খুলনা: দেশের একমাত্র সেশনজট, সন্ত্রাস ও রাজনীতিমুক্ত পাবলিক বিশ্বাবদ্যালয় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় (খুবি)। ২৫ নভেম্বর মঙ্গলবার খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস।
মহানগরী খুলনা থেকে ৩ কিলোমিটার পশ্চিমে খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়ক সংলগ্ন ময়ূর নদীর পাশে এক মনোরম পরিবেশে গল্লমারীতে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় অবস্থিত। তবে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও সংলগ্ন এলাকাটি ছিলো ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়কার এক বধ্যভূমি। প্রতিষ্ঠাকালের দিক থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান নবম।
সময়ের চাহিদা অনুযায়ী এবং ভবিষ্যতের চাহিদার নিরিখে এখানে বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও প্রযুক্তিবিদ্যা বিষয়ের প্রতি অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। নগর ও গ্রামীণ পরিকল্পনা, এনভায়রমেন্টাল সায়েন্স এবং বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মত বিষয় দেশে স্নাতক পর্যায়ে শিক্ষা কোর্স খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম চালু করা হয়। এছাড়া স্থাপত্য ও ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতক পর্যায়ে শিক্ষা কোর্স ঢাকার বাইরে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে বুয়েটের পরই ১৯৯৭-৯৮ শিক্ষাবর্ষ থেকে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোর্স ক্রেডিট পদ্ধতি চালু হয়।
বর্তমানে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫টি স্কুলের (অনুষদ) অধীনে ২১টি ডিসিপ্লিন (বিভাগ) এবং একটি ইনস্টিটিউটে (চারুকলা) অধীনে ৩টি ডিসিপ্লিন শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিয়মিত ব্যাচেলর ডিগ্রি, ব্যাচেলর অব অনার্স ডিগ্রি, মাস্টার্স ডিগ্রি, এম ফিল, এবং পিএইচডি প্রদান করা হয়।
স্কুলগুলোর মধ্যে বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও প্রযুক্তিবিদ্যা স্কুলের আওতায় রয়েছে আর্কিটেকচার, আরবান অ্যান্ড রুরাল প্লানিং, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রনিক্স অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং, গণিত, পদার্থ, রসায়ন বিজ্ঞান এবং পরিসংখ্যান বিজ্ঞান ডিসিপ্লিন।
জীব বিজ্ঞান স্কুলের আওতায় রয়েছে ফরেষ্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি, ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন রিসোর্স টেকনোলজি, বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, এগ্রোটেকনোলজি, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স, ফার্মেসি ও সয়েল সায়েন্স ডিসিপ্লিন।
ব্যবস্থাপনা ও ব্যবসায় প্রশাসন স্কুলের আওতায় রয়েছে ব্যবসায় প্রশাসন ডিসিপ্লিন। কলা ও মানবিক স্কুলের আওতায় রয়েছে ইংরেজি এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্য ডিসিপ্লিন। সমাজ বিজ্ঞান স্কুলের আওতায় আছে অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান ও ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ ডিসিপ্লিন। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র ইনস্টিটিউটের নাম চারুকলা ইনস্টিটিউট। এর আওতায় তিনটি ডিসিপ্লিন চালু হয়েছে, এগুলো হলো ড্রইং অ্যান্ড পেইন্টিং, প্রিন্ট মেকিং ও ভাষ্কর্য ডিসিপ্লিন।
এছাড়া সেন্টার ফর ইন্টিগ্রেটেড স্টাডিজ অন দ্য সুন্দরবনস (সিআইএসএস), রিসার্স সেল, মডার্ন ল্যাংগুয়েজ সেন্টার ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় স্টাডিজ শিক্ষা ও গবেষণা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা-গবেষণার মান বিশ্বমান অর্জনে সেন্টার ফর এক্সিলেন্স ইন টিচিং এ- লার্নিং (সিইটিএল) এবং ইনস্টিটিউশনাল কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স (আইকিউএসি) সেল নামে দু’টি পৃথক সেল গঠন করা হয়েছে। এ দু’টি সেলের কার্যক্রমও ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষক সংখ্যা ৩৭২জন। ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে পাঁচ হাজারের বেশি, এর মধ্যে বিদেশি ছাত্র-ছাত্রী ১২ জন। এছাড়া কর্মকর্তা ২২০ জন এবং কর্মচারী রয়েছে ৩ শতাধিক।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনগণের নিরলস প্রচেষ্টা ও দীর্ঘদিনের আন্দোলন। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পর ১৯৮৭ সালের ৪ জানুয়ারি গেজেটে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় সরকারি সিদ্ধান্ত প্রকাশিত হয়। ১৯৮৯ সালের ৯ মার্চ তৎকালীন রাষ্ট্রপতি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। ১৯৯০ সালের জুন মাসে জাতীয় সংসদে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাশ হয়, যা গেজেট আকারে প্রকাশ হয় ওই বছর ৩১ জুলাই। ১৯৯০-৯১ শিক্ষাবর্ষে ৪টি ডিসিপ্লিনে ৮০জন ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করা হয়। ১৯৯১ সালের ৩০ আগস্ট প্রথম ওরিয়েন্টেশন এবং ৩১ আগস্ট ক্লাস শুরুর মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রমের সূচনা হয়। পরে একই বছরের ২৫ নভেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন।
