শরণখোলা, বাগেরহাট থেকে: ভাঙাচোরা প্রায় দুই কিলোমিটার কাচারাস্তা। ধুলোমাখা পথ মাড়িয়ে জেলেদের ছোট্টগ্রাম চরপাড়া।
ভবনের দোতলায় একটি কক্ষে ক্লাস নিচ্ছেন শিক্ষক শারমিন জাহান, ব্লাক বোর্ডে পাখি-ফুলের ছবি এঁকে প্রশ্ন করছেন কয়টি পাখি, কয়টি ফুল? নিম্নবিত্ত জেলে পরিবারের ছোট্ট বাচ্চাদের মুখে সমস্বরে উত্তর- চারটি, তিনটি, পাঁচটি- ইত্যাদি ইত্যাদি।
কাঠের হাইবেঞ্চে বসা বাচ্চাদের শরীরে জীর্ণশীর্ণ পোশাক বলছে তাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা বেহাল। পড়ালেখার প্রতি মনোযোগ নেই বাবা মায়েদের, কিন্তু স্কুল তাদের কাছে অালোর দিশারী।
ক্লাসের ফাঁকে শিক্ষক শারমিন জাহান বাংলানিউজকে বলেন, এখানে সব জেলে পরিবারের সন্তান। এ স্কুলটি না থাকলে বাচ্চারা শিখতে পারতো না। ক্লাসের পড়া ক্লাসেই শেষ করা হয়, বাচ্চারা মনোযোগী, জানান শারমিন জাহান।
স্কুলের শিশু শ্রেণির শিক্ষার্থী মাহিনুর জানায়, বাড়ির কাছে স্কুল, তাই ভালো লাগে। তার অারেক ভাই এ স্কুলেরই দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র। দু’ভাইবোন একসঙ্গে অাসে-যায়।
২০০৭ সালের নভেম্বর মাসে ঘূর্ণিঝড় সিডর আঘাত হানার পর দুর্গতদের জন্য এ এলাকায় চারটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেয় গ্রামীণফোন। এদের একটি চরপাড়া মাতৃভাষা বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, যেটি স্কুলের পাশাপাশি ব্যবহার হয় আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে। স্কুলের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপকরণ স্থানীয়রাই ব্যবস্থা করছেন।
স্কুলটি যে ছেলেমেয়েদের কাছে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে তার কথা শোনালেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও এলাকাবাসীরা।
স্থানীয় ইউপি সদস্য বাচ্চু মুন্সি বাংলানিউজকে বলেন, এ এলাকার সবাই জেলে। অভিভাবকদের বাচ্চাদের শিক্ষা দেওয়ার কোনো অাগ্রহ নাই। শিক্ষকরা বাড়ি থেকে টেনে বাচ্চাদের স্কুলে নিয়ে এসেছেন।
স্কুলটির শিক্ষকদের স্থানীয়রা নাম মূল্যে খরচ দেন। বলা যায় বিনা খরচেই পড়ান তারা।
পাশের কক্ষে দ্বিতীয় শ্রেণির ক্লাস নিচ্ছেন আরেক শিক্ষক নীলুফার ইয়াসমিন। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, সিডরে গ্রাসের পর এ স্কুল প্রতিষ্ঠা হয়।
স্থানীয়রা জানান, এ চরপাড়া থেকে উত্তরে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে উত্তর শরণখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং দক্ষিণে দুই কিলোমিটার দূরে খুড়িয়াখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
দুই কিলোমিটারের মধ্যে স্কুল নেই। আশেপাশে কোনো স্কুল না থাকায় এ প্রতিষ্ঠানটি হয়ে উঠেছে এখানকার শিক্ষার একমাত্র কেন্দ্রবিন্দু।
স্থানীয় বাসিন্দা আসাদুজ্জামান মুন্সি বলেন, এ স্কুল না থাকলে এলাকা অন্ধকার থাকতো। গ্রামীণফোন আলো দিয়েছে। এখন তার নাম তাই আলোকদ্বীপ!
