ঢাকা, বুধবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিক্ষা

জাবিতে ভর্তি বাণিজ্যের জন্যই ফরমের মূল্যবৃদ্ধি!

ওয়ালিউল্লাহ ও নুর আলম হিমেল | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২১৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ১০, ২০১৬
জাবিতে ভর্তি বাণিজ্যের জন্যই ফরমের মূল্যবৃদ্ধি!

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়: ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদির মূল্য বাড়ার অজুহাত দেখিয়ে প্রতিবছর ভর্তি ফরমের মূল্য বাড়াচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, প্রতিবছর ভর্তি পরীক্ষা থেকে শিক্ষকদের ভাগের টাকার পরিমাণও বাড়ছে।

অভিযোগ, নিয়ম বহির্ভূতভাবে এই টাকা পকেটস্থ করছেন শিক্ষকরা।

ভর্তিচ্ছুদের আর্থিক অবস্থা বিবেচনা না করেই শিক্ষকরা ভর্তি পরীক্ষা থেকে অনৈতিকভাবে বেশি টাকা নেওয়া হচ্ছে। এতে দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীরা যেমন আর্থিক সংকটে পড়ছেন, তেমনি অনেকে টাকার অভাবে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়া থেকেই বঞ্চিত হচ্ছেন বলে মনে করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা।

গত কয়েকটি শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষার ফরমের মূল্য বাড়ার হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে গাণিতিক ও পদার্থ বিষয়ক অনুষদ, সমাজবিজ্ঞান অনুষদ, জীববিজ্ঞান অনুষদ এবং বিজনেস স্টাডিজ অনুষদের ফরমের মূল্য ছিল ৫০০ টাকা। ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে এই ফরমের মূল্য ২৫ টাকা বাড়িয়ে করা হয় ৫২৫ টাকা। ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে আরও ২৫ টাকা বাড়িয়ে ৫৫০ টাকা করা হয়েছে। ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষে এই চারটি অনুষদের ফরমের মূল্য ছিল ৩৫০ টাকা।

এ ছাড়া কলা ও মানবিক অনুষদে গত বছর বিভাগভিত্তিক পরীক্ষা হলেও এ বছর ইউনিটভিত্তিক পরীক্ষা নেওয়ায় মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৫০ টাকা। ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষে এই ইউনিটের ফরমের মূল্য ছিল ৩৫০ টাকা।

গত দুই শিক্ষাবর্ষের হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৪-২০১৫ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি পরীক্ষা থেকে আয় হয় আট কোটি ৪০ লাখ টাকা। এর মধ্যে স্টেশনারি কেনা বাবদ এক কোটি, টেলিটক চার্জ বাবদ দেওয়া হয় ৮৪ লাখ টাকা আর বাকি ছয় কোটি ৫০ লাখ টাকা যায় শিক্ষক-কর্মকর্তাদের পকেটে।  

ভর্তি পরীক্ষা থেকে উপাচার্য নেন এক লাখ ২৫ হাজার টাকা, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ প্রত্যেকে নেন এক লাখ ১৫ হাজার টাকা, পরীক্ষা কমিটির সচিব ও ১০ জন সদস্য প্রত্যেকে নেন এক লাখ এক হাজার টাকা, নিরাপত্তা কমিটির ১৩ জন শিক্ষক নেন এক লাখ এক হাজার টাকা করে, নিরাপত্তা কমিটির চারজন কর্মকর্তা প্রতিজন নেন ৫০ হাজার টাকা এবং ভর্তি পরীক্ষায় পরিদর্শকের দায়িত্ব পালনের জন্য ৪শ ৮৪ জন শিক্ষক প্রতিজন নেন এক লাখ এক হাজার টাকা।  

২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি পরীক্ষার ফরম বিক্রি বাবদ আয় হয় আট কোটি ৮৫ লাখ ৪৬ হাজার ২শ ২৫ টাকা। এর মধ্যে টেলিটক চার্জ বাবদ নেয় ৮৮ লাখ ৬০ হাজার। ভর্তি পরীক্ষা থেকে উপাচার্য নেন এক লাখ ২৫ হাজার টাকা, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ প্রত্যেকে নেন এক লাখ ১৫ হাজার টাকা, পরীক্ষা কমিটির সচিব ও ১২ জন সদস্য প্রত্যেকে নেন এক লাখ দুই হাজার টাকা, নিরাপত্তা কমিটির ১২ জন শিক্ষক নেন এক লাখ দুই হাজার টাকা, নিরাপত্তা কমিটির পাঁচজন কর্মকর্তা প্রতিজন নেন ৫০ হাজার ৫০০ টাকা এবং ভর্তি পরীক্ষায় পরিদর্শকের দায়িত্ব পালনের জন্য ৪শ ৮৬ জন শিক্ষক প্রতিজন নেন এক লাখ দুই হাজার টাকা।  

বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যয় করার জন্য ভর্তি পরীক্ষার আয়ের ৪০ শতাংশ টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ডে জমা রাখতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সেই নির্দেশনা তোয়াক্কা না করে সম্পূর্ন টাকা শিক্ষক-কর্মকর্তাদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে দেন।

জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোট’র সভাপতি জুবায়ের টিপু বলেন, দরিদ্র শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে হীনপন্থায় টাকা শিক্ষকদের পকেটে ভরার নিয়ম কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু নেই। কিন্তু এ বিশ্ববিদ্যালয়ে এটি ট্র্যাডিশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভর্তি পরীক্ষা এলেই কীভাবে নিজের পকেট গরম করা যায় সেই চেষ্টায় তৎপর থাকে।  

এ ধরনের ঘৃণ্য কাজ থেকে শিক্ষকদের সরে আসার জোর দাবি জানান তিনি।  

সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের জাবি শাখার সাধারণ সম্পাদক সুস্মিতা মরিয়ম বলেন, এমনিতেই দরিদ্র শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায় করে একটি ঘৃণ্য কাজ করছে। তার উপর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা যদি নিয়ম বহির্ভূতভাবে উন্নয়ন খাতের টাকা নিজের পকেটে ভরেন তাহলে সেটি হবে আরও ঘৃণ্য কাজ। আমি আশাকরি, এই শিক্ষাবর্ষে শিক্ষকরা যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করে যথাযোগ্য সম্মানি নেবেন।

বিশ্ববিদ্যালয় ডেপুটি রেজিস্ট্রার (শিক্ষা-১) ও বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কমিটির সচির মোহাম্মদ আলী বলেন, ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদির দাম দিন দিন বাড়তে থাকায় ভর্তি পরীক্ষার ফরমের মূল্য বাড়ানো হচ্ছে। আমরা সবসময় শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধার দিকে লক্ষ্য রাখি। কিন্তু শিক্ষকদের জীবন ধারণের ব্যয়ও বাড়ছে।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল মান্নান বাংলানিউজকে বলেন, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী যদি কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা থেকে আয় করা টাকার নির্দ্দিষ্ট অংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ডে জমা না রাখে, তবে অডিট করার সময় আপত্তি জানায়।

তিনি বলেন, অনেক বিশ্ববিদ্যালয় এ টাকা জমা রাখে। কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ আয়ের খাতে এটা দেখায়।

বাংলাদেশ সময়: ১২১৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ১০, ২০১৬
এসএনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।