২০০২ সালের ২৫ নভেম্বর ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা ও আড়ম্বরপূর্ণ পরিবেশে পালিত হয় প্রথম খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস। এরই ধারাবাহিকতায় সেই থেকে প্রতিবছর ২৫ নভেম্বর খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বিশেষ করে নবীন শিক্ষকরা যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশসমূহ, অষ্ট্রেলিয়া, জাপানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণা ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় স্কলারশিপ পাচ্ছেন। দেশি-বিদেশি সংস্থার গবেষণা সহায়তাও বাড়ছে। শিক্ষা ও গবেষণা কর্মকাণ্ডে সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন বিদেশি সংস্থা, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও উন্নত বিশ্বের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার বিশেষজ্ঞ, দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর, বিজ্ঞানী ও গবেষক খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করেছেন। কানাডা, জাপানসহ কয়েকটি দেশের সাথে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম রয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের গবেষণার সুযোগ বাড়াতে ক্যাম্পাসে ইতোমধ্যে কয়েকটি আন্তর্জাতিকমানের গবেষণাগার স্থাপিত হয়েছে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রয়েছে ৩টি একাডেমিক ভবন, প্রশাসনিক ভবন, ভাইস-চ্যান্সেলরের বাসভবন, তিনটি আবাসিক হল, মেডিকেল সেন্টার, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য ৫টি বাসভবন, অগ্রণী ব্যাংক শাখা, ডাকঘর ও মসজিদ। ছাত্র-ছাত্রী এবং শিক্ষকদের জ্ঞান সহায়তায় রয়েছে সমৃদ্ধ কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি ভবন ও শার্লী ইসলাম গ্রন্থাগার ভবন। এছাড়া গেস্ট হাউজ, কেন্দ্রীয় মসজিদ, মন্দির নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। ছাত্রদের জন্য আরও একটি আবাসিক হল এবং মেয়েদের জন্য আরও একটি আবাসিক হলের নির্মাণ কাজ শেষের পথে।
দেশের তথা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উচ্চ শিক্ষার বিকাশে স্থানীয় সম্পদ আহরণ, উন্নয়ন ও সংরক্ষণের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা, প্রশিক্ষিত, দক্ষ ও মানবিক গুণাবলি সম্পন্ন জনসম্পদ সৃষ্টি, জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা শাখায় উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে দেশকে সমৃদ্ধির সোপানে এগিয়ে নেয়া এবং সম্ভাবনার নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণার কাজ এগিয়ে চলেছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে শিক্ষা সাফল্যের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখে অগ্রসর হচ্ছে তার লক্ষ্যে।
খুবির জনসংযোগ ও প্রকাশনা বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক এস এম আতিয়ার রহমান রোববার বাংলানিউজকে জানান, বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সকাল ১০টায় বর্ণাঢ্য র্যালি (খুবি ক্যাম্পাস হতে বাস যোগে শিববাড়ী মোড়, শিববাড়ী মোড় হতে পায়ে হেটে-ময়লাপোতা হয়ে রয়েল চত্বর, রয়েল চত্বর থেকে বাস যোগে খুবি ক্যাম্পাস), বাদ যোহর বিশ্ববিদ্যালয় জামে মসজিদে দোয়া মাহফিল, বিকাল ৩ টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত মুক্ত মঞ্চে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সন্ধ্যা ৬টায় শহীদ মিনার চত্বর, অদম্য বাংলা ও কটকা স্মৃতিসৌধে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন। ক্যাম্পাসে আলোকসজ্জা, নতুন প্রশাসনিক ভবন, ক্যাফেটেরিয়া, একাডেমিক ভবন ও হলসমূহ। এছাড়া হলসমূহে উন্নতমানের খাবার পরিবেশনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
এদিকে ২৪তম বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের প্রাক্কালে বর্তমান ভাইস-চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অমিত সম্ভাবনা রয়েছে। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এ বিশ্ববিদ্যালয়কে সামনে এগিয়ে নিতে হবে।
তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় দিবস প্রকৃত অর্থে বিগত সময়ের কার্যক্রম মূল্যায়নের দিন। আমাদের অতীতের অভিজ্ঞতায় বর্তমানের প্রচেষ্টায় আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নতুন উদ্যমে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই নিরন্তর গবেষণার মাধ্যমে উন্নয়নের নতুন দিক-নির্দেশনা দিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, নিরবচ্ছিন্নভাবে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে শিক্ষা কার্যক্রমের দুইযুগ পূর্তি নিঃসন্দেহে দেশে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিশেষ অর্জন, ঐতিহাসিক ঘটনা। এই দুই যুগে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সুদৃঢ় ভিত্তি রচিত হয়েছে তা আগামী দিনের সাফল্যের সোপান বেয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সামনে যেতে অনুপ্রাণিত করবে। আগামী বছর ২৫ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের রজতজয়ন্তী উদযাপনের মাধ্যমে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎকর্ষের এক বিশেষ স্মারক রচিত হবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৩৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৫, ২০১৪