কিশোরগঞ্জের সকলের মাঝে প্রিয় সোহরাব স্যার হয়েই ৯০ বছর বয়সে পরলোকে পাড়ি জমিয়েছেন তিনি।
শুক্রবার (১৯ মে) বিকেলে আলহাজ শামসুল হুদা সোহরাব স্যার তার কিশোরগঞ্জ শহরের চর শোলাকিয়া এলাকার বাসভবনে ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
প্রথাগত অর্থে শ্রেণিকক্ষে আবদ্ধ শিক্ষক ছিলেন না তিনি। ছিলেন সমাজ ও পরিবারের শিক্ষকও। প্রত্যেক ছাত্রের পরিবারের খোঁজ রাখতেন তিনি। কোনো সমস্যা হলে বা অনিয়ম দেখলেই বাসা-বাড়িতে হানা দিতেন। ছাত্রদের অবাধ্যতা, অনিয়মের মূলোৎপাটন করেই নিবৃত্ত হতেন।
সত্তর, আশি, নব্বই দশকের শিক্ষার্থীদের কাছে সোহরাব স্যার তাই উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বলে।
১৯৯৩ সালে অবসরের আগ পর্যন্ত পুরোটা কর্মজীবনে ছিলেন কিশোরগঞ্জের প্রধানতম বিদ্যাপীঠ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। শহরের অগ্রসর ছাত্রদের ভিড় এ স্কুলে। তিনি এক এক করে প্রত্যেক ছাত্রকে পর্যবেক্ষণ করতেন। কে ভবিষ্যতে কোন পথে গেলে ভালো করবে, সেটিও ঠিক করে দিতেন সোহরাব স্যারই।
আমাকেও স্কুল ও পাবলিক লাইব্রেরির সঙ্গে আদি পরিচয় করিয়ে দেন তিনি।
মোটিভেশন ও পৃষ্ঠপোষকতারও বিরল ক্ষমতা ছিল তার। আর ছিল কঠোর নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলতা। শহরের কোনো হট্টগোল-গণ্ডগোলে, মার-দাঙ্গায় স্কুলের কোনো ছাত্রের বিন্দুমাত্রও সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে আর রক্ষা নেই।
স্যারের ভয়ে আমরা স্কুলজীবনে সন্ধ্যার পর বাসার বাইরে থাকার সাহস কখনোই পাইনি। অলক্ষ্য নজরদারিতে ছাত্রদের বিপথগামিতা থেকে রক্ষা করে শিক্ষা ও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সড়কে চলমান রেখেছেন সোহরাব স্যার। যে কারণে তার কৃতী ছাত্রের সংখ্যা অসংখ্য।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন ধার্মিক ও নিষ্ঠাবান। কিশোরগঞ্জের প্রধান মসজিদের (শহীদি মসজিদ) কমিটি, বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার সঙ্গে জড়িত থেকে শিক্ষা বিস্তারে অবদান রেখেছেন। শহরের চর শোলাকিয়া এলাকার একজন স্থায়ী বাসিন্দা বা ভূমিপুত্র হয়েও সমাজ ও মানুষের কল্যাণেই জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করেছেন তিনি। নিজের সন্তানদের সুশিক্ষিত এবং সন্তানসম শত-সহস্র ছাত্রকে আলোকিত জীবনের পথ নির্দেশ করেছেন।
আজকের দিনের বাণিজ্যমুখী শিক্ষা পরিস্থিতিতে তার মতো ত্যাগী, আর্দশবান, নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকের দেখা পাওয়া খুবই কঠিন। তিনি ছিলেন সেইসব অনুকরণীয় বিরল শিক্ষকদের একজন, যারা আপাদমস্তক শিক্ষক ছাড়া আর কিছুই ছিলেন না।
প্রিয় সোহরাব স্যারের মৃত্যু সংবাদে দেশে-বিদেশে বসবাসরত ছাত্রদের মধ্যেকার বেদনার স্রোত বিস্তৃত হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও। অনেকের সঙ্গে ফোনে কথা বলে তাদের অশ্রুসজল কণ্ঠস্বর টের পেয়েছি। তিনি সত্যিই তার কর্ম-প্রচেষ্টার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের হৃদয়ের গভীরে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্থায়ী আসন পেয়েছেন।
সোহরাব স্যারের মতো আদর্শ স্থানীয় শিক্ষকরা ক্রমে ক্রমেই সমাজ ও শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে লুপ্ত হয়ে যাচ্ছেন। এটি শুধু দুঃখের বিষয়ই নয়, অপূরণীয় ক্ষতির কারণও বটে।
ড. মাহফুজ পারভেজ: কবি ও লেখক, অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
mahfuzparvez@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ২২০০ ঘণ্টা, মে ১৯, ২০১৭
এমআইএস/এএসআর