২০১১ সাল থেকে স্থানীয়রা স্কুলটি পরিচালনা করছেন। স্কুলটির পরিচালনা কমিটির সভাপতি হিসেবে রয়েছেন ইউপি সদস্য বাচ্চু মুন্সি।
জনপ্রতিনিধি বাচ্চু মুন্সি বলেন, স্কুলটি যেন দাঁড়ায়, এলাকার ছেলেপেলে যেন মানুষ হয়, ভবিষ্যতে যেন আলোর মুখ দেখে, এটাই প্রত্যাশা।
স্কুলে শিশু শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় দেড়শ’ জন। তার মধ্যে অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থী উপস্থিত থাকে প্রতিদিন। আর শিক্ষকদের তিন জনই নারী।
চরপাড়ার স্কুলটির জমিদাতা স্থানীয় জাহানারা বেগম। তার বাড়ির পাশেই স্কুল। জাহানারার ছেলে তাইজুল ইসলাম বলেন, চরের ছেলেদের জন্য স্কুলটি খুবই উপযোগী।
আরেকটি স্কুলের অবস্থান রায়েন্দা ইউনিয়নের চাল রায়েন্দা এলাকায়। সুশীলন স্কুল কাম সাইক্লোন সেন্টার নামের এ প্রতিষ্ঠানটিতে শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় অর্ধশত।
শিক্ষক রিপা হালদার বাংলানিউজকে জানান, সিডরের পর এলাকার মানুষের খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল না। এখন স্কুলে বাচ্চারা পড়াশোনা করতে পারছে।
স্কুলের শিক্ষার্থী সুমাইয়া আক্তার জানায়, আমরা সকালে স্কুল অাসি, মজা পাই।
প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী হালিমার বাবা হালিম গাজী বলেন, এলাকার সবাই জেলে, কেউ মাছের ব্যবসা করেন। এ স্কুল আমাদের ছেলেপেলেদের জন্য অনেক ভালো হইছে।
এ স্কুলের জমিদাতা লাল মিয়া গাজী, জমি দিতে পেরে গর্বিত তিনি। বাংলানিউজকে বলেন, গ্রামীণফোন এগিয়ে অাসায় নিজের জমি দিয়েছেন স্কুলের জন্য।
গ্রামীণফোনের স্পেশালিস্ট, সিঅার এনগেজমেন্ট, (করপোরেট রেসপন্সিবিলিটি, কমিউনিকেশন ডিভিশন) এম হাফিজুর রহমান খান জানান, সিডর আক্রান্ত এলাকায় পুর্নবাসন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে গ্রামীণফোন বাগেরহাট ও বরগুনায় চারটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৭ সালে নভেম্বর মাসে বাংলাদেশে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় সিডর। ঘূর্ণিঝড়টি প্রথমে উপকূলবর্তী এলাকায় আঘাত হানে ও পরবর্তীতে দক্ষিণ উপকূলে পূর্বে-পশ্চিমে বয়ে যায়।
ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী হিসেবে দেখা গেছে, সিডরের আঘাতে ৩ হাজার ৫০০ মানুষের প্রাণহানি ঘটে, রাস্তাঘাট ও সরকারি ভবনগুলো মারাত্মক ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং ৪ হাজার ৩০৬টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আংশিকভাবে ধ্বংস হয়।
সিডর আক্রান্ত এলাকায় সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের উপ আনুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষাপ্রদানে বছরজুড়েই আশ্রয়কেন্দ্রগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে। এ স্থাপনাগুলোর নাম দেওয়া হয়েছে ‘আলোকদ্বীপ’। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্মাণ ও কার্যক্রম পরিচালনাসহ এ প্রকল্পের সর্বোপরি ব্যবস্থাপনায় রয়েছে এ এলাকায় কাজ করা স্থানীয় এনজিও রিসোর্স ডেভলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (আরডিএফ) ও সুশীলন। খেলার মাঠসহ প্রতিটি স্কুল ভবনই দুই তলা। ২০১১ সালে স্থানীয় লোকদের কাছে আলোকদ্বীপ হস্তান্তর করে গ্রামীণফোন। তখন থেকে স্থানীয় বাসিন্দারাই আলোকদ্বীপের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা করেছে।
আলোকদ্বীপ স্থাপনের সময় সম্পৃক্ত ছিলেন স্থানীয় পার্থ সরকার।
পার্থ সরকার বলেন, উভয় আলোকদ্বীপই উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রদানের পাশাপাশি স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রয়োজন অনুযায়ী ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অালোকদ্বীপ স্থানীয় দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষার অালো ছড়াচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭২২ ঘণ্টা, মার্চ ৩১, ২০১৬
এমআইএইচ/জেডএস