরেন বাংলাদেশ আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. খন্দোকার এহসানুল কবির।
 
এগিয়ে রাজশাহী, পিছিয়ে পড়ল বরিশাল
এসএসসি পরীক্ষায় সবার চেয়ে এগিয়ে রাজশাহী বোর্ড। ৭৭.৬৩ শতাংশ পাস নিয়ে এবছর প্রথমে রয়েছে তারা। তবে গতবছরের তুলনায়ও তাদের পাসের হার কমেছে। এ বছর সবার পেছনে পড়ল বরিশাল। এই বোর্ডে পাস করেছেন কেবল ৫৬.৩১ শতাংশ।

বরিশাল ছাড়াও ফলাফলে ধস নেমেছে ময়মনসিংহ বিভাগে। এই বিভাগে এবারের পাসের হার ৫৮.২২ শতাংশ। গতবছরের তুলনায় এবার এই বোর্ডে পাসের হার কমেছে ২৬.৭৫ শতাংশ।

এছাড়াও ঢাকা বোর্ডে ৬৭.৫১ শতাংশ, রাজশাহীতে ৭৭.৬৩, কুমিল্লায় ৬৩.৬০ শতাংশ, যশোরে ৭৩.৬৯, দিনাজপুরে ৬৭.০৩ শতাংশ, ময়মনসিংহে ৫৮.২২ শতাংশ, বরিশাল বোর্ডে ৫৬.৩৮ শতাংশ, বিআইএসই বোর্ডে ৬৮.০৪, মাদরাসা বোর্ডে ৬৮.০৯ এবং কারিগরি বোর্ডে ৭৩.৬৩ শতাংশ পাস করেছেন।
 
হিসাব মিলল না গণিতেই
এবারের এসএসসি পরীক্ষায় সবচেয়ে বেশি ফেল করেছেন গণিতে। প্রায় ২৪ শতাংশ শিক্ষার্থী এই বিষয়ে পাস নম্বর তুলতে পারেননি। এরপর খারাপ করেছে ইংরেজি বিষয়ে।

বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সব বোর্ড মিলিয়ে গণিতে বিষয়ে পাস করেছে ৭৭.৪৬ শতাংশ শিক্ষার্থী। যেসব বোর্ড এবছর পাসের হারে পিছিয়ে রয়েছে, সেসব বোর্ডের শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি খারাপ করেছে গণিতে।

বরিশাল বোর্ডে এবার গণিতে সবচেয়ে কম শিক্ষার্থী গণিতে পাস করেছে। এ বিষয়ে পাস করেছে ৬৪.৬২ শতাংশ। এছাড়া ময়মনসিংহ বোর্ডে ৬৪.২৭ শতাংশ শিক্ষার্থী গণিতে পাস করেছে। দুটো বোর্ডের গণিত এবং ইংরেজিতে পাসের হার সামগ্রিক পাসের হারের ওপর প্রভাব ফেলেছে।
 
এফএইচ/আইএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।